1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সমাজের অভিভাবকরাই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছেন

১৩ আগস্ট ২০২১

ধর্মীয় উন্মাদনার ভিডিও যারা ভাইরাল করছে, তারা উলু-খাগরা। সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দিচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক আবহ।

https://p.dw.com/p/3ywFZ
মোদী-যোগী
ছবি: Altaf Qadri/AP Photo/picture alliance

কয়েক বছর আগে দিল্লির অদূরে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল মহম্মদ আকলাখকে। ফ্রিজে গরুর মাংস আছে, এই সন্দেহে। গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল সেই ঘটনার পরে। বহু আলোচনা, বহু লেখালেখি, বহু আন্দোলন। তারপর সময়ের নিয়মেই সেই ঘটনা পিছনে চলে গেছে। এবং ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে সাম্প্রদায়িক মার-দাঙ্গার বিষয়টি।

দাদরির পর উত্তর ভারত জুড়ে অসংখ্য দাদরি হয়েছে। কোথাও মুসলিম বৃদ্ধের দাড়ি কেটে নেওয়া হয়েছে। কোথাও পেটানো হয়েছে গাছে বেঁধে। কোথাও খুন করা হয়েছে। ভাইরাল ভিডিও-তে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি উঠেছে। মুসলিম ব্যক্তিকে বলতে বাধ্য করা হয়েছে সেই স্লোগান। একের পর এক এমন ঘটনা কার্যত স্বাভাবিক হয়ে গেছে এখন। তাই বৃহস্পতিবার কানপুরে যা ঘটেছে, তা নিয়ে এখন আর তেমন কারও মাথা ব্যথা নেই। এক মাঝবয়সি মুসলিম ব্যক্তিকে মেয়ের সামনে মারা হয়েছে কানপুরে। মেরেছে বজরং দলের কর্মীরা। পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করার পরে বজরং সমর্থকরা থানা ঘেরাও করে। ভিডিও-তে নয় জনের ছবি দেখা গেলেও সকলকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

একটু প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। বাম আমলের পশ্চিমবঙ্গে ছেলেবেলা কেটেছে। বামেদের অসংখ্য ভুলের মাসুল এখনো দিতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের দুইটি প্রজন্মকে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িকতা রোখার প্রশ্নে বামেরা যে ভূমিকা রেখেছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। মনে পড়ে, ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংসের পরে গোটা দেশে যখন দাঙ্গার আগুন জ্বলছে, পশ্চিমবঙ্গ তখন সম্প্রীতির উদাহরণ তৈরি করেছিল। ধর্মীয় উসকানির সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও কড়া ব্যবস্থা নিত প্রশাসন। ধর্মনিরপেক্ষতার একটা ডিসিপ্লিন বা নিয়মানুবর্তিতা তৈরি হয়েছিল সমাজে। সে কারণেই গুজরাত দাঙ্গায় সব হারিয়ে কুতুবুদ্দিন পশ্চিমবঙ্গে এসে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল। গোটা দেশ জানতো, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালায় অনেক সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষ নেই।

এই বাতাবরণ তৈরির কাজটা আসলে অভিভাবকের। একটি রাজ্যের অভিভাবক তার শাসক এবং বিশিষ্টজনেরা। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার সেই বীজটি পুঁতে দিতে পেরেছিলেন সেখানকার অভিভাবকরা।

বর্তমান ভারতের যারা অভিভাবক, তারা ঠিক তার উল্টো কাজটি করছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্র থেকে সরতে সরতে তারা এক অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করে ফেলেছেন। ধর্মের নামে এখানে লাভ জিহাদ বিল হয়। ধর্মের নামে তৈরি করা হয় নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী খুল্লামখুল্লা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন। অভিভাবকের আচরণ যখন এমন হয়, তখন তার সন্তানদের পক্ষে যা করা সম্ভব, গোটা উত্তর ভারত জুড়ে ঠিক সেই ঘটনাই ঘটছে। আইন হাতে তুলে নিয়ে ধর্মের জিগির তুলে রাস্তায় নেমে পড়েছে ধর্মোন্মাদের দল। তারা মারধর করছে, খুন করছে, তার ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করছে। ভয়ডর পর্যন্ত নেই।

কেন ভয় পাচ্ছে তারা? দেশে কি তাদের শাস্তি দেওয়ার মতো আইন নেই? অবশ্যই আছে। কঠিন শাস্তি হতে পারে এই ধর্মোন্মাদদের। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাতে উল্লেখ করা আছে যে দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ। এ দেশে ধর্মের নামে উসকানি ছড়ালে কড়া শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু সেই আইন তখনই প্রয়োগ করা যায়, পুলিশ যখন সেই মোতাবেক চার্জশিট সাজায়। যে পশ্চিমবঙ্গের কথা একটু আগে হচ্ছিল, সেখানে পুলিশ ঠিক সেই কাজটিই করতো। কিন্তু উত্তর ভারতের বহু জায়গায় পুলিশ সেই কাজটি করছে বলে মনে হচ্ছে না। লঘু ধারায় চার্জশিট বানিয়ে তারা অপরাধীদের জামিনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। পুলিশ এ কাজ করছে কারণ, তাদের উপর রাজনৈতিক চাপ আছে। আইন যদি ব্যবহারই করা না হয়, তাহলে অপরাধীর শাস্তি হবে কী ভাবে? কীভাবে সভ্য হবে সমাজ?

স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। সমাজের অভিভাবকরা যখন বেপথে চলে যান, তখন বিরোধীদের উপর কিছু দায়িত্ব বর্তায়। আজ যে বিরোধী, কাল সেই অভিভাবক হতে পারে। ধর্ম নিয়ে যে সংকীর্ণ রাজনীতি চলছে এখন ভারতে, বিরোধীরা তার উল্টো দিকে ঢাল তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে তারা তা করছেন না। ধর্মোন্মাদ মানুষের মন পেতে তারাও ধর্মের তাস খেলছেন। ফলে সার্বিক ভাবে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সমাজ। একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটেই চলেছে।

এখনো রাস্তা খোলা আছে। এখনো যদি সমাজের অভিভাবক স্থানীয়রা চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন, হয়তো এই উন্মাদনা কিছুটা হলেও বাগে আনা যাবে। ঢাল তৈরি করতে হবে। করতেই হবে।