পাকিস্তানকে উড়িয়ে ভারতের বিশ্বকাপে তিনে তিন, আটে আট
১৪ অক্টোবর ২০২৩আহমেদাবাদে একপেশে লড়াইয়ে পাকিস্তানের ছুঁড়ে দেওয়া ১৯২ রানের লক্ষ্য ৩০.৩ ওভারেই টপকে ভারত পেয়েছে ৭ উইকেটের জয়৷ বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত আটবার মুখোমুখি এই দুইদল৷ আহমেদাবাদে অষ্টম ম্যাচে শুরু আগে আলোচনায় ছিল, এবার কি প্রথম জয়ের দেখা পাবে পাকিস্তান নাকি নিজেদের মাটিতে আরেকটি জয় ছিনিয়ে এনে পার্থক্য বাড়াবে ভারত৷
পার্থক্য বাড়ালো ভারতীয় ক্রিকেট দল৷ নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ১৪ অক্টোবর মাঠে নামার আগে বিশ্বকাপে দুই দলের মুখোমুখি ম্যাচের পরিসংখ্যানের পুরোটাই ভারতের দিকে৷ অর্থাৎ ভারত ৭, আর পাকিস্তান ০৷ সেই ব্যাবধান বেড়ে এখন ৮-০৷ আর চলতি বিশ্বকাপে ভারতের তিনে তিন, অর্থাৎ তিন ম্যাচের তিনটিতেই জয় হাতিয়ে নিয়ে জানান দিল, বিশ্বসেরা হওয়া দৌড়ে অন্যতম তারা৷
কত আয়োজন এই ম্যাচের জন্য! বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা থেকেই উত্তুঙ্গু অপেক্ষা ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের, আহমেদাবাদের ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের একটি টিকিটের জন্য কত হাহাকার! বিরাট কোহলি-সূর্যকুমারদের মতো ক্রিকেটারদেরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিকিটের জন্য অনুরোধ না করার জন্য অনুনয় করতে হয়!
আহমেদাবাদে তাই ম্যাচ শুরুর আগে খালি থাকে না হোটেল, দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শকদের জায়গা নিতে হয় হাসপাতালের বেডে৷ টিকিটের দাম যায় লাখ ছাড়িয়ে, গ্যালারিতে তারার মেলা৷ এই ম্যাচের জন্যই হয় আলাদা অনুষ্ঠান, যেখানে বিশ্বকাপেই হয়নি কোনো উদ্বোধনী আয়োজন৷ ভারত জেতায় দর্শকদের মন ভরেছে, গ্যালারিতে তেরঙ্গা পতাকা উড়েছে অগুণিত, কিন্তু এমন একতরফা ম্যাচে নিরপেক্ষ দর্শকদের মন ভরল কই?
অবশ্য বিশ্বকাপের ইতিহাস জানলে এমন ফলটা আসলে বিস্ময়কর তো নয়ই, বরং প্রত্যাশিত৷ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সাতবারের দেখায় কখনো ভারতকে হারাতে পারেনি পাকিস্তান, শনিবারের জয়ে আটে আট হলো ভারতের৷ দুই দলের আগের দেখায়ও যে হাড্ডাহাডি লড়াই হয়েছে, ব্যাপারটা এমনও নয়৷ তারপরও এভাবে খড়কুটোর মতো পাকিস্তান উড়ে যাবে, কে জানত?
এমনকি পাকিস্তানের ইনিংসের মাঝামাঝি এসেও তো এমন কিছু হবে, সেটা অভাবিত ছিল৷৩০ ওভারের কাছাকাছি এসে ২ উইকেটে পাকিস্তানের রান যখন ১৫৫, বাবর আজম তখন সবে ফিফটি পেরিয়েছেন৷ মোহাম্মদ রিজওয়ানও উইকেটে থিতু৷
টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে আব্দুল্লাহ শফিক ও ইমাম উল হককে হারানোর পরও তাদের মোটেই অখুশি বলা যাবে না৷ সব ধরনের পূর্বাভাসে পাকিস্তানের রান তখন অন্তত ৩০০র কাছাকাছি ভাবা হচ্ছিল৷ কে জানত, সেখান থেকে ব্যাখ্যাতীত এক ব্যাটিং ধসে শেষ ৩৬ রান তুলতেই ৮ উইকেট হারাবে তারা?
পাকিস্তানের বিপর্যয়ের শুরুটা ভারতীয় বোলার মোহাম্মদ সিরাজের হাত ধরে৷ সিরাজের গুড লেংথ ডেলিভারির বলটা বাবর খেলতে গিয়েও মিস করলেন পুরোপুরি৷ বল ভেঙে দিল স্টাম্প, নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম ফেটে পড়ল গগনবিদারী উল্লাসে৷ ম্যাচের মোড় ঘুরে গেল সেখানেই৷
বাবরের আউট যদি হয় সতর্ক সংকেত, এরপর মহাবিপদসংকেত হয়ে এলো তিন ওভার পর কুলদীপের ওভারটি৷ প্রথমে সেই ওভারের দ্বিতীয় বলে ৬ রানে এলবিডব্লু হলেন সৌদ শাকিল৷ আম্পায়ার আউট না দিলেও ডিআরএস নিয়ে ভারত পেল উইকেট৷ এরপর ওই ওভারে্র শেষে আবার আঘাত কুলদীপ ও ভারতের, এবার ইফতিখার সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন৷ ১৬৬ রানে ৫ উইকেট নেই পাকিস্তানের৷
এরপর মঞ্চটা নিজের করে নেওয়ার পালা আহমেদাবাদের ঘরের ছেলে জাসপ্রিত বুমরার৷ দুর্দান্ত একটা অফ কাটারে ভেঙে দিলেন রিজওয়ানের স্টাম্প, ইনফর্ম পাকিস্তান ব্যাটার থেমে গেলেন ৪৯ রানে৷ এক ওভার পর আরেকটি দুর্দান্ত ডেলিভারিতে বোল্ড করলেন শাদাব খানকে৷ ২ উইকেটে ১৫৫ রান থেকে ১৭১ রানে ৭ উইকেট নেই পাকিস্তানের৷
পাকিস্তানের মোহাম্মদ নওয়াজ ও হাসান আলীও আসা যাওয়ার মিছিলে অংশ নিয়ে ফিরে গেলেন দ্রুত৷ শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে হারিস রউফ যখন ফিরে গেলেন, পাকিস্তান তুলেছে কেবল ১৯১ রান৷ ‘দশে মিলি করি কাজ' মন্ত্রে দীক্ষিত ভারতের বুমরা, সিরাজ, কুলদীপ, পান্ডিয়া, জাদেজাদের সবাই নিয়েছেন দুইটি করে উইকেট৷
একটা দল ১৯১ রান করার পর আসলে ম্যাচের ভাগ্য নিয়ে সংশয় থাকে না৷ তারপরও ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা হিসেবে পাকিস্তান সমর্থকদের যদি কোনো আশাও থাকে, সেটাও ভেস্তে গেছে দ্রুত৷ ভারত ইনিংসের প্রথম বল থেকেই বার্তা দিতে শুরু করে, এই ম্যাচে তাদের শুধু জয় পেলেই হবে না- চাই দাপুটে জয়, প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া জয়৷
রোহিত শর্মা আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচটা যেখান থেকে শেষ করলেন, আজ যেন শুরু করলেন সেখান থেকে৷ প্রথম বলেই শাহীন শাহ আফ্রিদিকে চার মেরে শুরু করলেন দ্বৈরথের দ্বিতীয় ইনিংস৷ শুভমান গিলের ব্যাটেও একই সুর, তিনিও মুখোমুখি প্রথম বলে চার মেরে জানান দিচ্ছিলেন, অসুস্থতা কাটিয়ে ফিরছেন স্বরূপে৷
তবে গিলের আগ্রাসন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ শাহীন আফ্রিদির অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা মারার মতোই ছিল, কিন্তু গিলের শট খুঁজে নিল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে থাকা শাদাব খানকে৷ ১১ বলে ১৬ রানে ফিরলেন গিল৷
রোহিতের ব্যাট তখন খাপখোলা তলোয়ার হয়ে কচুকাটা করতে শুরু করেছে বোলারদের৷ শুরুতে ঝড়টা বেশি গেছে শাহীনের ওপর দিয়েই, তার এক ওভারে দুই চারের পাশাপাশি মেরেছেন ছয়৷ হারিস রউফ এসেছেন, কিন্তু তাকেও দুই ছয়ে সম্ভাষণ জানিয়েছেন রোহিত৷ এরমধ্যে ওয়ানডেতে তার ৩০০তম ছয়ও হয়ে গেছে৷ অন্য পাশে কোহলি তাকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন কেবল, মাঝে একবার রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া দুজনকে আউট করার মতো তেমন কিছুও করতে পারেনি পাকিস্তান৷
শেষ পর্যন্ত কোহলি আউট হয়ে গেলেন খেলার ধারার বিপরীতেই, হাসান আলীকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ফিরলেন ১৮ বলে ১৬ রান করে৷ তখনই অবশ্য ৭৯ রান তুলে গন্তব্যের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে ভারত৷
রোহিত এদিকে মূর্তিমান ত্রাস হয়ে পাকিস্তান বোলারদের শায়েস্তা করে যাচ্ছিলেন৷ এক শাদাবই বাকি ছিলেন তার ঝড় থেকে, তাকেও চার-ছয় মেরে ঢুকে পড়েছেন আশির ঘরে৷ অবশ্য এর আগে ৩৬ বলে তার ফিফটি হয়ে গেছেভ৷ যখন মনে হচ্ছিল টুর্নামেন্টে টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি আর বিশ্বকাপে রেকর্ড অষ্টম সেঞ্চুরিও হয়ে যাবে, শাহীনের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে মিসটাইম করে ক্যাচ দিলেন ইফতেখারকে৷ ৬৩ বলে ৮৬ রানের ইনিংসটা ম্যাচের ভাগ্য অবশ্য প্রায় লিখেই দিয়েছে৷ বাকি কাজটা শেষ করে আসতে সমস্যা হয়নি শ্রেয়াস আইয়ার ও কেএল রাহুলের৷
শেষ পর্যন্ত ১৯.৩ ওভার বাকি থাকতেই জয় পেয়ে গেছে ভারত৷ টানা তিন জয়ের সাথে রান রেটও বাড়িয়ে নিয়েছে অনেকটা৷ জানান দিয়েছে, এই বিশ্বকাপে তাদের হারাতে হলে প্রতিপক্ষকে করতে হবে অতিমানবীয় কিছু৷ আর টানা দুই জয়ের পর পাকিস্তানের ছুটতে থাকা গাড়ি ব্রেক ফেল করল আহমেদাবাদে এসে৷
পাকিস্তান ৪২.৫ ওভারে ১৯১ (বাবর ৫০, রিজওয়ান ৪৯; বুমরা ২/১৯, পান্ডিয়া ২/৩৪)
ভারত ৩০.৩ ওভারে ১৯২/৩ (রোহিত ৮৬, আইয়ার ৫৩*; শাহীন ২/৩৬)
ফল: ভারত ৭ উইকেটে জয়ী