1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কোরবানির ঈদের জন্য অপেক্ষায় থাকার কাহিনি

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
১৪ জুন ২০২৪

ভারতে সব বিতর্ককে পিছনে ফেলে সব উৎসবে থাকে একটা সৌহার্দ্য়ের সুর। কোরবানির ঈদেও তা সমানভাবে থাকে।

https://p.dw.com/p/4h0z1
পশুর হাটে ছাগল ও বিক্রেতারা
কোরবানি উপলক্ষ্যে দিল্লিতে জামা মসজিদের পাশে বসে জমজমাট পশুর হাটছবি: Rouf Fida/DW

কোরবানির ঈদ এলেই সালাউদ্দিন ও জাভেদের অপেক্ষায় থাকি। প্রতিবার কোরবানির ঈদে দুজনে মাংস রান্না করে নিয়ে আসে। কাবাবও থাকে। আমরা সবাই মিলে উপভোগ করি। সবাই মানে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আবার কোরবানির ঈদ আসছে। আবার আমারা অপেক্ষা করে আছি সমবেত আনন্দের জন্য।

দিল্লির কোরবানির ঈদকে বলা হয় বকরি ঈদ। কারণ, দিল্লিতে কোরবানি দেয়া হয় মূলত বকরিকে। দিল্লিতে গোরু কাটা বেআইনি। তাই কোরবানির ঈদে মাটনের নানান রকম পদের স্বাদগন্ধে উতরোল হয়ে থাকি আমরা।

ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, উত্তেজনা নিয়ে গত কয়েক বছরে কম কথা বলা হয়নি। প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ঈদ ও কোরবানির ঈদের দিনের চেহারাটা অন্যরকম। কলকাতায় বড় হয়ে ওঠার পর দীর্ঘদিন ধরে দিল্লিতে থাকার অভিজ্ঞতার সুবাদে বলতে পারি, দুই শহরের চাল-চরিত্র-চেহারা আলাদা। কিন্তু দুই ঈদের দিনে দুই শহর যেন আশ্চর্যজনকভাবে একইরকম চেহারা নেয়। উৎসবের চেহারা।

দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধু মিলন দত্ত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে। মিলন অনেকগুলি বইও লিখেছে। মিলন বলছিলেন, ''আমি পশ্চিমবঙ্গের একটি মুসলিমপ্রধান গ্রামে বড় হয়েছি।  সেখানকার ছবিটা ছিল আলাদা। এখনো পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বা ছোট শহরে সৌহার্দ্যের ছবি দেখে ভালো লাগে। বর্তমান রাজনীতির কুপ্রভাব সত্ত্বেও মানুষ এখনো একসঙ্গে ঈদ বা বকরি ঈদের দিনটি পালন করেন। আর এই সৌহার্দ্যের ছবিটা কলকাতার থেকে অনেক বেশি করে গ্রামগঞ্জে দেখা যায়।''

মিলন বললেন, ‘‘একটা কথা জানিয়ে রাখি। ঈদের দিনে কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট বা পার্ক সার্কাস বা অন্য সংখ্যালঘু-প্রধান এলাকায় হালিম, কাবাব খেতে মুসলিমদের থেকে হিন্দুরা বেশি করে ভিড় জমায়।'' উৎসবের চরিত্রই তো হলো, তা কোনো গণ্ডি মানে না। সেখানে কোনো লক্ষ্ণণরেখা নেই। রমজান যখন চলে, তখন দিল্লির অনেক পরিচিত মানুষই অনেক রাতে জামা মসজিদের পাশের রেস্তোরাঁয় খেতে যান ২০-২৫ কিলোমিটার পথ গাড়িতে সওয়ার হয়ে।

মিলনের কথার সঙ্গে মিলে যায় সাবেক সাংবাদিক ও লেখক মোসারফ হোসেনের কথা। মোসারফ বলছেন, ''গ্রামে যারা একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তারা একসঙ্গে এ উৎসব পালন করেন। হিন্দুরা মুসলিমদের এবং মুসলিমরা হিন্দুদের উৎসবে এখনো সামিল হন।''

যেমন এই বকরি ঈদে মোসারফের পরিচিত অতটা স্বচ্ছ্বল নন এমন একজন জানিয়েছেন, তিনি হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে প্রায় ২০ জনের কাছে কোরবানির মাংস পাঠাবেন। আবার পুজোর সময় হিন্দুরা তাকেও উপহার পাঠান। মোসারফের মতে, ‘‘এই চলটা উচ্চমধ্যবিত্ত বা বিত্তশালীদের মধ্যে কম, বাকিদের মধ্যে বেশি।’’

মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছেন সোমাইয়া। তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা চালান। তারও অভিজ্ঞতা হলো, ‘‘গ্রামের দিকে সম্পর্কের ছবিটা আলাদা। গাছের আম-কাঁঠাল, পুকুরের মাছ বা কোরবানির মাংস অথবা পুজোর আগে নারকেল দেয়া ও নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং সেটাই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল। কারো মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। ফলে পরিবেশটা ছিল অন্যরকম।’’  এখন বেশ কিছুদিন হলো গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছেন তিনি।

২০২২ সালে কোরবানি ঈদের আগে নতুন দিল্লিতে জামা মসজিদের সামনের চিত্র
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, উত্তেজনা নিয়ে প্রচুর ঘটনা ঘটলেও ঈদের দিনের চেহারাটা অন্যরকমছবি: Rouf Fida/DW

আশিস চক্রবর্তী হেতমপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। থাকেন শান্তি নিকেতনে। তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রচুর মুসলিম। তারা অনেকবার আশিসকে নেমতন্ন করেছেন ঈদে, বকরি ঈদে। তবে আশিসের কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় নেমন্তন্ন এসেছিল একজন টোটোচালকের কাছ থেকে। শান্তিনিকেতনে তিনি টোটো চালান। নিজের নাম বদল করে রেখেছেন আমন। হৃদ্যতা বাড়ার পর আমন আশিসের কাছে জানতে চান, বকরি ঈদের নেমতন্ন করলে তিনি কি আসবেন? আশিস জানান, অবশ্যই যাবেন। আমনের বাড়িতে গিয়ে সেই নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছেন আশিস।

এভাবেই এই সব ছোট ছোট ঘটনা সমানে অন্য এক জাল বোনে। সম্প্রীতির জাল, সৌহার্দ্যের জাল, সুসম্পর্কের জাল।

দিল্লিতে জাভেদ প্রতিবারই বকরি কেনেন। গতবার বকরি কিনে কাটাতে সবমিলিয়ে লেগেছে ১৫ হাজার টাকা। তারপর সেই মাংস তিনি নিজের জন্য যেমন রাখেন, তেমনই গরিবদের দেন, আর প্রতিবেশী-আত্মীয়-বন্ধুদেরও দেন। তারমধ্যে মুসলিমরা যেমন থাকে, হিন্দুরাও থাকে।

জাভেদ বলছিলেন, ‘‘কোরবানির ঈদ তিনদিন ধরে হয়। এই তিনদিন রোজা রাখা মানা। এই তিনদিন নিজেরাও খাও, খুশিতে থাক, গরিবদের দাও। আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশীদেরও দাও। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করার আলাদা তাৎপর্য আছে।’’

প্রায় প্রতিবছরই জামা মসজিদের পাশে পশু বাজারে যাই। বিকিকিনি দেখি। অনেক দাম দিয়ে গর্বিত মানুষ বকরি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এই দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে। বিক্রেতারা বোঝান, বকরির দাম কীসের উপর নির্ভর করে। কেন কোনো বকরির দাম বেশি হয়। ভালো লাগে এটা দেখতে, কেমন করে মানুষ লাখ লাখ টাকা খরচ করে বকরি নিয়ে যাচ্ছেন, শুধু নিজের জন্য নয়, সেই মাংস নিজে একভাগ রেখে বাকিটা তো অন্যদের দেয়া হবে। এই ভাবনা, অন্যকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবের এই রীতি, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এই উৎসেবর চেহারা দেখতে ভালো লাগে। মানুষের মুখের হাসির থেকে সুন্দর জিনিস কি আর কিছু আছে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য