1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নেটফ্লিক্স বনাম কান: স্ট্রিমিংয়ের যুগে সিনেমার ভবিষ্যৎ

১৪ জুলাই ২০২১

টানা তৃতীয় বছরের মতো কান চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজকদের সঙ্গে স্ট্রিমিং সার্ভিস নেটফ্লিক্সের দ্বন্দ্ব চলছে৷ এবারও নেটফ্লিক্সের কোনো সিনেমা কানে আসেনি৷ স্ট্রিমিং বনাম হল-থিয়েটার, সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এই বিতর্কের শেষ কোথায়?

https://p.dw.com/p/3wS16
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/J. Porzycki

বিতর্কের শুরুটা ২০১৭ সালে৷ কান চলচ্চিত্র উৎসবে কোরিয়ান নির্মাতা ও প্রযোজক বং জুন-হো-র ওকজা এবং নোয়া বাউমবাখের দ্য মেয়ারোভিৎস স্টোরিজ চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে মনোনীত হয়৷ কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দ’র এর দৌড়ে ছিল এই দুই চলচ্চিত্র৷ কিন্তু নেটফ্লিক্সের প্রযোজনায় নির্মিত এই দুই সিনেমাকে মনোনয়ন দেয়ায় ফ্রান্সের সিনেমা প্রদর্শকরা ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন৷ কানকে তারা বড় পর্দার অভিভাবক এবং নেটফ্লিক্সকে এই শিল্পের মারাত্মক হুমকি বলে আখ্যা দেন৷

বিতর্ক এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে উৎসব চলাকালেই কান কর্তৃপক্ষ নেটফ্লিক্সকে সতর্ক করে দেয় যে তাদের প্রযোজিত সিনেমা আগে বড় পর্দায় দেখাতে হবে৷ খোদ সে বছরের জুরি বোর্ডের প্রধান স্প্যানিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা পেদ্রো আলমোদোভার ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব সিনেমা হলের সিনেমার জন্য, অনলাইনে দেখানোর জন্য নয়’ বলে মন্তব্য করেন৷

ফলে উৎসব চলাকালেই কান উৎসব কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যেসব চলচ্চিত্র কানে প্রতিযোগিতা করছে, তাদের অবশ্যই ফ্রান্সের নিয়ম মেনে আগে সিনেমা হলে দেখাতে হবে৷ ফ্রান্সের নিয়ম অনুসারে সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার তিন বছর পরই কেবল কোনো সিনেমা স্ট্রিমিং সার্ভিসে দেখানো যাবে৷ নেটফ্লিক্স যেখানে এত টাকা খরচ করে এক একটি সিনেমা তৈরি করে নিজেদের প্ল্যাটফর্মে দেখানোর জন্য, সেখানে এমন আবদার তাদের কাছে হাস্যকর মনে হওয়ারই কথা বটে৷

ফলে পরের বছর ফরাসি নিয়ম মেনে কান চলচ্চিত্র উসবে আসতে রাজি হয়নি নেটফ্লিক্স৷ এমনকি আউট অব কম্পিটিশন ক্যাটাগরিতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা আসতে রাজি হয়নি৷

কান বাদে ইউরোপের অন্য দুই বৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসব ভেনিস ও বার্লিনে স্ট্রিমিং সার্ভিসের সঙ্গে আয়োজকদের তেমন দ্বন্দ্ব নেই৷ পলে ২০১৮ সালে নেটফ্লিক্স কানে না এসে কানের সবচেয়ে পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বী ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে হাজির হয় আলফোনসো কুয়ারনের রোমা নিয়ে৷ সেখানে চলচ্চিত্রটি সবচেয়ে বড় পুরস্কার- গোল্ডেন লায়ন জিতে নেয়৷

কান বনাম নেটফ্লিক্স দ্বন্দ্ব ২০২১ সালে এসেও কমেনি৷ বরং উৎসব কর্তৃপক্ষ এবং জুরি বোর্ডের প্রধানের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য বরং এই বিতর্কে আরো ঘি ঢেলেছে৷ উৎসব উদ্বোধনের ঠিক দুদিন আগে কানের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর থিয়েরি ফ্রঁমোর একটি সাক্ষাৎকার নেয় ফ্রান্স টোয়েন্টি ফোর৷ সেখানে ফ্রঁমো নাম উল্লেখ না করেই প্রতিদ্বন্দ্বী উৎসবগুলোকে এক হাত নেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা সিনেমা বাঁচুক, এটা চায় না, তাদের জন্য কোনো কোনো উৎসব তাদের দরজা খুলে দিয়েছে৷’’

তবে উৎসবের ৭৪তম আয়োজনের উদ্বোধনের আগে এবারের জুরি বোর্ডের প্রধান স্পাইক লি বললেন ভিন্ন কথা৷ কানের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি জুরি বোর্ডের প্রধান মনোনীত হলেন৷ ফলে এমনিতেই তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি ছিল সবার৷ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে লি বললেন, ‘‘চলচ্চিত্র উৎসব এবং নেটফ্লিক্স একই সঙ্গে টিকে থাকতে পারে৷ একসময় টিভি আবিষ্কারের পর সবাই মনে করেছিল সিনেমা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এবারও তাই হবে৷’’

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিতর্কের কী অবস্থা?

নেটফ্লিক্সের একটি ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফরম যারা ডিস্ট্রিবিউশন, পাবলিসিটি এড়িয়ে নির্মাতার কাছ থেকে সিনেমাকে সরাসরি দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়৷ এর যেমন কিছু ভালো দিক রয়েছে, তেমনি কিছু খারাপ দিকও রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতা-প্রযোজকেরা৷ বিদেশি নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন ও হইচইয়ের মতো বাংলাদেশেও গড়ে উঠছে বঙ্গ বিডি, বায়োস্কোপ, সিনেম্যাটিক, চরকি ইত্যাদি নানা প্ল্যাটফর্ম৷ ফলে দেশের বাইরে এই বিতর্ক অনেক আগে থেকে ডানা মেললেও, বাংলাদেশে ইদানিং বেশ নড়েচড়ে বসেছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা৷

গুপী-বাঘা প্রোডাকশন্সের নির্মাতা-প্রয়োজক বিজন ইমতিয়াজ বিশ্বে সিনেমার সবচেয়ে বড় মার্কেট বলে পরিচিত কানের মার্শে দ্যু ফিল্মে এসেছেন নির্মাতা নূহাশ হুমায়ূনের মুভিং বাংলাদেশ নিয়ে৷ কানের সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশের সিনেমা মার্কেট নিয়ে কথা হচ্ছিলো৷ তিনি বললেন, ‘‘বাংলাদেশে মার্কেটে কিছু প্রবলেম আমরা ফেস করি মূলত ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলে৷ সব ছবি দেখার মতো দর্শক অবশ্যই আমাদের আছে, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলটা আমাদের নেই৷ বাংলাদেশে প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন এবং পাবলিসিটি সব টাকাই প্রডিউসার দেয়, কিন্তু থিয়েটার থেকে আমরা পাই ১০০ টাকায় ১৬ টাকা৷ এই সমস্যার সমাধান না হলে এটাকে বিজনেস হিসেবে দাঁড় করানো মুশকিল হবে৷’’

নির্মাতা আবু শাহেদ ইমন মনে করেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো নির্মাতাদের সামনে একপ্রকার ‘উদ্ধারকারী’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে৷ হল সংকট, মানসম্মত হল না থাকা, ঠিকমতো টাকা ফেরত না পাওয়াসহ নানা সংকটে এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র খাত প্রায় পঙ্গু হয়ে আছে বলে মনে করেন তিনি৷ ফলে তার মতে, ‘‘ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে৷ ব্যবসায়িক দিক থেকে সিনেমার জন্য এটাকে আমি কোনো হুমকি বলে মনে করি না৷ তবে ওটিটি আর্টিস্টিক দিক থেকে একপ্রকার থ্রেট৷ এ ধরনের মিডিয়া সাধারণত দর্শকের ডিমান্ডের ওপর ভিত্তি করে কনটেন্ট তৈরি করে থাকে৷ ফলে ড্রাগ, ভায়োলেন্স, নেগেটিভ চরিত্র ইত্যাদি ক্রমাগত প্রাধান্য় পাচ্ছে৷ তারপরও অরিজিনাল ভয়েসের যে সীমাবদ্ধতা ছিল, ওটিটির কারণে সেগুলো কেটে যাবে৷’’

আরেক তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা আরিক আনাম খানের মন্তব্যেও এই দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া গেল৷ স্ট্রিমিং সার্ভিসকেই বিনোদনের ভবিষ্যত বলে মনে করেন৷ তবে সিনেমার ক্ষেত্রে থিয়েটারের আলাদা গুরুত্ব আছে বলেও মনে করেন তিনি৷ আরিক বলছিলেন ‘‘আগে মানুষ অনেক সিনেমা দেখতে পেতো না৷ অনেক নির্মাতা তাদের সিনেমা হলে মুক্তি দিতে পারতেন না৷ কিন্তু এখন স্ট্রিমিং সার্ভিসের কল্যাণে মানুষ বাসায় বসে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে৷ তবে সিনেমা আসলে বড় পর্দাতেই দেখানো উচিত, কারণ যেভাবে শ্যুট করছেন, সাউন্ড ইত্যাদি অনেক টেকনিক্যাল আসপেক্ট আছে, যা আসলে বাসায় বসে পাবেন না৷ কিন্তু তারপরেও গ্রেটার অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর জন্য স্ট্রিমিং একটা বড় মাধ্যম হয়ে আসছে৷’’

বিজন, আরিক বা শাহেদের মতো প্রায় সকল তরুণ নির্মাতাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, নিজের সিনেমা তারা আগে বড় পর্দাতেই মুক্তি দিতে চান৷ একসঙ্গে অনেকে বসে সিনেমা দেখা এবং বড় পর্দায় নির্মাতার বলতে চাওয়া গল্পের সবচেয়ে কাছাকাছি যাওয়া হলেই সম্ভব বলে মনে করেন তারা৷

বিজনের মতে, বাংলাদেশে সিনেমা হল মালিক ও ডিস্ট্রিবিউটরের কারণে নির্মাতাদের যেমন অর্থনৈতিক সংকটে ভুগতে হয়, দর্শকরাও ভালো সিনেমা বেছে নেয়া থেকে বঞ্চিত হন৷ তবে তিনি মনে করেন, এবার একটা পরিবর্তন আসতে বাধ্য৷ ‘‘যখন পকেটে আঘাত লাগে তখন মানুষ চেঞ্জ হয়, এছাড়া মানুষ চেঞ্জ হয় না৷ এক্ষেত্রে আশা করি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷’’

একটা বিষয় স্পষ্ট, কান অথবা ঢাকা, ওটিটি বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের দীর্ঘদিনের সিনেমা সম্পর্কিত ধারণায় একটি বড় পরিবর্তন হয়েই আসছে৷ এই দুয়ের সুষ্ঠু সমন্বয় কিভাবে করা সম্ভব তা হয়তো আপাতত সময়ের হাতেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান