যাত্রীবান্ধব গণপরিবহণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ
২২ জুলাই ২০২২উন্নত যোগাযোগের জন্য বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলের মতো বড় বড় প্রকল্প৷ কিন্তু এর মাঝেই যাত্রী কল্যাণের বিষয়টি ঘুরেফিরে আটকে যাচ্ছে অজানা বৃত্তে৷ কেন?
গত ১৩ জুন ট্রেনের টিকেট কিনতে গিয়ে ‘প্রতারণার শিকার হন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি৷ পরে ৭ জুলাই থেকে তিনি অবস্থান নেন কমলাপুর রেল স্টেশনে৷
ছয় দফা বাস্তবায়নে তার স্মারকলিপির জবাবে দাবি মানার আশ্বাস দেয় রেল কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নন রনি৷ তিনি বরং বলছেন, একজন বাবা বাচ্চাদেরকে যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বোঝান, রেলের মহাপরিচালকও সেভাবে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘উনার কথার টোন আমার ভালো লাগেনি৷ উনার কাছে নাকি কেউ অভিযোগও জানায়নি৷’’
অভিযোগ জানাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতি চালিয়ে নিতে অভিযোগ জানানোর পথ রেল কর্তৃপক্ষ বন্ধ করতে চায়৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন রনি জানান, আন্দোলনের বিষয়টি শুরুতে তার মাথায়ও আসেনি৷ কেবল চেয়েছিলেন, তার সাথে যেটা ঘটেছে, সেটা যেন আর কারো সাথে না ঘটে৷ এর জন্য তিনি নানাভাবে চেষ্টা করে গেছেন, শেষ পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছেন কমলাপুরে৷ দুইদিনের মাথায় পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করলে এটি আন্দোলনে রূপ নেয়৷
এরই মাঝে রনির অভিযোগের ভিত্তিতে শুনানির পর গত ২০ জুলাই রেলওয়ের টিকেট বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি সহজ ডটকমকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর৷ এই জরিমানার টাকার ২৫ শতাংশ পাবেন রনি৷
এদিকে বিষয়টিতে হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করেছে৷ শুনানির এক পর্যায়ে ট্রেনের ছাদে যাত্রী পরিবহণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশও দিয়েছে আদালত৷ বিষয়টি এখনো বিচারাধীন থাকায় আদালত থেকে যাত্রী কল্যাণে আরো নির্দেশনা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
তবে রনি এখন আর নিজের কথা ভাবছেন না৷ তিনি ভাবছেন দেশের সব যাত্রীর কথা৷ তাই আন্দোলনের মাধ্যমে রেল খাতে অব্যবস্থাপনা দূর করেই ঘরে ফিরতে চান তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী একবার আশ্বাস দিক যে, দাবিটি মানা হবে৷ এরপর আমরা তার পাশে থেকে এমনভাবে কাজ করবো, যাতে তার স্টেটমেন্ট ব্যর্থ না হয়৷’’
‘‘প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিলে আমরা ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকরা বসে সমাধানের পথ বের করবো৷ আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবো৷ আমি ছাড়ার পাত্র নই৷”
রেল মন্ত্রণালয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলনের৷ মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় এবং তার পরে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন, শামিল হয়েছেন অন্যদের সাথেও৷ কালোবাজারি দূর করা, টিকেট যার ভ্রমণ তার- নীতি প্রয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় তিনি৷
তিনি মনে করেন, টিকেটের কালোবাজারি দূর করতে না পারলে যাত্রীকল্যাণের বড় অংশই নিশ্চিত হবে না৷ টিকেটের টাকা ‘রিফান্ড' নিশ্চিত করতে হবে এবং সম্ভব হলে সেটাও অনলাইনে করতে হবে৷
তার মতে, যার নামে টিকেট কেনা হবে, তাকেই ভ্রমণ করতে হলে কালোবাজারি দূর হবে৷ তার দাবি, ‘‘এনআইডি ভ্যারিফিকেশন করে টিকেট দিতে হবে৷ অনবোর্ড সেভাবেই টিকেট চেক করতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘যাত্রীর নামে টিকেট কিনতে হলে কালোবাজারিরা কার নামে কিনবে, কার কাছে বিক্রি করবে৷ এই পয়েন্টকে কাজে লাগিয়েই এটা বন্ধ করতে হবে৷ ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়া এই দুর্নীতি অন্য কোনোভাবে, যেমন, কালোবাজারিদের ধরে বন্ধ করা সম্ভব না৷’’
পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কথাই ঘুরে ফিরে বলেন মাহবুব কবীর৷ তিনি বলেন, ‘‘এক সময় রেলের তেল চুরি হতো৷ ফুয়েল ট্র্যাকার বসানোয় এখন ট্রেনে কতটুকু তেল আছে, সেটা অফিসে বসেই দেখা যায়৷ সেসব ট্রেনে তেল চুরি বন্ধ হয়ে গেছে৷’’
হাই কোর্টের আদেশে আশার নতুন দিশা পাওয়ার কথা জানিয়ে মাহবুব কবীর বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, আগামী ঈদে এখনকার পরিস্থিতি থাকবে না৷’’ রেলের টাইম ঠিক করা, গতি ঠিক করার মতো কাজও সম্ভব বলে মনে করেন তিনি৷
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ট্রেনে যাত্রী দুর্ভোগ সম্পর্কে বলেন, ‘‘ট্রেনে দীর্ঘদিন যাবত একটা ভয়ানক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে৷ কালো বিড়ালের কবল থেকে যতক্ষণ রেলকে মুক্ত করা যাবে না, ততক্ষণ জনগণের প্রত্যাশিত রেল হবে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ক্রয়-বিক্রয়ে লুটপাট এবং টিকেটের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে৷ চলমান আন্দোলনে জনগণকে আরো সম্পৃক্ত করতে হবে৷ আন্দোলনকে বড় করে বড় ধাক্কা দিতে না পারলে এটা সম্ভব হবে না৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বালতির তলা ফুটো করে উপর থেকে পানি ঢাললে যে অবস্থা হয়, রেলে গত এক যুগ ধরে এভাবেই কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে৷ সে কারণে সুফল মিলছে না৷’’
সড়ক যোগাযোগে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতেও অনেক কাজ বাকি বলে মনে করেন তিনি৷ এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘‘বেসরকারি পরিবহণ মালিকদের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এ কারণে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নৈরাজ্য বন্ধ করা, জনগণের প্রত্যাশিত গণপরিবহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না৷ আমরা মনে করি, সরকারের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে৷ বেসরকারি মালিকদের বাস থাকবে৷ কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণে তা পরিচালিত হবে৷’’
ঢাকায় কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার ওপরও জোর দেন তিনি৷
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মো. শামসুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উন্নয়ন থেকে ফোকাসটা সরিয়ে যাত্রীবান্ধব অপারেশন এবং ব্যবস্থাপনায় নজর দেয়া উচিত৷ সরকারের সব পর্যায়ে সবাই ‘উন্নয়ন ফোকাসের' মধ্যেই আছে৷ রেল তো চাইতেই পারে, আরো লক্ষ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু এর আগে গত ১০ বছরের বিনিয়োগের মূল্যায়ন হওয়া উচিত৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সবাই সিস্টেমের বেনিফিশিয়ারি৷ ট্রান্সফার অব টেকনোলোজির নামে যে দপ্তরের প্রজেক্ট, এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যতগুলি সংস্থা জড়িত, প্রত্যেকেই ভাগবাটোয়ারায় সরাসরি যুক্ত৷’’
‘‘মন্ত্রী যখন বলেন, রেল প্রফিটের জন্য বসেনি৷ পরের প্রশ্ন হলো, উনি যখন প্রকল্প নিয়েছেন, তখন কি বলেছেন যে, আমি যদি এই প্রকল্প নেই, তাহলে আমি লোকসানে পড়বো? এই লোকসান ধরেই প্রকল্প পাস করানো? তা বলেন নাই৷ সুন্দর সুন্দর কথা বলেই কিন্তু প্রকল্পের অনুমোদন নিয়েছেন৷ এখন কেউই এটার দায়িত্ব নিচ্ছে না৷ না মন্ত্রণালয়, না সংসদীয় কমিটি, না প্ল্যানিং কমিশন৷’’
"প্রজেক্ট পাস হওয়ার পর আমি যখন চালাতে পারি না, তখন আমি সুন্দরভাবে বলে ফেলছি, রেল এখানে প্রফিটের জন্য বসে নাই৷ এই ধরনের স্পর্ধার কথা যখন রাষ্ট্রের সামনে বসে, তখন বুঝতে হবে, চেইন অব কমান্ডের মধ্যে দায়িত্ব বুঝে নেয়ার কেউ নাই৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এখানে রাজনৈতিক একটা দৃঢ় প্রত্যয় লাগবে যে, এত হাজার কোটি টাকা দিলাম, ১০-১২ বছর পর এখন মূল্যায়নের সময় এসেছে৷ সব কাজ করতে হবে দায়বদ্ধভাবে৷ শিখিয়ে যাওয়া কথা বলে সরকার কিন্তু আর বেশিদিন যেতে পারবে না৷’’
গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, ‘‘তিনটা মাধ্যমের মধ্যে রেল বিনিয়োগ বঞ্চিত ছিল, সেখানে সরকার দয়াপরাবশ হয়ে, বিচক্ষণ হয়ে বিনিয়োগ করেছে৷ অনেক উন্নয়ন দিয়েছে৷ এখানে ডেলিভারি এন্ডে পারফর্ম্যান্স দেখা ম্যান্ডেটরি হয়ে গেছে৷ জবাব না পেলে আর বিনিয়োগ দেয়া উচিত হবে না৷ এই কথাগুলো যারা বলবেন, তাদের ইনার স্ট্রেন্থ নেই৷ কারণ তারাও বেনিফিশিয়ারি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এত উন্নয়ন দেখছে, কিন্তু সার্ভিস তলানিতে চলে গেছে৷ রেলকে প্রচুর রিফর্ম করতে হবে৷ রেল শতভাগ সরকারি৷ সরকার এখানে সেবা দিতে পারে না৷ এটা সরকারকে আগে বুঝতে হবে৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি রেলের বেসরকারিকরণের কথাও বলেন৷
তিনি বলেন, ‘‘একটা বাস কোম্পানি থাকলে ঢাকার ড্রাইভাররাও ভদ্র হয়ে যাবে৷ বড় বড় কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়ে রেগুলেশন শক্ত করলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ গ্রামীণ ফোনের মতো কোম্পানি যদি এখানে থাকতো, তাহলে তাকে ডেকে এনে হাজার কোটি টাকা জরিমানা করা যেতো৷ কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষতিকেও বিবেচনায় নিতো৷’’
গণপরিবহণের ভোক্তাদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান
গণপরিবহণ ব্যবহারকারী ভোক্তাদের সক্রিয় ও সচেতন হওয়া ছাড়া যথাযথ সেবা নিশ্চিত হবে না বলেও আলোচনা এসেছে ঘুরে ফিরে৷
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন বলেন, ‘‘ট্রেনের টিকেট কেনার চেষ্টার পর টাকা কেটে নিয়েছে, টিকেট পাওয়া গেল না৷ পরিষ্কার ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন৷ অসংখ্যভাবে ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়৷’’
‘‘ট্রেনে স্ট্যান্ডিং টিকেট দেওয়াও অবৈধ৷ এতেও নিয়মিত যাত্রীর অধিকার ক্ষুন্ন হয়৷ ১৮৯০ সালের ট্রেন আইন অনুসারে প্রতিটা বগিতে সুনির্দিষ্ট করা যাত্রীর বাইরে আর যাত্রী নেয়ার সুযোগ নেই৷ সরাসরি কোনো যাত্রী তুলতে পারবে না বা এমন কোনো কাজ করতে পারবে না, যাতে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠে৷’’
‘‘যে কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেটার প্রমাণসহ ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যেতে পারে৷”
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, ‘‘১০টা সেবার ক্ষেত্রে আমাদের কার্যক্রমের আওতা আছে, যার মধ্যে পরিবহণ খাতও রয়েছে৷ বিমান-রেলওয়েকেও আমরা আগে নোটিশ করেছিলাম৷ কোনো অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘প্রমাণসহ অভিযোগ করতে হবে৷ রনি সহজের কাছ থেকে টিকেট কিনেছে৷ কিন্তু টাকা কেটে নিলেও সে টিকেট পায়নি৷ সেই টিকেট আবার কালোবাজারে বিক্রি হয়েছে৷ এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘রনি যে সেবাটা ক্রয় করেছে, তার অ্যাকাউন্ট থেকে বিকাশে পেমেন্ট গিয়েছে৷ সেই টিকেটটা যে আনসোল্ড দেখিয়েছে, সহজ একটা মেইল করেছে যে, রিফান্ড দেবে৷ এ সবই প্রমাণ৷’’
‘‘কেস টু কেস ডকুমেন্ট আলাদা হতে পারে৷ বৈধভাবে একটা টিকেট কাটলেন৷ আপনি চড়তে পারলেন না৷ তখন আপনি যে ঢুকতে পারেননি, সেই ছবি তুলে রাখা বা ভিডিও রাখা যেতে পারে৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যে জরিমানা করি, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী পায়৷’’
গত বছরের ছবিঘর দেখুন...