জোড়াতালি আর গোঁজামিলের বিআরটি
১৬ আগস্ট ২০২২তারপরেও চলছে কাজ৷ তবে ছিল না সঠিক তদারকি আর নজরদারি৷ ফলে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা৷
বিআরটি হলো শহরের কোনো রাস্তার মাঝ দিয়ে ডেডিকেটেড একটা লেন তৈরি করে সেখান দিয়ে বিশেষায়িত বাস চালানো৷ ঐ রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি ঢুকতে পারে না৷ আর এই বাস শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া থামে না৷ ফলে যাত্রীরা দ্রুত এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাচল করতে আর৷
বিআরটি ঘনবসতি আর বিশৃঙ্খল শহরে অনেক কার্যকর৷ আবার এর খরচও স্বল্প৷ তাই ২০০৮ সালে ঢাকায় বিআরটি করা যায় কিনা সে ব্যাপারে সমীক্ষা করা হয়৷ সমীক্ষা শেষে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রাস্তা বাছাই করা হয়৷ সকল বিবেচনায় সেটা ছিল ফিজিবল৷ কিন্তু পরবর্তীতে বাধ সাধে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতু৷ এর ফলে বিআরটির রুট কমিয়ে আনা হয়৷ ফলে এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা হারায়৷ এটি আর ফিজিবল থাকে না৷ কিছু বিশেষজ্ঞ সে সময় এই প্রকল্প বাতিলের কথা বলেন৷ তবে সরকার পরবর্তীতে বিআরটির রুট গাজীপু্র পর্যন্ত বৃদ্ধি করে এর যৌক্তিকতা দেখানো হয়৷
এর পর কাজ শুরু হলে তা চলে ধীরগতিতে৷ তবে শহর ও শহরের বাইরের গন্তব্য নিয়ে কখনও বিআরটি করা হয়৷ প্রশ্ন উঠে গাজীপুর থেকে মানুষ বিআরটির বাসে এসে বিমানবন্দরে বিপদে পড়বে৷ কেউ যদি মতিঝিল যেতে চায় তাহলে তাকে আবার যানবাহনের সেই ঝক্কির মধ্যেই পড়তে হবে৷ আস্তে আস্তে বিআরটি তার যৌক্তিকতা হারায়৷
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক যিনি অনেক প্রকল্পের মতো বিআরটি প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে থাকেন তিনি বিআরটি নিয়ে হাতাশা ব্যক্ত করেন৷ আদৌ এটা বিআরটি হবে কিনা সেটাই তার কাছে বড় প্রশ্ন৷
‘‘এটা নামে বিআরটি৷ এর সাথে অনেক কিছু যোগ করে জোড়াতালি দিয়ে অন্য কিছু বানানো হচ্ছে৷ ফলে এ থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাবার কথা তা যাবে না,'' বলছিলেন অধ্যাপক হক৷
তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে যে কারণে এই প্রকল্পটি ফিজিবল হয়েছিল সেটা আর নাই৷ অরিজিনালি এই প্রকল্পের রুট ছিল বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল৷ তখন এটাকে দ্রুত যাত্রী বহনের জন্য উপযুক্ত মনে করেছিল সবাই৷ কিন্তু এই অরিজিনাল রুট আর নাই, এটাকে কেটে ছোট করা হয়েছে৷ নতুন রুট হয়েছে গাজীপুর-বিমানবন্দর৷''
তার মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে বাইরে থেকে এসে ঢুকেছে এমন ফ্রাগমেন্টেট বিআরটির কোনো উদাহরণ নাই৷ বিআরটির জন্মটাই হচ্ছে পা কাটা, হাত কাটা, বাপ-মা নাই৷ অরিজিনাল রুট দেখিয়ে ফিজিবল করেছিলাম কিন্তু সে অরিজিনাল বিআরটি আর নাই৷ তাই এটা আর ফিজিবল প্রকল্প না৷ মানে অল্প বাসে দ্রুত যাত্রী পরিবহনের যে বিষয়, সেটা আর হচ্ছে৷
এদিকে ১৩০টি এসি বাস কেনার পরিকল্পনা হয়েছে বিআরটি রুটে চালানো জন্য৷ কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি) বাস চালানো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই বাসে মানুষ কীভাবে উঠা-নামা করবে?
বিআরটির বাসে দরজা থাকে উল্টা দিকে৷ অর্থাৎ যাত্রীদের রাস্তার মাঝখান থেকে বাসে উঠতে হয়৷ কিন্তু বিআরটিসির বাস উঠতে হলে বাস বিআরটি লেন থেকে বের হয়ে ফুটপাতে আসতে হবে৷ ফলে এটা অন্য রাস্তার মতোই হয়ে যাবে৷
অধ্যাপক হকের মতে, আমাদের শহরের যে অবস্থা৷ যানজটের কারণে মানুষ বিআরটি লেনে ঢুকে পড়বে এবং কর্তৃপক্ষ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে মনে হয়৷ এতে রাস্তায় আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলে মনে হয়৷
শুধু বিআরটি নয়, বরং বাংলাদেশে প্রায় সব প্রকল্পই সমীক্ষা ভালোমতো হয়৷ প্রকল্প শুরুর আগে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করে সেগুলোর সমাধান ঠিক করা৷ এছাড়াও জনগণের টাকা যৌক্তিকভাবে খরচ হচ্ছে কিনা সেটা ভালোভাবে যাচাই করতে হয়৷ এটা হয় না বলেই প্রকল্পের কাজ আরম্ভ হলে একটার পর একটা সমস্যা দেখা দেয়, সময় বাড়ে আর সাথে খরচও৷
২০০৮ সালে সমীক্ষা শুরু হলেই ২০১২ সালে ২,০৩৭ কোটি টাকার প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়৷ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বারবার সময় বাড়িয়ে এ বছরের মধ্যে শেষ করার কথা৷ তবে এখন প্রকল্পের ২২ শতাংশ কাজ বাকি থাকায় আগামী বছরের জুলাইয়ে শেষ হবে বলে জানা যায়৷ আর এর মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ বেড়ে যায়৷
‘‘এক্ষেত্রে সরকারের মূল্যায়নের একটা ব্যাপার আছে৷ সব প্রকল্প কী কারণে দেরি হয়, বাস্তবায়ন কেন ঠিকমতো হয় না, খরচ কেন বাড়ে বিষয়গুলো সরকারের উচিত,” মনে করেন অধ্যাপক শামসুল হক৷
প্রতিবেদন : এম আবুল কালাম আজাদ (ঢাকা)