1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যেখানে খেলার চেয়ে ধূলাই বেশি

শাহজাহান কবির
১৯ মে ২০২৩

কিছুদিন আগে আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক অ্যান্ড্রু বালবার্নি একটা কথা বলেছেন যে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের খেলা হোক না কেন, সেখানে বাংলাদেশের সমর্থনই বেশি থাকবে৷

https://p.dw.com/p/4RZNg
বিদ্যুৎ কুমার রায়, যাকে বাংলাদেশের কিংবদন্তি ভারোত্তোলক বলা যায়৷
ক্রিকেটের আড়ালে বাংলাদেশের অন্য খেলাগুলোর খোঁজ রাখেন কয়জন! সেসব খেলায় তেমন সাফল্যই বা কই, যাতে করে মানুষ মাততে পারেন৷ছবি: Khandakar Tarek

আসলেও তাই, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন যেখানেই যায়, সাকিব-তামিমদের নিয়ে সেই একইরকম উন্মাদনা দেখা যায় সব জায়গায়৷ ক্রিকেটের আড়ালে বাংলাদেশের অন্য খেলাগুলোর খোঁজ রাখেন কয়জন! সেসব খেলায় তেমন সাফল্যই বা কই, যাতে করে মানুষ মাততে পারেন৷ ফুটবল ঘিরে বারবার হতাশার খবর৷ সবশেষ দুর্নীতির দায়ে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের ফিফা থেকে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার খবরে প্রতিক্রিয়া এমন যে- এটাই হওয়ার ছিল৷ ক্রীড়াঙ্গনের অন্য খেলাগুলোর বেশিরভাগ তেমনি ধুঁকছে অনিয়ম আর দুর্নীতিতে৷

সবশেষ টেনিসের ঘটনা যেমন৷ সেদিন সংবাদ সম্মেলন চলছে আন্তর্জাতিক জুনিয়র একটা টুর্নামেন্টের৷ রমনার শেখ জামাল টেনিস কমপ্লেক্সের বাইরে তখন এক দল অভিভাবক প্ল্য্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে গেছেন৷ তাদের অভিযোগ- ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ মোহাম্মদ হায়দার কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছেন না, নিজের মতো দল গড়ছেন প্রতিটা টুর্নামেন্টে, যেখানে তার মেয়েই প্রাধান্য পাচ্ছে৷ সঙ্গে এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার মেয়ে এবং তার কয়েকজন আত্মীয়ের সন্তানও নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছেন৷

স্বাভাবিকবাবেই নির্বাচক কমিটির দোহাই দিয়ে হায়দার সেইসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন৷ তবে তার মেয়ে যে নিয়মিত প্রতিটা টুর্নামেন্টই খেলছে তাতে সন্দেহ নেই৷ আর প্রায় গত এক বছরে তিনি সিনিয়রদের কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করছেন না, বাইরেও পাঠাচ্ছেন না তাদের৷ এই সময়ে ঘরে ও বাইরে যে ৮ টি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন খেলোয়াড়রা, তার ৭টিই জুনিয়রদের৷ আর সেই জুনিয়র দলে নিয়মিতই খেলছেন তাঁর মেয়ে৷

টেনিসে এর আগে একজন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, যিনি এক নারী খেলোয়াড়কে নিগ্রহের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে দায়িত্ব ছেড়েছেন৷ আপৎকালীন দায়িত্ব দেওয়া হয় তখনকার ক্রীড়া পরিষদ সচিবকে৷ দেখা গেল তার খেলা আয়োজনের দিকে তেমন মনোযোগ নেই, কিন্তু তিনি নিজে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন দেখতে৷

দেশের বিভিন্ন খেলার ফেডারেশনে ঢুঁ দিলে এমন অনিয়ম, অব্যস্থাপনার নানা চিত্র আপনার চোখে পড়বে৷ এই মুহূর্তে ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের নির্বাচন নিয়ে বেশ তোড়জোর চলছে৷ এখানে মূলত দুটি পক্ষ৷ এক পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে ফোরাম৷ এই ফোরাম হলো জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদ৷ নির্বাচনের মাঠে তাদের ব্যপক দাপট৷ কারণ, এই জোটের হাতেই সিংহভাগ ভোট৷ তো দেখা যাচ্ছে নির্বাচনের আগে তারাই প্রার্থী ঠিক করে দিচ্ছে, সেই প্রার্থী খেলাটার সঙ্গে জড়িত থাকুক বা না থাকুক, কোনো একটা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হয়তো তিনি৷ ফোরামকে পেছনে নিয়ে তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে বসে যাচ্ছেন৷ ব্যাডমিন্টন নির্বাচনে যেমন ফোরামের সমর্থন আমির হোসেন বাহারের দিকে৷ তিনি ফেনী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক৷ এর আগে এই দায়িত্ব পালন করেছেন৷ কিন্তু ৪ বছরের মধ্যে কোনো লিগ আয়োজন করতে পারেননি৷ ক্লাবগুলো নাকি তাকে সহযোগিতা করেনি৷ এই নির্বাচনেও সেই মেরুকরণ আছে৷ বাহার ফোরামের সমর্থন পেলেও অন্য প্রার্থী জোবায়দুর রহমান রানার সঙ্গে আছে বেশ কিছু ক্লাব৷ এই করে গত আট বছর ধরে লিগ নেই ব্যাডমিন্টনে৷ খেলোয়াড়রা সারা বছর ধরে শীত মৌসুমের অপেক্ষা করেন, তখন তারা দেশের এ প্রান্তে ও প্রান্তে খ্যাপ খেলে যা কিছু আয় করেন৷

নির্বাচন এলেই নাটক হয় হকিতে৷ তবে এবারের সবচেয়ে বড় নাটক ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে সাড়ে ৩ বছর নিরুদ্দেশ থাকা মমিনুল হক সাঈদের আবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হওয়া৷ ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ারা একের পর এক জামিনে বেরিয়ে এসেছেন৷ মামলা হয়েছে সাঈদের বিরুদ্ধেও৷ লম্বা সময় নিখোঁজ থাকার পর তিনিও দেশে এসেছেন৷ ফেডারেশন সভাপতি বিমান বাহিনী প্রধানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভাতেই তিনি প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন৷ অ্যাথলেটিকস দীর্ঘদিন ধরেই ন্যূব্জ৷ ইংল্যান্ড প্রবাসী ইমরানুর রহমান এসে সম্প্রতি সাফল্যের মুখ দেখিয়েছেন৷ এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসকে নতুন উচ্চতায় তুলে ধরেছেন৷ তবে দেশের অ্যাথলেটিকস আসলে কোথায় আছে? কিছুদিন আগে হয়ে গেল শেখ কামাল আন্তঃস্কুল অ্যাথলেটিকস৷ সারা দেশের স্কুল পর্যায়ে এমন আয়োজনের উদ্যোগ সাধুবাদ পেয়েছিল সবার৷ কিন্তু উপজেলা, জেলা পর্যায় থেকে সেই আসরের খবরাখবর পাওয়া যায়নি খুব বেশি৷ ফেডারেশনও আঞ্চলিক পর্যায়ের কোনো খেলারই ফল প্রকাশ করেনি৷ চুড়ান্ত পর্ব হয়েছে ঢাকায়৷ দুই দিনের সেই পর্বে দেখা গেল অনিয়ম, জালিয়াতির মচ্ছব৷ সেখানে এক স্কুলের খেলোয়াড় অন্য স্কুলের হয়ে খেলছে, কেউ হয়তো স্কুলেই পড়ে না সে খেলছে, আবার কেউ আঞ্চলিক পর্যায়ে খেলেইনি- সে-ও খেলছে৷ ৭ কোটি টাকা বাজেটের সেই আসর তাই ভীষণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে৷

এমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে খোদ বাংলাদেশ যুব গেমস৷ বয়স চুরির অভিযোগ সেখানেও পাওয়া গেছে বিস্তর৷ একজনের সনদ দেখিয়ে আরেকজন খেলেছে৷ শেষ দিন দেখা গেল দ্রততম মানব- মানবী নিয়েই প্রশ্ন৷ যিনি দ্রততম মানব হয়েছেন, সেই নাঈম শেখ এর আগে ইকরামুল হোসেন নামে যুব অ্যাথলেটিকসে সোনা জিতেছেন৷ দ্রততম মানবী হয়েছেন আইরিন আক্তার, জানা গেল তিনিই এর আগে রেখা আক্তার নামে যুব অ্যাথলেটিকসেও হয়েছেন দ্রততম মানবী৷ শীতে মিরপুর সুইমিং পুলে সাঁতার চালু রাখা হয় পানি গরম করে৷ এবারের শীতে সেই পুল চালুই করা গেল না৷ ক্যাম্পে থাকা সাঁতারুদের ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো৷ কারণ, খুঁজতে গিয়ে জানা গেল আরেক অনিয়মের খবর৷ মিরপুলের পুলের গ্যাসলাইন ব্যবহার করে কমপ্লেক্সের সামনেই রেস্তোরাঁ ব্যবসা খুলেছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ঠিকাদার মনির হেসেন৷ তিতাস সেই খবর পেয়ে পুলের গ্যাস সংযোগই বিচ্ছিন্ন করে দেয়৷ পরে জানা গেছে এনএসসির পরিচালকের অনুমতিপত্র নিয়েই সেই গ্যাস সংযোগ নিয়েছিলেন মনির৷ সেই পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দাবি করেছেন, এটি এনএসসি চেয়ারম্যান, অর্থাৎ যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েই করা হয়েছে৷

শাহজাহান কবির, ক্রীড়া সাংবাদিক
শাহজাহান কবির, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: Munir Uz zaman

আবার বাস্কেটবলের উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়াটাকে আপনি অনিয়ম বলতে পারেন আবার না-ও পারেন৷ তবে অব্যবস্থাপনা তো বটেই৷ দীর্ঘদিন ধরে বাস্কেটবল ফেডারেশন আবাহনী মাঠ সংলগ্ন ধানমণ্ডি উডেন ফ্লোর জিমন্যাসিয়ামে৷ আবাহনী মাঠ ঘিরে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের পরিকল্পনায় অনেকদিন ধরেই জানা ছিল, এই জিমন্যাসিয়াম ভেঙে ফেলা হবে, যার জন্য জিমন্যাসিয়ামের উডেন ফ্লোর নষ্ট হয়ে খেলার প্রায় অনুপোযোগী হয়ে পড়ার পরও তা কখনোই পুরোপুরি সংস্কার করা হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত একদিন শেখ কামাল কমপ্লেক্সের শ্রমিক-মিস্ত্রিরা হাতুড়ি, শাবল নিয়ে এসে ভাঙা শুরু করলেন সেই জিম্যানসিয়াম৷ একদিনের মধ্যে উদ্বাস্তুতে পরিণত হলেন যেন বাস্কেটবল খেলোয়াড়রা৷ কারণ, এই জিমন্যাসিয়ামেই বছর-ভর অনুশীলন, টুর্নামেন্ট সব চলতো বাস্কেটবলের৷ খেলোয়াড়রা সেই খেলার জায়গা তো হারালেন, দেখা গেল ফেডারেশন কর্মকর্তাদের বসার জায়গাও আর নেই৷ তাদের সেই বসার জায়গা আর হয়ওনি৷ মাঝে মাঝে ক্রীড়া পরিষদের বরাদ্দ নিয়ে মিরপুর ইনডোরে হচ্ছে এখন বাস্কেটবলের কিছু খেলা৷

গত বছরের অধিকাংশ সময়ই বক্সিং ফেডারেশন ছিল তালাবদ্ধ৷ এখানেও সেই নির্বাচন ৷ কাউন্সিলরশিপ নিয়ে অভিযোগ তুলে এক পক্ষ আদালতে গেলে আদালত অন্যপক্ষের ফেডারেশনে যাওয়া আটকে দেয়৷ দুই দফায় ১০ মাসের মতো ছিল সেই স্থগিতাদেশ৷ গত ১২ বছরে এই খেলার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে মাত্র ৫ বার৷ তবে সব খেলাতেই যে এমন গ্রহণ, তা নয়৷ আর্চারি ফেডারেশন যেমন বেশ ভালো চলছে৷ জাতীয় দল বছরে ৭-৮ টা আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নিচ্ছে৷ ঘরোয়া খেলা হচ্ছে নিয়মিত৷ আর্চাররা এখন বৈশ্বিক পর্যায়েই লড়ছেন সমান তালে৷ কাবাডি ফেডারেশনও এই মুহূর্তে বেশ সক্রিয়৷ ঘরোয়া আসরগুলো যেমন জমজমাট হচ্ছে বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করেও বর্তমান কমিটি এই খেলায় নতুন উদাহরণ তৈরি করেছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফল খেলাগুলোর আরেকটি ভলিবল৷ ইরানী কোচ আলিপোর আরোজির অধীনে জাতীয় দলের খেলায় এখন আধুনিকতার ছাপ৷ সবশেষ এশিয়ান অনূর্ধ্ব-২০ ভলিবলে চীন, বাহরাইন, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের পঞ্চম হওয়া আলোড়ন তুলেছে৷ তবে মোটা দাগে পিছিয়ে পড়ার গল্পগুলোরই বেশি৷ অলিম্পিকে পদকহীন সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশটি এখনো বাংলাদেশ৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য