1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে ধর্মীয় দলগুলোর হুমকির প্রভাব

৪ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশে এমন কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁজে পাওয়া কঠিন যেটি নিয়ে রাজনীতি হয় না৷ এর মধ্যে কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে রাজনীতি অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে চলছে৷ পাঠ্যপুস্তক বা পাঠ্যক্রম তেমনই একটা প্রপঞ্চ৷

https://p.dw.com/p/4lPOV
Fehler in Textbüchern aus Bangladesch
পাঠ্যপুস্তকের নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে বিতর্ক৷ ফাইল ফটো ছবি: bdnews24.com

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতবর্ষের অনেক দেশে এই রাজনীতি এখনো চলমান৷ তবে গত কয়েক দশকে ভুলে ভরা বিতর্কের সাথে সমানতালে পাল্লা দিয়ে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে রাজনীতির খেলা বাংলাদেশে অনেকাংশে বেড়েছে৷ আগে রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস, মতবাদ ও মূল্যবোধের প্রতিফলন পাঠ্যপুস্তকে কতখানি ঘটেছিল সেটিকে কেন্দ্র করে৷ এবার এই রাজনীতির খেলার প্রতিপাদ্য একটু বদল হয়েছে৷ আগে ছিল আধেয়কেন্দ্রিক, এবার সেটি হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক৷ অনুঘটক যায় হোক না কেন, পরিণতি বা ফলাফল একই৷ সেটি হলো সরকার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের সমর্থকদের চাপের মুখে দ্রুত নিজের অবস্থান বদল করেছে৷ যেটি আমরা অতীতেও ঘটতে দেখেছি৷ দুঃখের বিষয় হলো, স্বাধীনতার এত বছর পরেও পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও প্রণয়ন কমিটিতে কারা থাকবেন বা এর কাঠামো কি হবে, কীভাবে পরিবর্তন হবে, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনে কী কী বিষয় থাকবে এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় সিদ্ধান্ত কখনই নেওয়া যায়নি৷ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে একেকসময় একেকভাবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সংশোধন করে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হয়েছে৷ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই হৈ চৈ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমলাতান্ত্রিক সমস্যা ও প্রশাসনিক অপরিপক্কতা৷ কিন্তু সমস্যার শেকড় আরো গভীরে, যেটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর বীজ বপন করছে৷ দেশ ও জাতি হিসেবে আমরা কতটা বিভেদ এবং বিভক্তিতে নিমজ্জিত, কতটা ভঙ্গুর এবং লক্ষ্যহীন সেটার চিত্র পাঠ্যপুস্তককে ঘিরে ফি বছরের হট্টগোলে প্রতিফলিত হয়৷ শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যত বেশি হোক না কেন কিংবা সরকারের সদিচ্ছা যতই আশাব্যঞ্জক হোক না কেন পাঠ্যপুস্তক কীভাবে প্রণীত হবে সেটি জাতীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরিণত হতে হবে৷ রাজনৈতিক পক্ষের চাপে জাতীয় সিদ্ধান্তকে বিকিয়ে দিলে দীর্ঘমেয়াদে ফল ভাল হবে না৷ রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করার আগে মনে রাখা দরকার – যে বস্তু মানুষকে ভাসিয়ে রাখে সেটি ডুবাতেও পারে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমালোচনা গ্রন্থে বিষয়টি বুঝানোর জন্য খুব চমৎকারভাবে বলেছেন, কলস যত বড়ই হোক না কেন, অল্প ফুটা হলেই সেটি দিয়ে আর কোনো কাজ হয় না৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যে রাজনীতি অনেকদিন ধরে চলে এসেছে সেটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গলায় ফাঁসে রূপ নিচ্ছে৷

রাষ্ট্রের উন্নয়নে শিক্ষা একটি অপরিহার্য ব্যবস্থা যার কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতে হয়৷ সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো পূরণের হাতিয়ার হলো চারটি – শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যক্রম৷ শিক্ষার্থীদের জন্য মূল শ্রেণি উপকরণ হলো পাঠ্যক্রম বা পাঠ্যপুস্তক৷ সাধারণ বইয়ের সাথে এর একটি মৌলিক পার্থক্য আছে৷ পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও শিক্ষাদানের জন্যই তৈরি হয়৷ শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলামের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধনের দরকার হয়৷ স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক সবসময় ছিল৷ বর্তমান সময় অব্দি যদি ধরা হয় তাহলে বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনে যে বিতর্কগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোকে তিনটি বিষয়ে ভাগ করা যেতে পারে৷ এক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের সক্ষমতা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকের উপযুক্ততা; দুই. ভুলত্রুটি ও তথ্যের অসঙ্গতি; তিন. ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতবাদের প্রতিফলন৷ এর মধ্যে প্রথম ইস্যু নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা কম হলেও শেষ দুটি নিয়ে বিতর্কের ডামাডোল আমরা দেখেছি৷

Bangladesch | Wahlen | Talkshow
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

বাংলাদেশে বিগত কয়েকবছরে পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকাটা যেন একটি স্বাভাবিক নিয়ম বা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল৷ এমন নয় যে পাঠ্যপুস্তকে সীমাহীন ভুল ছিল৷ সমস্যা হলো যে ধরনের ভুল তথ্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপা হতো সেটা কোনোভাবে মেনে নেওয়ার মতো ছিল না৷ যেমন – বাংলাদেশে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস৷ সেখানে আওয়ামী লীগ শাসনামলে পাঠ্যবইয়ে ২৬ মার্চ গণহত্যা শুরু কথা বলা হলে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল৷ এ ধরনের ভুল অমার্জনীয় ভুল হিসেবেই বিবেচ্য৷ ভুলের পাশাপাশি অসঙ্গতি নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক ছিল৷ একটি সাধারণ তথ্য বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে নানাভাবে লেখা হতো৷ গত কয়েক বছরে পাঠ্য বই প্রকাশিত হওয়ার পরপরই দেখা যেত শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতো৷ তথ্যগত অসংগতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিধা ও আস্থার সংকট তৈরি করেছিল৷ পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়ে হৈ চৈ এতটা হয়েছিল যে সংশ্লিষ্ট বোর্ডকে আদালতে পর্যন্ত দাঁড়াতে হয়েছিল৷ উপরন্তু বিগত সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে প্ল্যাজারিজম বা চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিতেও দেখা গেছে৷ আবার বিদেশি লেখার হুবুহু অনুবাদের ক্ষেত্রে গুগল ট্রান্সলেশন ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে৷ সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ' বইয়ের একটি অংশ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে হুবহু অনুবাদ করে তুলে দেওয়া হয়েছিল৷ এমন পরিস্থিতি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞা তুলে ধরেছিল৷

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোতে পাঠ্যপুস্তক বিতর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ইস্যু হলো ধর্ম৷ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখনেই ধর্মকে রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তখনই বিতর্ক, বিরোধ ও সংঘাত দেখা দিয়েছে৷ যেমন - ভারতে বিজেপি সরকার অনেকদিন ধরে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক বদলে ফেলার চেষ্টা করছে৷ উত্তরপ্রদেশে পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা বাদ দিয়ে স্থান দেওয়া হয় রামদেব বাবার রচনা৷ এ নিয়ে ভারতীয় সেক্যুলারদের সাথে সরকারের বিরোধ অনেকদিনের৷ ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তানে এ ধারা শুরু হয়েছি৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে গঠিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়েনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন৷ কিন্তু ১৯৭৮ সালের পর থেকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা – এই চার মূলনীতি এক কথায় ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই'৷ আমরা দেখেছি বাংলাদেশর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যক্রম তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় চার মূলনীতির চেয়ে ধর্ম শিক্ষা এবং ধর্মীয় চিন্তা-চেতনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ পর্যায়ক্রমে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর চাপে অনেকবার সরকারকে নতজানু হতে দেখা গেছে৷ ২০১৬ সালের পর থেকে পাঠ্যপুস্তক নবায়ন নিয়ে যে বিতর্ক তা চরমভাবে বিশ্বাস ও মতবাদের লড়াইয়ের পরিণত হয়৷ এক্ষেত্রে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা নন, শিশু-কিশোররা কী পড়বে, কারা পাঠ্যক্রম ঠিক করবেন এসব নির্ধারণে মূখ্য ভূমিকা রাখছে ধর্মীয় সংগঠনগুলো৷ ২০১৬ সালে হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যবইয়ে ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বললে আওয়ামী লীগ সরকার তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছিল৷ এমনকি তখন সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই কয়েক লাখ কপি ছাপার পর সেগুলো গুদামে রেখে হেফাজতে ইসলামীর দাবি পূরণে দুটি লেখা বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপানোর ঘটনাও ঘটেছিল৷ হেফাজত ইসলামের অভিযোগ ছিল এসব লেখা ‘ইসলামবিরোধী' ও ‘নাস্তিকতাবাদী'৷ কিন্তু তার স্বপক্ষে কোনো আলোচনা বা অংশীজনের কোনো সংলাপ হয়নি৷ দাবি উত্থাপনকারীরা কোনো যুক্তিও তুলে ধরেনি৷ শুধু রাজনীতির মাঠ গরম করলেই সরকার বারবার দাবি মেনে নিয়েছিল৷ আওয়ামী লীগ আমলে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ছিল সেটির কেন্দ্রে ছিল পাঠ্যক্রমে স্থান পাওয়া আধেয়গুলোর লেখকের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে৷ তখন হেফাজতে ইসলামের পরামর্শক্রমে সরকার অনেক কিছু বাদ দিয়েছে যেগুলোর লেখক ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের৷ যেমন – ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু না থাকা সত্ত্বেও শুধু হিন্দু লেখক হওয়ায় জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া', ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান', লালন শাহর ‘সময় গেলে সাধন হবে না', রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা' ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে' বাদ দেওয়া হয়েছিল৷ এর অর্থ হলো, পাঠ্যপুস্তক বিতর্কের মূল আলোচনাটি ছিল মূলত হিন্দু-মুসলমান সাহিত্যিক নিয়ে৷ সে সময় সরকার হেফাজতে ইসলামের দাবিকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছিল যে, পাঠ্যবই নিরীক্ষণে গঠিত কমিটির মতামতকেও উপেক্ষা করেছিল৷

ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের পাঠ্যবইয়ে ওপর কাঁচি চালানোর রেশটি এবার ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে৷ এবার আধেয় নয়, পুরো কমিটির ওপর কোপ পড়েছে৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি করেছিল৷ কিন্তু গঠনের তিনদিনের মাথায় এই কমিটি বাতিল ঘোষণা করা হয়৷ সরকারের এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে৷ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া খুব স্বাভাবিক৷ কারণ এই কমিটির দুই সদস্যকে বাদ দিতে ধর্মভিত্তিক কিছু সংগঠনের নেতারা সরকারকে হুমকি দিয়েছিল৷ তাই মহল বিশেষের আপত্তিকে সরকার ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অবশ্যই একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো৷ এই সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের নানা ধরনের সংস্কার কাজের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷ এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছিল৷ এই দাবি তারা করতেই পারে এবং সেটি সরকার বিবেচনাও করতে পারতো৷ এমনকি কমিটি গঠন নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা সরকার বিবেচনা করতে পারে৷ সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে৷ কিন্তু গঠিত কমিটির দুই জন সদস্যকে নিয়ে একটা মহল ট্যাগ দেওয়ায় পুরো কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত কোনো অংশেই আওয়ামী লীগ শাসনামলের নাজুক নীতির চেয়ে কম নয়৷ বরং এবার যেটি হলো সেটির ভয়াবহতা আগের ঘটনাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে৷ অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর চাপে সরকার পাঠ্যপুস্তকে নানা পরিবর্তন এনেছে এবং সংশোধনের জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছে৷ আর এবার অন্তর্বর্তী সরকার মহলবিশেষের আপত্তির মুখে খোদ কমিটিই বাতিল করে দিল৷

এখানে বলা বাহুল্য যে, পাঠ্যপুস্তকের সংশোধন ও পরিমার্জন বলতে শুধু বইয়ের প্রচ্ছদ, রং, কিছু গল্প, কবিতা সংযোজন-বিয়োজনকে বুঝায় না৷ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়৷ রাষ্ট্রীয় নীতি ও জাতীয় শিক্ষা নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কাজের কাঠামো থাকতে হয়৷ বাংলাদেশের হারিয়ে যেতে বসা রাষ্ট্রীয় নীতি আর সঙ্কটে ভোগা শিক্ষা নীতির যেমন বেহাল দশা তেমনি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়াও ভুগছে সঙ্কটে৷ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে মূল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য এমন আধেয় সংযোজিত করা যা তাদের কল্পনাশক্তিকে শাণিত করে৷ সেটি করতে গেলে ‍দুটো জিনিস দরকার – এক. পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন এবং দুই. রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সমন্বয় রেখে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের অবস্থান বিবেচনা করে পাঠ্যপুস্তকের সঠিক আধেয় নির্ধারণ৷

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে যতবারই পাঠ্যপুস্তক প্রনয়ণে গঠিত কমিটিগুলো যথাযথ বিবেচনায় করা হয়েছে কী না সে প্রশ্ন সহজেই তোলা যায়৷ পাঠ্যপুস্তক সংশোধন, সংস্কার ও পরিমার্জন কমিটিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় দরকার৷ এ ধরনের কমিটিতে অবশ্যই শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী ও শিশুবিদ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞসহ শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি রাখা উচিত৷ সাথে সাথে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট গবেষণা কাজের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের সাহায্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন নিয়ে সামগ্রিক পরিসরে একটি গবেষণা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে৷ স্বাধীনতার পর থেকে পাঠ্যপুস্তকে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, তার কারণ ও প্রভাব নির্ণয়ে এ গবেষণা অত্যন্ত জরুরি৷ এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের অনেক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে৷ সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন আনার চেষ্টা হলে তা যৌক্তিক হবে৷

পাঠ্যপুস্তকের আধেয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, পাঠ্যপুস্তক কোনো দল, গোষ্ঠী বা ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের জায়গা নয়৷ এটি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নির্ধারণে হাতিয়ার৷ তাদেরকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রধান ভিত্তি৷ কিন্তু ধর্মীয়, দলীয় ও রাজনৈতিক চাপে বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে পাঠ্যপুস্তকের ভয়াবহ সর্বনাশ করা হয়েছে৷ রাজনৈতিক চাপে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যেমন বিভাজন তৈরি হয়েছে তেমনি হতাশাও দেখা দিয়েছে৷ ক্ষমতাসীনরা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে বারবারই ধর্মীয় দলগুলোর হুমকিকে যেভাবে মাথা পেতে নিচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে আদৌ সংবেদনশীল ও আধুনিক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন সম্ভব হবে কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে৷ পাঠ্যপুস্তকের আধেয় নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সমাজে বিদ্যমান সব ধর্ম, মানবিক মূল্যবোধ সবকিছুকে বিবেচনায় নিতে হবে৷ মনে রাখতে হবে, পরিপাকশক্তি ময়রার দোকানে তৈরি হয় না, খাদ্যেই তৈরি হয়৷ তাই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে কী দিচ্ছেন তা নিয়ে না ভেবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক চাপের কথা ভাবলে শিক্ষার্থীদের যে বদহজম হবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান