পদ্মা সেতু, ঈদযাত্রার আনন্দ ও আশঙ্কা
৮ জুলাই ২০২২আমনুর রহমান রাফাতের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়৷ তিনি তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন৷ চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে৷ তার ভাই-বোনরাও ঢাকায় থাকেন৷ এবার তিনি তার পরিবারের সব সদস্যদের সবাইকে নিয়ে ঈদে গ্রামের বাড়ি যাবেন৷ এর কারণ দুইটি৷ পদ্মা সেতু দেখা এবং কম সময়ে ঝামেলা এড়িয়ে বাড়ি যাওয়া৷
তিনি বলেন, ‘‘আগে ১৪ ঘন্টার কমে যেতে পারতাম না৷ এবার আশা করি, সাত ঘটনায় যেতে পারবো৷ আর আগে ঈদের সময় কখনো কখনো ২২ ঘণ্টাও লাগতো৷ তাই ঈদে ভোগান্তির কথা ভেবে বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলাম৷ তাই এবার ঈদে পদ্মা সেতু যেন ডাবল আনন্দ এনে দিচ্ছে৷’’
একই কথা বলেন বরিশালের জেসমিন লিপি৷ তার বাড়ি বরিশাল শহরে ৷ তার কথা, ‘‘এবার ঈদে পদ্মা সেতু পার হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাবো আশা করি৷ মনে হচ্ছে ঢাকার কাছেই আমার বাড়ি৷’’
আর পিরোজপুরের সোহেল আহমেদ বলেন, ‘‘আমি এরইমধ্যে ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়ে ঘুরে এসেছি৷ মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা লেগেছে৷ ঈদে এবার সবাই মিলে বাড়ি যাবো৷’’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর ঢাকা থেকে দূরত্ব পদ্মা সেতুর কারণে বলতে গেলে অর্ধেক কমে গেছে৷ তাই ওই এলাকার লোকজন ঈদ যাত্রায় সড়ক পথকেই বেছে নিচ্ছেন৷ যারা ঈদে যেতেন না, তারাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ তাই এবার ঈদে ওই অঞ্চলে সড়কপথে যাত্রী কমপক্ষে আগের তুলনায় দুইগুণ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ এরইমধ্যে লাঞ্চে যাত্রী কমে গেছে৷ তাই ঈদের যাত্রী ধরতে লঞ্চে ভাড়া কমানো হয়েছে৷
দোলা পরিবহণের পিরোজপুরের কাউন্টার ম্যানেজার আব্দুল হালিম বলেন, ‘‘এবার ঈদে বাস-যাত্রী বেড়ে গেছে৷ আগের চেয়ে বলতে গেলে দ্বিগুণ৷ সবাই এবার বাসে পদ্মা সেতু পার হতে চায়৷ আর এখন এক ঘন্টা পরপর বাস ছাড়ছে৷ ফলে টিকিটেরও কোনো সমস্যা নেই৷ আর নতুন নতুন পরিবহণ কোম্পানিও নামছে৷ একটা উৎসবের আমেজ চলছে৷’’
যাত্রীদের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও আশঙ্কার কথা জাানান পটুয়াখালি সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন মৃধা৷ তিনি বলেন, ‘‘এই ব্যাপক আগ্রহের কারণে এখন ডাম্পিংয়ে থাকা চলাচলের অনুপযোগী বাসও রাস্তায় নামানো হচ্ছে৷ বড় বড় কোম্পানিও বাস নামাচ্ছে৷ ফলে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘যত যানবাহন চলবে এখন, তত চওড়া সড়ক নেই৷ মাওয়ার পর থেকেই এক লেনের সড়ক৷ তাই ঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে৷”
এদিকে বরিশাল শহর থেকে এখন প্রতি ৩০ মিনিট পরপর বাস ছাড়ছে৷ ঢাকা থেকেও তাই৷ সাকুরা পরিবহণের এমডি হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘মানুষের আগ্রহ আছে৷ আমরাও সেবা দিতে প্রস্তুত৷ তবে ঈদের আগে ও পরে যানবাহনের যে চাপ বাড়বে তা সামলানো যাবে কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়৷ পদ্মা সেতু এবং এক্সপ্রেসওয়েতে টোলের যে ব্যবস্থাপনা তাতে গতি কমে যাবে৷ ব্যাপক যানজট হতে পারে৷”
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার চাপ পড়ছে পদ্মা সেতুর ওপর৷ পদ্মা সেতু পার হয়ে যানবাহন ওই জেলাগুলোতে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘এখনই তিন-চার ঘন্টা লেগে যাচ্ছে যাত্রাবাড়ি থেকে পোস্তগোলা যেতে৷ আসার পথে আরো খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে৷ যাত্রাবাড়ি থেকে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন হতে পারে৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা সেতুতে টোল আদায়ের যে সিস্টেম, এই সিস্টেমের কারণেই যানজট বাড়বে৷ সেতু পার হলে দ্রুত চলে যাওয়া যাবে৷ কিন্তু সেতু তো পার হতে হবে৷”
তিনি জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগ আগে সমীক্ষা করে বলেছে প্রতিদিন পদ্মা সেতু থেকে আট হাজার যানবাহন চলাচল করবে৷ কিন্তু এরইমধ্যে তা ১৫ হাজারে পৌঁছেছে৷ এটা ৫০ হজার পর্যন্ত যাবে৷ ফিডার রোডে এখনই যানজট হচ্ছে৷ এটা আরো বাড়বে৷ পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে ঢাকার পরিবহন ও ওই জেলাগুলোর সড়ক পরিকল্পনা ঠিকভাবে করা হয়নি৷
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এবার ৮০-৯০ লাখ মানুষ ঈদে ঢাকা ছাড়বেন৷ তারমধ্যে কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকার সড়ক পথে বাইরে যাবেন পদ্মাসেতু পার হয়ে সড়ক পথে৷ কোরবানির ঈদে ৮০ লাখ মানুষ ঢাকার বাইরে যান৷ এবার যে ১০ লাখ বেশি যাবেন তা পদ্মা সেতুর কারণে৷
তার কথা, ‘‘মহাসড়কে ঈদে মোটরবাইক চলাচল বন্ধ করায় বাস কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে ভাড়া বাড়িয়েছে৷ মোটর বাইক কখনো গণপরিবহণের বিকল্প নয়৷ কিন্তু এখানে গণপরিবহণের নৈরাজ্যের কারণে মোটরবাইকনির্ভরতা বাড়ছে৷”
বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশন মনে করে, পদ্মা সেতুর কারণে যেমন বাসযাত্রী বাড়ছে তেমনি ঈদে মহাসড়কে মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ রাখার কারণেও বাসের ওপর চাপ বাড়বে৷ আর এই কারণে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে রাস্তায় চলাচলের অনুপোযোগী বাসও সুযোগ বুঝে নেমে পড়ছে৷ ফলে মহাসড়কে নতুন ঝুঁকি তৈরি হবে এবার ঈদে৷ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘‘এর বাইরে টোল ব্যবস্থাপনা আধুনিক না হওয়ায় পদ্মা সেতুর দুই দিকে যানজট তৈরি হতে পারে৷”
তিনি বলে, ‘‘এবার প্রচুর লোক বাসে দক্ষিণাঞ্চলে যাবেন৷ কিন্তু উপযুক্ত যানবাহন নেই৷ আমরা মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলুক তা চাই না৷ কিন্তু গণপপরিবহণ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় ঈদে অনেকেই মোটরসাইকেলে করে বাড়ি যান৷ গত ঈদে গিয়েছেন ৩৫ লাখ মানুষ৷ এবার এরা তো বাসে যাবেন৷ ফলে পরিস্থিতি ততটা স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে৷’’
‘‘এবার পদ্মা সেতু ঈদযাত্রায় কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে৷ তবে সমস্যা হলো ব্রডব্যান্ড থেকে লোকাল কানেকশনে ঢোকার সমস্যা৷ কারণ, গন্তব্যের দিকে সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটেনি’’-এই মন্তব্য বুয়েটের অধ্যাপক এবং সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হকের৷ তার কথা, ‘‘শুধু বিনিয়োগ করলেই উন্নন হয় না, উন্নয়ন হতে হয় পরিকল্পিত৷ যোগাযোগের সব মাধ্যমকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হয়৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘এবার পদ্মা সেতু দিয়ে ঈদ যাত্রা শুরুর দিকটা স্বস্তিরই হবে৷ শেষের দিকে গিয়ে সমস্যা হতে পারে৷ যে চাপ পড়বে তা ডিষ্ট্রিবিট হতে সময় লাগবে৷ গন্তব্যের কাছাকাছি যে ধরনের রোড নেটওয়ার্ক আছে তার উন্নয়ন প্রয়োজন৷ সড়ক ব্যাস্থাপনা এখনো সমন্বিত হয়নি৷ তাই ঢাকায় ফেরার পথে সেতুর ওপর চাপ বাড়বে৷ যানজট হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন আর ডেভেলপমেন্ট নয়, রিডেভেলপমেন্টের সময়৷ এখনই সময় সড়কগুলোকে সময়োপযোগী এবং আধুনিক করার৷ উপজেলা পর্যন্ত সড়কগুলো দখল হয়ে আছে৷ চওড়া করারও সুযোগ নেই৷”