কলকাতায় ‘শাসকের স্বার্থে' দু মাসের ১৪৪ ধারা?
২৮ মে ২০২৪তবে কলকাতা পুলিশ একে যথারীতি রুটিন কাজ বলে দাবি করেছে৷
লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফায় আগামী শনিবার কলকাতায় ভোটগ্রহণ৷ ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল' রবি ও সোমবারের প্রচারে জল ঢেলেছে৷ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় দেশ জুড়ে প্রচারের সমাপ্তি৷ ফলে হাতে রয়েছে আর মাত্র আড়াই দিন৷ এরই মধ্যেই কলকাতা পুলিশের এমন নির্দেশ৷ স্বাভাবিক কারণেই এর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
পুলিশের বিজ্ঞপ্তি
গত সপ্তাহে ২২ মে কলকাতা পুলিশ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে৷ তাতে বলা হয়, মধ্য কলকাতার একাংশে ১৪৪ ধারা জারি করা হবে দুই মাসের জন্য৷ ২৮ মে থেকে এই বিজ্ঞপ্তি কার্যকর হবে৷
কলকাতার নগরপাল বিনীত গোয়েলের স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৌবাজার ও হেয়ার স্ট্রিট থানার অন্তর্গত কেসি দাস মোড় থেকে ভিক্টোরিয়া হাউস পর্যন্ত এলাকায় ২৮ মে থেকে দু মাস কোনো জমায়েত করা যাবে না৷
১৪৪ ধারা অনুসারে পাঁচজন বা তার থেকে বেশি মানুষ সংশ্লিষ্ট এলাকায় জড়ো হওয়া বেআইনি৷ কারও হাতে অস্ত্র বা লাঠি থাকলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে৷ পুলিশের দাবি, সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত৷
যেদিন থেকে ১৪৪ ধারা কার্যকর হয়েছে, সেদিন, অর্থাৎ মঙ্গলবারই কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রোড শোকর্মসূচি৷ এমন দিনেই পুলিশের এই ১৪৪, যা বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বহাল থাকার কথা৷
প্রধানমন্ত্রীর রোড শোর কর্মসূচি উত্তর কলকাতায় দলীয় প্রার্থী তাপস রায়ের সমর্থনে৷ তাপস রায় সম্প্রতি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন৷
মঙ্গলবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও রোড শোর কর্মসূচি ঘোষণা করে তৃণমূল কংগ্রেস৷ সেটিও মধ্য কলকাতার বাইরে৷
বিরোধীদের তির
কলকাতা পুলিশের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে বিরোধীরা৷ তাদের বক্তব্য, ভোটের সময় প্রচারে বাধা তৈরি করাই এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য৷
বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কলকাতাকে লন্ডন করবেন বলেছিলেন৷ সেটা না হোক, কাশ্মীরের শ্রীনগর হয়ে উঠেছে এই শহর৷ সেখানেও বোধহয় টানা দুই মাস ধরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়নি৷''
তবে কলকাতা পুলিশের সেই এক কথা- এটা তাদের রুটিন পদক্ষেপ৷ ভিক্টোরিয়া হাউস ও ডালহৌসিতে নিয়মিত ১৪৪ ধারা জারি থাকে৷
পুলিশ জানায়, এর আগে চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি এবং গত বছরের ৩০ নভেম্বর, দুই মাসের জন্য কলকাতার ওই অংশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল৷ তাদের দাবি, এমন সিদ্ধান্ত তার আগেও তারা নিয়েছে৷ কিন্তু কলকাতা শহরে বছরে কমপক্ষে চার মাস ১৪৪ ধারা জারির দৃশ্যমান কোনো কারণের কথা পুলিশ উল্লেখ করেনি৷
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র শান্তনু সেনের কণ্ঠেও পুলিশের বক্তব্যেরই সুর, ‘‘সকলের জানা দরকার, ভিক্টোরিয়া হাউস, বিবাদী বাগ চত্বরে ১৪৪ ধারা জারি করা থাকে৷ দুই মাস পরপর এই নির্দেশ নতুনভাবে জারি করা হয়৷ এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রচার, প্রধানমন্ত্রীর শোভাযাত্রার সম্পর্ক নেই৷''
তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি জানালেন কলকাতায় যে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ এমন নির্দেশ আগেও দিয়েছে তা তিনি শোনেননি৷ তাই তার কণ্ঠে ঝরেছে বিস্ময়, ‘‘কিসের রুটিন নির্দেশ আমরা বুঝতে পারছি না৷ গত বছরও কি একই নির্দেশ জারি ছিল? তাহলে তৃণমূলের একুশে জুলাই এর সভা কী করে হলো? কীভাবে ধরনা অবস্থান করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷''
রাজ্যপালের সমালোচনা
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস পুলিশের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন৷ রাজভবন থেকে এই সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে৷
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘১৪৪ ধারা জারির সিদ্ধান্ত জনগণের স্বাধীনতাকে খর্ব করে৷ এই ধরনের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুসারে জারি করা যায় না৷ প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ নির্দেশিকা জারি করার আগে পর্যাপ্ত মাথা ঘামাননি৷ কোনো প্রকার বিবেচনা ছাড়াই ‘রুটিন' নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে৷''
১৪৪ ধারার আওতায় রাখা এলাকায় অন্যান্য সময় গুরুত্বপূর্ণ ও বড় আকারের রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়৷ ধর্মতলার ভিক্টোরিয়া হাউস চত্বরে প্রতি বছর ২১ জুলাই তৃণমূল কংগ্রেস শহিদ দিবস পালন করে৷ এটা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি৷
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্য কলকাতায় ধরনায় বসেছিলেন৷
রাজ্যের সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমি কয়েক বছর কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম৷ রাজভবন, মহাকরণের আশপাশে সারা বছর ১৪৪ ধারা জারি থাকতো৷ কিন্তু মধ্য কলকাতায় জারি করা হতো বলে আমার জানা নেই৷ পয়লা জুন কলকাতায় ভোট আছে৷ সেজন্য জারি করা হতে পারে৷''
বিতর্কে ১৪৪
নির্বাচনের প্রথম পাঁচটি দফা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় নির্বিঘ্নে কেটে গেলেও ষষ্ঠ দফায় সহিংসতা দেখা যায়৷ কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতিতেই ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়, বিজেপির এক প্রার্থীকে তাড়া করা হয়, ফাটিয়ে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় বাহিনির এক সদস্যের মাথা৷
ষষ্ঠ দফার ভোটে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত গড়বেতায় বুথের কাছে তৃণমূল সমর্থকরা জড়ো হয়েছিলেন৷ বিজেপি প্রার্থী প্রণত টুডু সেখানে উপস্থিত হলে তাকে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়৷ প্রার্থীর নিরাপত্তায় থাকা জওয়ানের মাথা ফাটে ইটের ঘায়ে৷
সাবেক আইপিএস নজরুল ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনে দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লাঠি, বাঁশ হাতে৷ সেক্ষেত্রে ১৪৪ ধারা ভেঙে ৫০-১০০ জন জড়ো হচ্ছে৷ কিন্তু দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷''
এই ছবি যখন দেখা যাচ্ছে, তখন কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে কেন পুলিশ প্রশাসনের এমন তৎপরতা, এই প্রশ্ন তুলছে মানবাধিকার সংগঠনও৷
মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূরের প্রশ্ন, ‘‘মধ্য কলকাতায় সাম্প্রতিককালে কোনো অশান্তি হয়নি৷ তাহলে কেন টানা দু মাস ১৪৪ ধারা জারি থাকবে?''
এপিডিআর-এর সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত বলেন, ‘‘১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং মিছিল বন্ধ করা গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ৷ এই ধারা টানা দু মাসের বেশি জারি করা যায় না৷ তাই বাম সরকার প্রতি দুই মাস অন্তর এই নির্দেশ রিনিউ করতো৷ এখনো সেই পরম্পরা চলছে৷ এটা একেবারেই শাসকের স্বার্থে আইনের প্রয়োগ৷''