1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘সমাজের অন্য জায়গায়ও শিষ্টাচারের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
১০ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ শিষ্টাচারকে কতটা গুরুত্ব দেন? ডা. মুরাদ হাসান এবং মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের সাম্প্রতিক বক্তব্য এ প্রশ্নকে বড় করে তুলেছে৷

https://p.dw.com/p/446Af
Bangladesch Studenten Proteste in Dhaka
ফাইল ছবিছবি: Nasirul Islam

সার্বিক বিষয়টি নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ৷

ডয়চে ভেলে : বর্তমান সময়ের রাজনীতিকরা কতটা শিষ্টাচার মেনে চলছেন?

মহিউদ্দিন আহমদ : আদৌ মানছেন কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন৷ কারণ, অহরহ তারা যেসব কথা বলেন প্রকাশ্যে এগুলো পরিবারের সবাইকে নিয়ে শোনাটাও একটা সমস্যা৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তারা যে ভাষায় গালাগাল করেন, গণমাধ্যমে আমরা যেটা দেখি, তা শুনতেই আমাদের লজ্জা হয়৷ আমরা এমন একটা দেশে বাস করি, আমাদের নেতারা এই ভাষায় কথা বলেন৷

রাজনীতিবিদদের মধ্যে কী ধরনের শিষ্টাচারের ঘাটতি দেখেন?

মানুষকে সম্মান না দেখানো, রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকলেই যে তাকে গালাগালি করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই৷ আমি যদি কোনো একটি দলের সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামি, তাহলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হবে রাজনৈতিক কর্মসূচী৷ জনগণের সামনে আমি ওটাই তুলে ধরবো যে, আমাদের প্রতিপক্ষের কর্মসূচির চেয়ে আমাদের কর্মসূচিটা এই এই কারণে ভালো৷ সুরাতাং আপনারা আমাদের সমর্থন করুন৷ সমালোচনার ক্ষেত্রে তো আমি রাজনীতি খুব একটা দেখি না৷ বরং ব্যক্তিগত গালাগাল, আক্রোশ, চরিত্র হনন এগুলোই হচ্ছে বেশি৷ এগুলো সবসময়ই ছিল৷ আগেও ছিল, এখন বেড়েছে৷ আগে গণমাধ্যম এত শক্তিশালী ছিল না বলে আমরা শুনতাম না৷ প্রচার পেতো না৷ এখন যেহেতু গণমাধ্যম সর্বব্যাপী এবং অনেক কিছু গণমাধ্যমে না এলে ফেসবুক, ইউটিউবের কল্যাণে আমরা জেনে যাই৷ ফলে অবস্থাটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে৷

আগেও কি রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন শিষ্টাচারের ঘাটতি ছিল?

আগেও ছিল, একটু কম ছিল৷ স্বাধীনতার পর থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতাগুলো অনেক সময় ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে গালাগালিতে নামতো৷ অনেকেই বলতো, টেনে নামাবো, হিঁচড়ে নামাবো, মুজিব তুমি গুন্ডামি ছেড়ে দাও- এই সমস্ত শ্লোগান তো হয়েছে৷ ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও সব সময় শালীনতা বজাaয় রাখা হয়নি৷ এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজে প্রকাশ্যে পাবলিক মিটিংয়ে বলেছেন, ‘‘লাল ঘোড়া দাবড়ে দেবো৷'' সরকার প্রধানের মুখে এ ধরনের কথা শোভা পায় না৷ এগুলো ছিল৷ কিন্তু এটা আস্তে আস্তে অনেক বেড়েছে৷ তখন তো রাজনৈতিক বিভাজন এতটা ছিল না৷ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল৷ এখন যেহেতু রাজনীতির মাঠে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তারা বেশ শক্ত, এখন আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার চাইতে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে জনগণের সস্তা সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার পথটা বেছে নিয়েছি৷ সব জায়গায় এটা হচ্ছে৷ আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, রাজনীতিবিদ এবং সার্কাসের কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম৷ আমরা মি. বিন বা চার্লি চ্যাপলিনের মতো চমৎকার মানবিক গুণসম্পন্ন কৌতুক অভিনেতা এখন আর দেখি না৷ আমরা দেখি, রাজনীতিবিদরা যে সমস্ত কথাবার্তা বলছেন অত্যন্ত নিম্নমানের, রুচিহীন এবং অনেক কিছু তো ভাষায়ই প্রকাশ করা যায় না৷ দিনের পর দিন তারা এটা বলে যাচ্ছেন৷

রাজনীতিবিদদের শিষ্টাচার কেন প্রয়োজন?

‘রাজনীতিবিদরা বদলে যাচ্ছেন’

শিষ্টাচার সমাজে সবারই প্রয়োজন৷ রাজনীতিবিদরা যেহেতু দাবি করেন, তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সরকার পরিচালনা করছেন, নীতি নির্ধারণ করছেন, ফলে দৃষ্টান্ত তো তাদেরই স্থাপন করতে হবে৷ সাধারণ মানুষ তো তাদের দেখেই শিখবেন৷ আমি যদি একজন ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ হয়ে উষ্কানিমূলক কথাবার্তা বলি, তাহলে আমার যারা ক্যাডার আছে, তৃণমূলে কর্মী আছে, তারা তো তাহলে আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে লাঠালাঠি করবে এবং প্রতিপক্ষকে গালাগাল করবে৷

রাজনীতিকরা শিষ্টাচারবর্জিত হলে সমাজে এর কী প্রভাব পড়ে?

সমাজটা নষ্ট হয়ে যায়৷ আমরা তো এ-ও দেখি, বিশেষ করে ফেসবুকে কেউ শিষ্টাচারবর্জিত কথাবার্তা বললে তার পক্ষে-বিপক্ষে লোক দাঁড়িয়ে যায়৷ যিনি শিষ্টাচারবর্জিত কথাবার্তা বলেন, তার পক্ষেও অনেকে দাঁড়িয়ে যান৷ সাফাই গেয়ে বলেন, ওমুক তো ওই সময় এই কথা বলেছিলেন৷ শিষ্টাচারবর্জিত আচরণ ঠেকানোর জন্য কোনো রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক তৎপরতা আমরা দেখি না৷ বরং আমরা দেখি, একটা সংগঠনে একজন যত বেশি উগ্র কথা বলতে পারে, বেয়াদবি করতে পারে, যত বেশি আক্রমণাত্মক হতে পারে, তখন তার প্রমোশন হয়, সে পুরষ্কৃত হয়৷ এমন বহু উদাহরণ আছে৷

উল্টো উদাহরণও তো আছে৷ ডা. মুরাদ মন্ত্রীসভা থেকে বাদ গেলেন৷ লতিফ সিদ্দিকী বহিস্কার হয়েছিলেন৷ এগুলো কেন বাদ দিচ্ছেন?

লতিফ সিদ্দিকীকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছে সেটা আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবো না৷ তবে সর্বশেষ যেটা হয়েছে এই তথ্য প্রতিমন্ত্রী হুট করে ওইদিন যে এই কথাটা বলেছেন তা তো নয়৷ আমরা তো অহরহ অনেক মন্ত্রীর মুখেই এই ধরনের কথা শুনছি৷ নাম বলছি না, দুই জন মন্ত্রী প্রতিদিন মিডিয়ার সামনে এসে একই কথা বলে যাচ্ছেন৷ এর মধ্যে সারবস্তু কিছু নেই৷ এগুলোকে আমি সমালোচনার বিধির মধ্যেও ধরি না৷ এর মধ্যে গালাগালি থাকে বেশি৷ আমার কাছে আশ্চর্য লাগে- এই লোক কীভাবে প্রতিমন্ত্রী হলেন!

আমাদের রাজনীতি কি রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে? ফলে এ ধরনের সংকট বাড়ছে?

আসলে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে না, বরং রাজনীতিবিদরা বদলে যাচ্ছেন৷ আগে রাজনীতিবিদরা শুধু রাজনীতিই করতেন৷ অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো৷ তারা সহায় সম্পদ বিক্রি করে রাজনীতি করতেন৷ তারা মানুষের উপকারও করতেন৷ এখন একজন রাজনীতিবিদ যখন হাঁটেন, তখন তার আশপাশে ২০-৩০ জন সাঙ্গপাঙ্গ থাকে৷ তার ব্যাগ একজন ক্যারি করে, মোবাইল আরেকজনের হাতে থাকে, দুই-তিনজন গানম্যান থাকে৷ মনে হয় একজন বাদশা যাচ্ছেন৷ এটা সব সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রেই আমরা দেখি৷ রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে এখন নামমাত্র পেশা হিসেবে রেখেছেন, বাস্তবে তারা ব্যবসা করেন৷ ব্যবসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নীতি-নৈতিকতার ধার ধারেন না৷

রাজনীতিকের মধ্যে লেখাপড়া বা পারিবারিক শিক্ষার অভাবের কারণেই কি শিষ্টাচারবর্হিভূত আচরণ করছেন অনেকে?

ওইভাবে ধরে বলা যাবে না৷ তবে শিক্ষা তো আমরা পারিবারিকভাবে প্রথমে পা৷ ইআমি আমার বাবা-মাকে যে ধরনের কথা বলতে শুনি শিশুকালে, সেগুলোই তো আমার মনে গেঁথে যায়৷ আমাদের সমাজে যে নারীবিদ্বেষী মনোভাব বা শিশুদের প্রতি নির্যাতন বা বয়স্কদের প্রতি অবহেলা- এগুলো আমরা ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবারে দেখে অভ্যস্ত৷ আমি যখন বড় হই তখন এটা আমার মধ্যে থাকে৷ 

রাজনৈতিক চর্চা থেকে আমরা কি সরে যাচ্ছি? এর ফলে কি নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে?

রাজনৈতিক চর্চা তো নেই আসলে৷ রাজনীতির কোনো বই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তো কোনো পাঠচক্র হয় না৷ এরা কোনো বই পড়ে না৷ পড়াশোনার চর্চাটা এদের মধ্যে নেই৷ এদের যে ছাত্র সংগঠন তারাও তো পড়াশোনা করে না, বরং লাঠিয়ালি করাই হচ্ছে তাদের কাজ৷ সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা যেখান থেকে আসার কথা ছিল, সেখান থেকে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে না৷ আমি বড় দলগুলোর কথা বলছি৷ তাদের মধ্যে কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা বা পাঠচক্র হয় বলে আমি শুনিনি৷

রাজনীতিকদের শিষ্টাচারবর্জিত আচরণ ভবিষ্যতৎ রাজনীতি এবং নতুন যারা রাজনীতিতে আসছে তাদের মধ্যে কী প্রভাব ফেলবে?

নতুন তো কেউ রাজনীতিতে আসছে না৷ যারা আসছে তারা পুরনো রাজনীতিবিদদের পরিবারের সদস্যরা৷ তাদের অনেকেই মা-বাবা মারা গেলে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হচ্ছেন৷ যারা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ, তারা কেউ তাদের সন্তানদের ছাত্র সংগঠন করার কথা বলেন না৷ তারা রাজনীতি থেকে দূরেই থাকেন৷ এবং তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার নামে বিদেশে পাঠিয়ে দেন৷ পরবর্তীতে তাদের আসনটা শূন্য হলে সেখান থেকে উড়ে এসে তিনি নির্বাচন করেন৷ এমন অনেক উদাহরণ আছে৷

অনেকেই হুট করে রাজনীতিতে এসে অনেক ক্ষমতাধর হয়ে যাচ্ছেন৷ কিন্তু যারা ছাত্র রাজনীতি করে রাজনীতিতে আসেন বা যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন, তাদের মধ্যে কি গুণগত কোনো পার্থক্য আপনি দেখেন?

পার্থক্য তো মূলত একটাই৷ সেটা হচ্ছে, কানেকশন৷ শীর্ষ নেতৃত্ব বা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যোগাযোগ থাকে, তাহলে সেটা হচ্ছে রাজনীতির সবচেয়ে বড় সম্পদ৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে টাকা এবং পেশিশক্তি৷ যারা রাজনীতিতে একেবারে নিঃস্বার্থ কর্মী, তাদের তো এই তিনটার কোনোটাই নেই৷ ফলে অনেকেই বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক, জিন্দাবাদ দিয়ে যাচ্ছেন৷ দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন৷ কিন্তু আখেরে তাকে ওই প্রবোধটুকুই দেওয়া হচ্ছে যে, তুমি তো আদর্শের জন্য রাজনীতি করছো৷ দুধের সরটা তো খেয়ে নিচ্ছে অন্যরা৷

শুধু রাজনীতিক নয়, সমাজের অন্য জায়গাগুলোতে কী শিষ্টাচার দেখেন?

অন্য জায়গায়ও শিষ্টাচারের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ আমাদের চরিত্র গঠনের জন্য পরিবারের বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেখানেও আমরা যা দেখি তা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলি, এখানে শিক্ষক-রাজনীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ছাত্ররা যেমন লাঠালাঠি করে, শিক্ষকরাও তাই করে৷ শিক্ষকদের বিভিন্ন নির্বাচনের আগে তারা যে ধরনের নোংরা কথা বলেন বা চক্রান্ত করেন, তার সবই যদি জনসমক্ষে আসে, তাহলে মানুষ তাদের গায়ে থুথু দেবে৷

কীভাবে আবার রাজনীতিবিদদের মধ্যে শিষ্টাচার ফিরিয়ে আনা যায়?

এটা তো বিচ্ছিন্নভাবে হবে না৷ এটা আসতে হবে পরিবার ও স্কুল কলেজ থেকে৷ শিক্ষক এবং অভিভাকরা যদি যত্নবান হন তাহলে একটা পরিবর্তনের শুরু হতে পারে৷ আমাদের সমাজে সব জায়গায় দেখবেন, যেমন সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী এদের মধ্যে নানা ধরনের দলাদলি এবং এক দল আরেক দলকে গালাগালি করছে৷ এদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত৷ সুতারাং সব জায়গাতেই পরিবর্তন আসতে হবে৷ শীর্ষ রাজনীতিবিদরা যদি এই পরিবর্তনটা দেখতে চান তাহলেও হতে পারে৷ তবে এর জন্য সময় লাগবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান