‘শিক্ষা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতা’

ডয়চে ভেলে: পাঠ্য পুস্তক সংশোধন কমিটি দুই সপ্তাহের মাথায় দাবির মুখে বাতিল করা হলো৷ এটাকে কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমি একটা কথা বলতে চাই।  প্রথমত, আমি মনে হয় বেশি বয়স্ক হয়ে গেছি। এখন নতুন অর্ডার, যেখানে ছাত্ররা শিক্ষকদের শিখায়। তাদেরকে ওঠবস করায়।  তাদেরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। এটা  একটা অন্য অর্ডার।

একটি কমিটি করে আবার বাতিল করা- এটা কেন ঘটে?

আমরা যখন একটা সিদ্ধান্ত নিই এবং অল্পবিস্তর চাপে পড়ে বাতিল করি, এর অর্থ হলো আমাদের কমিটমেন্ট ওই রকম না। এবং আমরা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না। ডান-বাম থেকে চাপ আসবে আর সাথে সাথে সেই চাপে আগের সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেবো, এর ফলে ভবিষ্যতে এরকম আরো চাপ আসবে। কোনো কাজই আমরা ঠিকমতো করতে পারবো না। এখন হেফাজত বলবে, বিএনপি বলবে, জাতীয় পার্টি বলবে, জামায়াতে ইসলামী বলবে আর আপনি সবার কথা শুনবেন- সেটা তো হয় না। কোনো কাজ করার আগে অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনাদের মুরোদে যদি না কুলায়, অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের পরামর্শ নিতে হবে।

আমাদের পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে যুগোপযোগী করা যায়?

আসলে আমরা শিক্ষাকে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। যদি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম, তাহলে আমরা সে ব্যাপারে চিন্তা করতাম, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতাম। আসলে আমাদের ওপর যখন চাপ আসে, তখন আমরা একটা কিছু করি। আবার যখন নতুন চাপ আসে, তখন সমানে বাতিল করি। এভাবে চলতে পারে না। আমাদের উচিত হবে জাতীয়ভিত্তিক কাজ করা। সবাইকে নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে, ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে এটা করা দরকার। সময়ের সঙ্গে আমাদের পরিবর্তন করতে হবে, সংস্কার করতে হবে। আর সেজন্য শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানী, অংশীজন তাদের সহায়তায় কাজ করতে হবে।

সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা পাঠ্যক্রম তৈরি করতে আসলে কী প্রয়োজন?

আমাদের এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে একমাত্র যে সম্পদ আছে, তা হলো মানব সম্পদ। এটাকে আসলেই সম্পদে পরিণত তখনই করা যাবে, যখন এদেরকে আমরা শিক্ষা-দীক্ষায় বলীয়ান করবো। জাপান, তাইওয়ান বা কোরিয়ার মতো। এগুলো আমাদের মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। কমিটমেন্ট থাকতে হবে। কিন্তু সেই কমিটমেন্টের অনেক অভাব।

আমাদের দেশে কি যথেষ্ট শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নেই এটা করার জন্য? আমাদের কি দেশের বাইরে থেকে ভাড়া করে আনতে হবে?

আমাদের দেশে অনেক যোগ্য মানুষ আছেন। তারা এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এখন আমরা যদি মনে করি প্রেসার গ্রুপের কথায় কাজ করবো, প্রেসার গ্রুপ দিয়ে কাজ করাবো, তাহলে তো হবে না। শিক্ষায় যারা দক্ষ, অভিজ্ঞ, তাদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। তাদের কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রেসার গ্রুপের কাছে যদি আমরা নতি স্বীকার করি, তাহলে নতুন নতুন প্রেসার গ্রুপ তৈরি হবে।

এই বারবার পরিবর্তনে কি শিক্ষার ভালো হচ্ছে?

এটা ছাত্ররাও জানে। তারাও জানে যে, এখানে শিক্ষা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিছু দিন আগেও তো আমরা স্লোগান দিয়েছি যে , শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। এখন সেটা গেল কোথায়? এখন আবার নতুন কথা। এর মানে হলো শিক্ষা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতা।

এতে আমাদের শিক্ষার্থীদের কী ক্ষতি হচ্ছে?

এখানে শিক্ষা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। যোগ-বিয়োগও পরিবর্তন হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরাও এটা জানে। তারাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

এখন তো হেফাজত একটা দাবি করছে। জাময়াতেরও দাবি আছে। আবার শিক্ষাবিদকে ‘ধর্মবিদ্বেষী' ট্যাগ দেয়া হচ্ছে।

আমাদের দেখতে হবে সৌদি আরবের শিক্ষা ব্যবস্থা। তারা কীভাবে করে? সৌদি আরবে ছুটির দিন রবিববার আর আমাদের শুক্রবার। আরো অনেক মুসলিম দেশ আছে তারা কীভাবে করে? এগুলো ধরে টান দিতে হবে। উই আর মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ।

বিজ্ঞান বইতে কী থাকবে না থাকবে, ইতিহাস বইয়ে কী থাকবে না থাকবে- সে ব্যাপারে যদি বাইরে থেকে চাপ দেয়া হয়, তাহলে কী হবে?

এগুলো সমন্বিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। অন্যান্য দেশ শিক্ষার ক্ষেত্রে কী করে তার তথ্য আমাদের বের করতে হবে। সেই তথ্য দিয়ে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। উন্নত মুসলিম দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তথ্য বের করে জানাতে হবে। বলতে হবে, ‘‘দেখ, ইউ আর মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ।''

আপনি শুরুতেই বলছিলেন এখন শিক্ষার্থীরাই ঠিক করছে কে শিক্ষক হবে। পড়াশুনা কেমন হবে? এর পরিণতি কী হবে?

একটা বড় পরিবর্তনের পর এই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলো আমাদের সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। এর আগে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর  কি শিক্ষকদের এভাবে নামানো হয়েছে? আমি তো তখন ছিলাম। নামানো তো হয়নি।  কোনটা থাকবে না থাকবে এটার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। তারা এটা দেখবে। সাহসের সঙ্গে এটা আমাদের বলতে হবে।