1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সবকিছুই লটারি নয়

রাহেনুর ইসলাম ঢাকা
২০ জুলাই ২০২৪

পেনাল্টি মানেই লটারি! যুগ যুগ ধরে ধারণাটা এমনই ছিল৷ কোন ফুটবলার শট নেবেন ১২ গজ থেকে আর গোলরক্ষক ডাইভ দিবেন একটা প্রান্ত বেছে নিয়ে৷ শটটা সেই প্রান্তে গেলে কপাল খুলবে গোলরক্ষকের আর পুড়বে শট নেওয়া খেলোয়াড়টির৷

https://p.dw.com/p/4iXCy
আফগান ক্রিকেটার রশিদ খান
কঠোর অনুশীলনের ফল রশিদ খান দেখিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে৷ছবি: Avijit Das/ZUMAPRESS.com/picture alliance

সেই লটারিতে বারবার কপাল পুড়েছে ইংল্যান্ডের৷ ১৯৯০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল থেকে ২০২০ ইউরো পর্যন্ত ৯টি মর্যাদার টুর্নামেন্টের টাইব্রেকারে সাত বারই হেরেছে ইংল্যান্ড৷ তাই ভাগ্যে বিশ্বাস না করে পেনাল্টি নিয়ে বিশেষ অনুশীলন শুরু করে তারা৷ পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে তৈরি করে একটি দল৷

 নরওয়ের ক্রীড়া মনোবিদ গিয়ার জরডেটেডের দর্শন নিয়ে কাজ করেছে এই দল৷ ‘পেনাল্টি প্রফেসর'খ্যাত জরডেট নিজের বইয়ে লিখেছিলেন, ‘‘পেনাল্টি হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপার৷ বিপক্ষকে যারা বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তাদের সাফল্যের হারটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷''

এই দর্শনে এবারের ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে সফল ইংল্যান্ড৷ সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তারা জিতেছে ৫-৩ ব্যবধানে৷ ইংলিশরা নিয়ন্ত্রণ করেছে কীভাবে? রেফারির বাঁশি বাজার পর পাঁচটা শট নিতে ইংলিশ ফুটবলাররা গড়ে সময় নিয়েছেন ৫ দশমিক ২ সেকেন্ড৷ তাতে গোলরক্ষককে অপেক্ষা করিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে তারা৷ বিপরীতে সুইজারল্যান্ডের খেলোয়াড়রা গড়ে শট নিয়েছেন ১ দশমিক ৩ সেকেন্ড৷

ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড প্রথম শটটাই ফিরিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের মানুয়েল আকাঞ্জির৷ এই একটা সেভই গড়ে দিয়েছে ম্যাচের ভাগ্য৷ লটারির মত বাম দিকে ডাইভ দিয়ে পেনাল্টি ঠেকাননি পিকফোর্ড৷ তার পানির বোতলে লেখাই ছিল সুইজারল্যান্ডের কোন খেলোয়াড় কোন দিক দিয়ে পেনাল্টি নিতে পারে৷ এটা গবেষণা করে বের করেছিলেন ইংলিশ সেই পাঁচ বিশেষজ্ঞের পেনাল্টি দল৷

এ নিয়ে মর্যাদার টুর্নামেন্টে ১৪টি পেনাল্টি শটের ৪টিই ফিরিয়েছেন পিকফোর্ড, অথচ ১৯৯০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ইংলিশ গোলরক্ষকরা ৩৬ পেনাল্টির ফিরিয়েছিলেন কেবল দুটি৷ তাদের দ্বিগুণ সেভ পিকফোর্ড করতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আর কঠোর অনুশীলনে৷

পেনাল্টিতে সময়ের সেরা মানা হয় আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে৷ ২০২২ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডস আর ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে জয়ের নায়ক তিনি৷ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে করেছিলেন দুটি সেভ৷ ফ্রান্সের বিপক্ষে সেভ একটি আর অপরটি বাইরে মেরেছিলেন অরেলিঁও চুয়ামেনি৷

ইউরো কাপে পর্তুগাল বনাম স্লোভেনিয়া ম্যাচ
রোনাল্ডোর পেনাল্টি আটকে দেন স্লোভেনীয় গোলকিপার ওব্লাকছবি: Lars Baron/Getty Images

এবারের কোপা আমেরিকাতেও কোয়ার্টার ফাইনালে ইকুয়েডরের বিপক্ষে টাইব্রেকারে করেছেন দুটি সেভ৷ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মার্তিনেজ পোস্টে থাকলে ৫০ শতাংশ পেনাল্টি মিস করেছে বিপক্ষ দল৷ মোট ২৪টি পেনাল্টির ৯টি ঠেকিয়েছেন মার্তিনেজ আর ৩টি পোস্টে বা বাইরে মেরে নষ্ট করেছে প্রতিপক্ষ৷

অ্যাস্টন ভিলাকে চ্যাম্পিয়নস লিগে নেওয়ার পথেও প্রিমিয়ার লিগে একাধিক পেনাল্টি সেভ করেছেন মার্তিনেজ৷ এর রহস্যটা কী? আর্জেন্টিনা বা অ্যাস্টন ভিলায় কী আলাদা কোনো পেনাল্টি বিশেষজ্ঞ আছে? মার্তিনেজ ২০২১ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ব্রুনো ফের্নান্দেসের পেনাল্টি ঠেকিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যারা পেনাল্টি নেয় তাদের মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করি৷ বিশৃঙ্খলাও করি এজন্য৷ ফের্নান্দেসকে সেবার বলেছিলাম, তুমি নও পেনাল্টিটা নেওয়া উচিত ছিল ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর (রোনালদো তখন ম্যানইউতে খেলতেন)৷ তাতেই ভড়কে গিয়ে পেনাল্টি মিস করে ও৷''

প্রায় সব পেনাল্টির সময় এভাবে কথা বলেন মার্তিনেজ৷ কখনও সরিয়ে দেন বল৷ কখনও লাইনের মাঝে নেচে চেষ্টা করেন প্রতিপক্ষের মনোযোগ নষ্ট করার৷

এই বুদ্ধিটা নাকি লিওনেল মেসি দিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন মার্তিনেজ, ‘‘মেসিই বলেছিল যারা পেনাল্টি নিতে আসে তারা একটা প্রান্ত বেছে নেয় আগে থেকে৷ তাই নাচানাচি করলে মনোযোগ নষ্ট হয়, আমিও সেটা মেনে সাফল্য পেয়েছি৷ তবে হ্যাঁ, কঠোর অনুশীলনের বিকল্প নেই৷ আর্জেন্টিনায় আমাদের খেলোয়াড়রাও পেনাল্টি নিয়ে দীর্ঘ অনুশীলন করে৷''

৪-২ গোলে পরাজয়ের পর হতাশ লিওনেল মেসি
২০১৬ সালে চিলের কাছে পেনাল্টিতে পরাজিত হয়েছিল আর্জেন্টিনাছবি: Julio Cortez/AP Photo/picture alliance

এমন কঠোর অনুশীলনের ফল সূর্যকুমার যাদব পেয়েছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে৷ জয়ের জন্য শেষ ওভারে প্রোটিয়াদের দরকার ১৬ রান৷ প্রথম বলটাই তুলে মেরেছিলেন ডেভিড মিলার, যা ছক্কা হলের ম্যাচের রং বদলে যেতে পারত৷ কিন্তু অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় বলটা শুরুতে বাউন্ডারি লাইন থেকে ফিরিয়ে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ধরেন সূর্যকুমার৷

এমন চাপের মুহূর্তে কীভাবে সম্ভব হলো এই ক্যাচ নেওয়া৷ম্যাচ শেষে সূর্যকুমার জানিয়েছেন, ‘‘যখন বলটা প্রথমবার হাতে ধরেছিলাম, তখন ভাবছিলাম রোহিতের দিকে ছুড়ে মারব৷ তবে অনেক দূরে ছিল রোহিত৷ তাই নিজেই দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় ধরব ভেবেছিলাম৷ এ ধরনের ক্যাচ এর আগে অনুশীলনে অনেকবার নিয়েছি৷ তাই অসুবিধে হয়নি৷''

সূর্যকুমারের এই কথার সুর ধরে ভারতের বিদায়ী কোচ রাহুল দ্রাবিড় জানিয়েছিলেন, ‘‘এমন ক্যাচ সূর্য অন্তত ১৫০-১৬০টি নিয়েছে অনুশীলনে৷ আইপিএল থেকে ফেরার পরই এমন ক্যাচ বারবার নিয়েছে অনুশীলনে৷''

পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান আসিফ আলী তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে মেরেছেন ২৯৩টি ছক্কা৷ শেষ দিকে কয়েক ওভার ব্যাট করে ম্যাচের রং বদলে দিতে জুড়ি নেই তার৷ পিসিবিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজের ছক্কা মারার ক্ষমতা নিয়ে আসিফ জানিয়েছিলেন, ‘‘যে পজিশনে ব্যাট করি, সেখানে সাধারণত ওভারে গড়ে ১০ রান করে দরকার হয়৷ তাই বিগ-হিটিং ব্যাটিংয়ের জন্য আমি সাধারণত প্রতিদিন ১০০-১৫০টি ছক্কা মারার অনুশীলন করি, যেন ম্যাচে ৪-৫টি মারতে পারি৷''

পাওয়ার-হিটিংয়ে টেপ টেনিস ক্রিকেটের অবদানের কথাও বলেছেন আসিফ আলী, ‘‘টেপ টেনিসে মাথা শক্ত রেখে সোজা ব্যাটে ব্যাট করতে হয়, যেটায় মনোযোগ বাড়ে৷ এ ছাড়াও ওভার কম থাকায় অনেক বড় লক্ষ্য তাড়া করতে হয়৷ এখনো সময় পেলে টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলি৷''

আফগানিস্তানের প্রায় সব ক্রিকেটার বেড়ে উঠেছেন টেপ টেনিস খেলে৷ পাওয়ার হিটিংয়ে এটা সাহায্য করেছে তাদের৷ তাছাড়া  আফগান ক্রিকেটারদের বেশিরভাগ থাকেন দুবাইয়ে৷ জাতীয় দলের অনেক তারকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেলেন বিশ্বের সেরা সব ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে৷ সেখানে অনুশীলনের উন্নত সুযোগ পাওয়াতেই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালার দেশ'৷

গত আইপিএলে রশিদ খান ছিলেন গুজরাট টাইটানসে৷ সেখানে দিনে অন্তত ২০-২৫টি ‘নো লুক' শটের অনুশীলন করতেন তিনি৷ এ বছরের মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে নো লুক শটের ছক্কায় সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন রশিদ৷

একইভাবে এবারের ইউরোয় ইংল্যান্ডের ইভান টনি পেনাল্টি মেরেছেন নো লুক শটে! সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তার নেওয়া চতুর্থ শটটা জালে জড়ানোর পরই ধারাভাষ্যকার চিৎকার করে উঠেন, ‘‘এটা পাগলামি''৷

সেই পাগলামি যে এমনিতে হয়নি, ম্যাচ শেষে বলেছিলেন টনি, ‘‘নো লুক পেনাল্টি শটের টানা অনুশীলন করেছি আমি৷ ইউরোয় গোল পেয়ে ভালো লাগছে৷''

যুগে যুগে এই যে বিবর্তন, এসব মোটেও লটারি নয়৷ কঠোর অনুশীলনের ফল৷ এমিলিয়ানো মার্তিনেজ, রশিদ খান কিংবা ইভান টনিরা শুধু দেখিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে৷

রাহেনুর ইসলাম সাংবাদিক