1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

১৪৪ ধারা কি রাজনৈতিক হাতিয়ার?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৫ অক্টোবর ২০২২

দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারার ব্যবহার বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে এর ব্যবহার আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

https://p.dw.com/p/4IfPD
Bangladesch Zusammenstöße in Dhaka
বাংলাদেশ পুলিশ (ফাইল ফটো)ছবি: Bdnews24.com

গত দুই মাসে দেখা গেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একাধিক জেলা ও উপজেলায় একই দিনে, একই সময়ে, একই জায়গায় সমাবেশ ও কর্মসূচি দিয়েছে। ফলে "শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষায়” প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। বিএনপির অভিযোগ তাতে বিএনপির সমাবেশ পন্ড হয়ে গেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিরোধীদের সমাবেশ পন্ড করা বেশ সহজ হয়ে গেছে। পাল্টা সমাবেশ ডেকে দিলেই হলো। বাকিটা ১৪৪ ধারার কাজ। তাই এই ধারার অপব্যবহার নিয়ে যেমন প্রশ্ন  আছে তেমনি ধারাটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাও স্পষ্ট। 

বিএনপি দাবি করছে, গত ২২ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দেশের ২৫টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে তাদের সমাবেশ পন্ড করা হয়েছে। তারা আগে সমাবেশ ডাকার পর ওই একই স্থানে আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগি সংগঠন পাল্টা সমাবেশ ডেকে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ১৪৪ ধারা জারি করিয়ে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়নি। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স অভিযোগ করেন,"আগস্ট থেকে আমরা যে কর্মসূচি পালন করে আসছি তা বাধাগ্রস্ত করতে সরকার নানা কৌশল নিয়েছে। এর একটি হলো আমরা যেসব জায়গায় সমাবেশ ডেকেছি তার বেশ কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। আর তাতে ১৪৪ ধারা জারি করে আমাদের সমাবেশ পন্ড করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে আইনটির অপপ্রয়োগ এবং আমাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপরও মানুষকে আটকানো যাচ্ছে না।”

এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন,"বিএনপির এই অভিযোগ মিথ্যা। তারা ইচ্ছে করে শোকের মাস আগস্টে তাদের কর্মসূচি শুরু করেছে। আমাদের সারাদেশেই পূর্ব ঘোষিত সমাবেশ ও কর্মসূচি ছিলো। তারা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার জন্য এটা করেছে। ”

‘আমাদের কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার নানা কৌশল নিয়েছে’

তিনি বলেন,"এখন আবার ডিসেম্বর মাসে তারা মহাসমাবেশ করবে। বিজয়ের মাসে জাতি বিজয় উৎসব পালন করবে।  তখন তারা বলবে আমাদের কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হচেছ না। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে তারা খালেদা জিয়াকে নেবে। তিনি তো দণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি। এটাও তারা করার চেষ্টা করছে ঝামেলা পাকানোর জন্য।”

১৪৪ ধারার ব্যবহার বাড়ছে:

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, চলতি বছরে ১৪৪ ধারা প্রয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, রাজনৈতিক উত্তাপ যত বাড়বে ১৪৪ ধরার ব্যবহার তত বাড়ার আশঙ্কা আছে। আসকের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই নয় মাসে দেশের ৩৪টি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর আগের পুরো এক বছরে ২০২১ সালে ২০ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারির তথ্য দিয়েছে তারা। ২০২০ সালে ১৭ জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো।

১৪৪ ধারা ও সংবিধান:

বাংলাদেশের  সংবিধানের ৩৬ এবং ৩৭ অনুচ্ছেদে চলাফেরা এবং সামাবেশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।

সংবিধানে এই অধিকার ও স্বাধীনতা দেয়া হলেও ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির কয়েকটি ধারায় এর ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৪৪ ধারা অন্যতম। ওই ধারা গণ-উপদ্রব নিবারণকল্পে বা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছু নির্দেশ দেয়ার অধিকার দিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট যখন বুঝতে পারেন যে, গণ-উপদ্রব গুরুতর আকার ধারণ করতে যাচ্ছে অথবা এমন মারামারি বা দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে যাতে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতির আশঙ্কা আছে সে অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন। যার ফল হল সমাবেশ বা জন চলাচল  নিষিদ্ধ করা। আর এটা ম্যাজষ্ট্রেট করবেন ১৩৪ ধারা অনুযায়ী নোটিস ও বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ফৌদজারি কার্যবিধির ১৪৫ ধরায়ও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে।

জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত কেউ ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন। মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারও এই ধারা জারির জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আর এর সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে ৬০ দিন পর্যন্ত। যারা এই আইন জারি করবেন তারা কার্যকর করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা পাবেন।

‘বিএনপি ইচ্ছে করে আগস্টে তাদের কর্মসূচি শুরু করেছে’

আইন বিশ্লেষকেরা যা বলেন

বৃটিশ আমলের এই আইনটি তখনো প্রধানতঃ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো। আর এখনো প্রধানত সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান দুলু বলেন,"১৪৪ ধারা একটি ডিসক্রিশনারি পাওয়ার। এটা নিশ্চিত না হয়ে প্রয়োগ করা যাবেনা। এখন এক দল এক জায়গায় সমাবেশ ডাকলে আরেক দল যদি ডাকে তাতে আগেই শান্তি-শৃঙ্খলা বা জীবন ও সম্পদ বিনষ্টের আশঙ্কা করার সুযোগ নেই। পাশাপাশি একই সময়ে সমাবেশ বা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের বহু উদাহরণ আমাদের দেশে আছে। আর সবার আগে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ব্যবস্থা করা হচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ। সেই ব্যবস্থা না করে ১৪৪ ধারা জারি করা গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি মনে করেন,"উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো দল যদি বার বার আরেকটি দলের সমাবেশ বা কর্মসূচির  একই জায়গায়, একই সময়ে কর্মসূচি দেয় সেটা তো বেআইনি এবং সংবিধানের লঙ্ঘন। পুলিশ প্রশাসনের উচিত সমাবেশ করার স্বাধীনতা এবং অধিকার নিশ্চিত করা এবং যারা এটার জন্য বাধা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।”

আর সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,"বৃটিশ আমল থেকে এবং বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই এই আইনটি অপপ্রয়োগ হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিরোধী পক্ষকে দমন করতে কাজে লাগানো হয়েছে। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এখন দেখছি এর অপব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করি।”

তার কথা,"১৪৪ ধারা, কারফ্যু সত্যিকার অর্থেই মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু কারুর অধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে যারা অধিকার  উল্টো লঙ্ঘন হয় তার বিরুদ্ধেই এখন এই আইনটির ব্যবহার দেখছি। এর ফলে কারুর ক্ষমতা থাকলেই এই কৌশলে অন্যের বৈধ কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে পারে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ  শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ডাকলে সেটা যাতে ঠিকমত হয়, কেউ যাতে  বাধা না দিতে পারে তার ব্যবস্থা করার কথাই আইন ও সংবিধানে বলা আছে।”