1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চেয়ারম্যান বলছেন বান্দরবানে ধর্ষণ নয়, মারামারি হয়েছে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩ মার্চ ২০২৩

বান্দরবানের লামায় এক মারমা তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাঙালি তরুণকে অবশেষে সাত দিন পর গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷

https://p.dw.com/p/4OELS
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor

তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এখন বলছেন, ধর্ষণ হয়নি, মারামারি হয়েছে৷ নারী ইউপি সদস্য এবং ধর্ষিতার পরিবার বলছে, অভিযুক্ত তরুণ পাহাড়ি ওই নারীকে ধর্ষণ করে এলাকাতেই আত্মগোপন করেছিলেন৷

স্থানীয়রা অভিযুক্তকে ধর্ষণের ঘটনার পরই আটক করেছিলেন৷ তবে ইউপি চেয়ারম্যান তাকে পালাতে সহায়তা করেছিলেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ

লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেন অভিযুক্তকে থানায় না দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তা আমরা তদন্ত করে দেখছি৷ যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘ছাড়া পেয়ে আসামি কায়সার এলাকায়ই আত্মগোপন করেছিল৷ আমরা তার মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে আজ (শুক্রবার) তাকে গ্রেপ্তার করেছি৷’’

আদিবাসী ওই তরুণী গত শুক্রবার ( ২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে লামার ফাঁসিয়াখালি ইউনিয়ন এলাকায় ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে ধর্ষণ করা হয়৷ তার মামা অভিযোগ করেন, ‘‘তরুণীর চিৎকারে স্থানীয় লোকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার এবং তার কাছে ধর্ষণের বিস্তারিত বক্তব্য শুনে অভিযুক্ত কায়সারকে আটক করে৷ কায়সারকে কিছুটা মারধরও করা হয়৷এরপর ইউপি চেয়ারম্যানকে খবর দিলে তিনি মহিলা মেম্বার জ্যোৎস্না আক্তার লিলিকে পাঠান৷ মেম্বার থানায় খবর না দিয়ে একটি অটোরিকশায় করে অভিযুক্তকে হাসপাতালে নিয়ে যান৷ এটা ইউপি চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি অভিযুক্তকে আবার ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসেন৷ ধর্ষণের শিকার তরুণী এবং এলাকার লোকজন ইউনিয়ন পরিষদে গেলে চেয়ারম্যান নুরুল হাসান চৌধুরী সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা নিস্পত্তির কথা বলেন৷চেয়ারম্যানের কাছেও সে (কায়সার) ধর্ষণের কথা জানিয়েছে৷’’

তিনি জানান, ‘‘এরপর বিকেলে একটি ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে সই রেখে অভিযুক্তকে চিকিৎসার জন্য ছেড়ে দেন চেয়ারম্যান৷ বলেন, কায়সার সুস্থ হলে বিচার করা হবে৷ এরপরই কায়সার আত্মগোপন করে৷’’

পরের দিন শনিবার ওই তরুণীকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা লামা থানায় গিয়ে ধর্ষণের মামলা করেন৷ এরপর আর প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ তবে সংবাদমাধ্যমে খবরটা আসায় ঘটনার সাত দিন পর পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়৷

তরুণীর মামা বলেন, ‘‘কায়সারের পরিবার কিছুটা প্রভাবশালী৷ সে নিজে ব্যবসা-বাণিজ্য করে৷ হাতে টাকা-পয়সা আছে৷ সে কারণেও হতে পারে অথবা বাঙালি হওয়ার কারণেও তাকে চেয়ারম্যান ছেড়ে দিতে পারেন৷ তবে কী কারণে ছেড়ে দিয়েছেন এটা চেয়ারম্যান সাহেবই ভালো বলতে পারবেন৷’’

ঘটনাস্থলে যাওয়া নারী ইউপি সদস্য জ্যোৎস্না আক্তার লিলি বলেন, ‘‘ওই তরুণী আমাকে ধর্ষণের কথা বলেছে৷ চেয়ারম্যান সাহেব ধর্ষণের বিষয়টি সালিশের মাধ্যমেই নিস্পত্তি করতে চেয়েছিলেন৷ চেয়ারম্যানকেই সবাই বিচারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷ সে কারণেই ঘটনার দিন পুলিশকে জানানো হয়নি৷’’

তিনি দাবি করেন, ‘‘স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে চেয়ারম্যানই কায়সারকে ছেড়ে দেন৷ আমি ছাড়তে বলিনি বা ছাড়িনি৷ তাকে মারপিট করায় সে মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল৷ তাকে চিকিৎসার জন্য ছাড়া হয়৷’’

তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘কায়সার পালায়নি, সে হাসপাতালেই ভর্তি ছিল৷ সেখান থেকেই পুলিশ আজ (শুক্রবার) তাকে আটক করেছে৷ তার বাবা-মাকেও আটক করা হয়েছে৷’’

তবে চেয়ারম্যান নুরুল হাসান চৌধুরী দাবি করেন, ‘‘ওই দিন কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি৷ মারামারির ঘটনা ঘটেছে৷ আমি প্রমাণ করে দেবো ধর্ষণ হয়নি৷ ওইখানে শতাধিক লোক ছিল, তরুণী কারুর কাছে ধর্ষণের কথা বলেনি৷’’

তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না জানিয়ে বলেন, ‘‘আমাকে লোকজন বলেছে, কায়সার এবং ওই তরুণী মারামারি করেছে৷ তাই আমি সালিশ করার কথা বলেছিলাম, কায়সারকে ছেড়ে দিয়েছিলাম পরে সালিশ করার জন্য৷ পরে অবশ্য থানায় মামলা হয়েছে৷ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে৷’’

তিনি দাবি করেন, কোনো প্রভাব বা বাঙালি হওয়ার কারণে তিনি কায়সারকে পালাতে সহায়তা করেননি, সালিশ করার জন্যই তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ ধর্ষণের ঘটনা সালিশ করে নিস্পত্তি করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘‘ধর্ষণই তো হয়নি৷ আপনি ধর্ষণ করতে দেখেছেন?’’

লামা থানার ওসি মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ‘‘কায়সার পলাতক ছিল৷ তার মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে এলাকা থেকেই আটক করা হয়েছে৷ সে সুস্থ আছে৷’’

তিনি জানান, ‘‘শনিবার থানায় মামলা হওয়ার পর আমরা তরুণীর জবানবন্দি নিয়েছি৷ সে তাকে ধর্ষণের কথা জানিয়েছে৷ অভিযুক্ত কায়সারের নাম বলেছে৷ বান্দরবান সদর হাসপাতালে তার ডাক্তরি পরীক্ষা হয়েছে৷ আদালতেও সে জবানবন্দি দিয়েছে৷ এরপর চিকিৎসার জন্য তাকে তার পরিবারের জিম্মায় দেয়া হয়েছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘ধর্ষণের মতো অপরাধের সালিশ বেআইনি৷ তাকে আটকের পর ছেড়ে দেয়ারও অভিযোগ পেয়েছি৷ এই অভিযোগেরও আমরা তদন্ত করছি৷ দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’

ওই তরুণীর ভাই জানান, ‘‘আমার বোন এখনো বান্দরবান হাসপাতালে ভর্তি আছেন৷ এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি৷ তার শরীরের বাইরের অংশেও নানাভাবে আঘাত করা হয়৷ আমরা এর ন্যায় বিচার চাই৷’’

বান্দরবানের উইমেন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাধবী মারমা বলেন, ‘‘চেয়ারম্যান- মেম্বাররা হয়ত সালিশের নামে ধর্ষণের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু এটা বেআইনি৷ হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধ সালিশের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা যায় না৷ পরিবারের সদস্যরা পরদিন থানায় মামলা না করলে তার মেডিকেল টেস্টও হতো না৷ ফলে পরে আর ধর্ষণও প্রমাণ করা যেতো না৷ এখন যদি সব পক্ষ তদন্তে সহায়তা করে তাহলে হয়তো ওই নারী ন্যায়বিচার পাবেন৷ আর যারা ঘটনা সালিশের নামে ধামাচাপ দিতে চেয়েছিল, তাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন৷’’