1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্যবাংলাদেশ

সরকারি হাসপাতালে ‘প্রাইভেট চেম্বার’: ফলে সন্দিহান চিকিৎসকরাই

হারুন উর রশীদ স্বপন
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বুধবার থেকে সরকারি হাসপাতালেই অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন চিকিৎসকরা৷ এজন্য সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফি ধার্য করে একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4Nzva
নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফিতে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন চিকিৎসকরা
নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফিতে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন চিকিৎসকরা (ফাইল ছবি)ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Zuma/picture alliance

সরকারি হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ বা রোগী দেখার প্রবণতা কমাতে এই সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার৷ এতে রোগী ও চিকিৎসক দুই পক্ষই উপকৃত হবে এমনটাই সরকারের দিক থেকে ভাবা হয়েছে৷ তবে হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্রাকটিস’ কমবে কিনা, বেসরকারি ক্লিনিক বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ডাক্তার দেখানোর উচ্চ ফি থেকে রোগীরা মুক্তি পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ সরকারি হাসপাতালে যে অবকাঠামো, চিকিৎসক ও নার্স আছে তাতে এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের৷

যা থাকবে এই ব্যবস্থায়

চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালেই ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন৷ হাসপাতালে তাদের নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফি তারা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিবেন৷ এজন্য সময় দেয়া হচ্ছে দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত৷ সেবা পেতে রোগীকে টিকিট কাটতে হবে৷  ফির একটি অংশ চিকিৎসকের সহায়তাকারী ও হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ পাবে৷

সিনিয়র চিকিৎসকের ৩০০ টাকা ফির মধ্যে তার সহায়তাকারী পাবেন ৫০ টাকা৷ বাকি ৫০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা পড়বে৷ জুনিয়র চিকিৎসকের ১৫০ ফির মধ্যে সহায়তাকারী পাবেন ২৫ টাকা৷ বাকি ২৫ টাকা যাবে সরকারি তহবিলে৷

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে উপজেলা পর্যায়ে ৫০টি, জেলা পর্যায়ে ২০টি, বিভাগীয় পর্যায়ে আটটি ও বিশেষায়িত পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট চেম্বার’ চালু হবে৷ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ঠিক করা হবে রোগীর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে৷ যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আসেন, সেখানে এ সেবা চালু করা হবে৷ আগামী আগস্টের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ‘প্রাইভেট চেম্বার' চালুর পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়৷

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, চিকিৎসকেরা পালা করে রোগী দেখবেন৷ একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুই দিন, সহযোগী অধ্যাপক দুই দিন, সহকারী অধ্যাপক দুই দিন রোগী দেখবেন৷ চিকিৎসক যদি রোগীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, রোগী চাইলে তা সরকারি হাসপাতালে করতে পারবেন৷ আবার বেসরকারি হাসপাতালেও করতে পারবেন৷

‘তদারকি না হলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যহত হতে পারে’

সরকারি হাসপাতালের প্রাইভেট চেম্বারে কী কী সেবা দেওয়া হবে, তা খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে৷ এতে বলা হয়েছে, কনসালটেশন, ডায়াগনস্টিক, ল্যাবরেটরি, রেডিওলজি, ইমেজিং ও সার্জিক্যাল সেবা দেওয়া হবে৷

উদাহরণ বিএসএমএমইউ

২০১১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ২৬ বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা কর্মঘণ্টা শেষে এই পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন৷ এজন্য দুপুর আড়াইটা থেকে বহির্বিভাগের বিশেষ সেবার টিকেট বিক্রি শুরু হয়৷ বিএসএমএমইউতে দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের বহির্বিভাগে পালা করে রোগী দেখতে হয়৷ রোগী প্রতি ফি ২০০ টাকা৷ এর মধ্যে ১৩৫ টাকা পান চিকিৎসক, বাকি ৬৫ টাকা পান কর্মচারীরা৷ বারডেম হাসপাতালও একই পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে৷

বিএসএমএমইউর সাকে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এটা আমরা নিজেরাই বিএসএমইউতে করে ভালো ফল পেয়েছি৷ কিন্তু এটা একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল৷ কোনো সমস্যা হলে আমরা নিজেরাই ঠিক করতে পেরেছি৷ আমাদের চিন্তা ছিল যেহেতু এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, রোগ নির্ণয়ের সব সুবিধা আছে তাই তার সর্বোত্তম ব্যবহার করা৷ আমরা রোস্টার করে দিয়েছি কোন চিকিৎসক হাসপাতালে সপ্তাহে কতদিন প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন৷ যাতে সবাই এটা করতে বাধ্য থাকেন৷ ফলে কম খরচে সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত হয়৷ কিন্তু অন্যান্য হাসপাতালে এটা কার্যকর করতে নিবিড় তদারকির দরকার হবে৷”

তারা কথা, ‘‘নিবিড় তদারকি করা না হলে সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে সাধারণ মানুষ যে চিকিৎসা সেবা পায় তা ব্যহত হতে পারে৷’’

বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধার তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি
বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধার তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশিছবি: bdnews24.com/ M. Zaman Ovi

সম্ভাবনা আশঙ্কা

রোগীরা বলছেন,এই ব্যবস্থা চালু হলে ভালো হবে বলেই মনে হয়৷ বেসরকারি হাসপাতালে যে ‘গলাকাটা ফি' নেয়া হয় তা থেকে সাধারণ মানুষ রেহাই পাবেন৷ তবে চিকিৎসকরা যদি এটাকেও সরকারি সেবার মতো করে ফেলেন তাহলে তো লাভ নেই৷ মিরপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন, ‘‘সরকারি হাসপতালে তো আউটডোরের টিকিট কেটে বিনামূল্যে ডাক্তার দেখানো যায়৷ বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা আছে কিছুটা৷ কিন্তু এই ব্যবস্থায় তো কম হলেও টাকা লাগবে৷ তাতে গরীব মানুষের কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ অনেকের ওই টাকা দেয়ার সক্ষমতাও নেই৷”

এই সুযোগে চিকিৎসকরা তাদের কর্মঘণ্টার সময়ই সরকারি হাসপাতালকে ‘প্রাইভেট চেম্বার' হিসেবে ব্যবহার করেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা কলাবাগানের রিকশা চালক হামিদুর রহমানের৷ তেমনটা হলে বিনামূল্যে আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর যে সুযোগ এখন আছে তাও আর থাকবে না বলে মনে করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘৩০০ টাকা ফি নিয়ে ডাক্তার যদি আবার সরকারি হাসপাতালের মতোই আচরণ করেন তাহলে লাভ কী?”

সাধারণত সুচিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন হয়৷ দেশে এ জনবল নেই বললেই চলে৷ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা অবকাঠামোর তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি৷ বারান্দায়ও রোগী রেখে চিকিৎসা দিতে হয়৷

সুফল নির্ভর করছে...

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ২২ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে৷ তবু প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান৷ সরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসার অভাব এবং বেসরকারি হাসপাতালে অত্যধিক খরচের কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে৷

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে দেখা যাক এর ফলাফল কেমন হয়৷ বিএসএমএমইউর মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো, চিকিৎসক, নার্স আছে সেখানে সফল হতে পারে৷ কিন্তু অন্য হাসপাতালে কেমন হবে তা দেখতে হবে৷ শুরু হোক তারপর দেখা যাক কতটা সুফল পাওয়া যায়৷”

‘হাসপাতালের অবকাঠামোর সমস্যার দায় চিকিৎসকদের ওপরই পড়বে’

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে অনেক চিকিৎসকের পদ খালি৷ হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো ও রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়৷ যদি এগুলো ঠিকমতো থাকতো তাহলে হয়তো এখনই এর সুফল সম্পর্কে বলা যেত৷”

তার মতে, ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমনিতেই রোগীদের দীর্ঘ লাইন থাকে৷ বিকালে আবার প্রাইভেট প্রাকটিসে লাইন ধরে সেই সুবিধা নিতে রোগীরা উৎসাহিত হবেন কিনা বা  টাকা দিয়ে যে সেবা তারা পেতে চান তা পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে৷

তিনি মনে করেন, ‘‘সরকারি হাসপতালে এই ব্যবস্থা চালুর পর বাইরে ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ বন্ধ হলে একরকম ফল পাওয়া যেত৷ কিন্তু দেশে তো বেসরকারি হাসপাতাল আছে৷ সেখানেও ফি বেধে দেয়া থাকলেও তা অনেকেই মানছেন না৷ আবার কোনো সমস্যা হলে তার দায় পড়ে চিকিৎসকদের ওপর৷ সরকারি হাসপাতালে অবকাঠামোর সমস্যা, রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার অপ্রতুলতার দায় চিকিৎসকদের ওপরই পড়বে৷ কিন্তু এটাতো আলাদা প্রশাসনের কাজ৷ রোগীদের ব্যবস্থাপত্র তারা দেবেন৷ কিন্তু টেস্টসহ অন্যান্য বিষয়ের কী হবে?”

তবে এটি সরকারের ভালো উদ্যোগ বলেই মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক৷ সুফল পেতে মনিটরিং এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেন তিনি৷

এসব নিয়ে কথা বলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি৷ তবে জানা গেছে, দেশের সব হাসপাতালে একসঙ্গে নয়, পর্যায়ক্রমে এই ব্যবস্থা চালু করা হবে৷ সিভিল সার্জনরা তা মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করবেন৷ সেই সঙ্গে যেভাবে সময় নির্ধারণ করা হবে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা তা মেনেই প্রাইভেট প্রাকটিসে বাধ্য থাকবেন৷ যে হাসাপতালে রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে তার সুবিধা রোগীরা পাবেন৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান