1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আহতদের চিকিৎসায় সংকট কাটছে না

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৮ আগস্ট ২০২৪

সরকারি-বেসরকারি নানা ঘোষণার পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে সংকট কাটছে না। পুরো প্রক্রিয়ায় এক ধরনের সমন্বয়হীনতাও দেখা যাচ্ছে।

https://p.dw.com/p/4jbJv
কোটা আন্দোলনে আহত এক ব্যক্তির চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেলে
হাসপাতালের অপারেশন ও শয্যা ফ্রি করা হলেও অনেককে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে।ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO

বিচ্ছিন্নভাবে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা সহযোগিতায় এগিয়ে আসলেও রোগীরা কতটুকু পাচ্ছেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

হাসপাতালের অপারেশন ও শয্যা ফ্রি করাহলেও অনেককে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। ফলে আহতদের চিকিৎসার পুরোটাই ফ্রি করা হবে, এই ঘোষণার বিষয়ে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে কথা বললে ভিন্নচিত্র পাওয়া যাচ্ছে।

গত ১৮ জুলাই রাত নয়টার দিকে মেরুল বাড্ডা এলাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন জাকির সিকদার (৩৩)। তিনি গুলশানের একটি পোশাকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি করেন। তিনি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। জাকির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "২১ জুলাই অস্ত্রোপচারে বাঁ হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়। এরপর আরও তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনও ইনফেকশন আছে।” কোনো ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ এক হাজার, কেউ দুই হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে তো আমাদের খাবার কিনে খেতে হচ্ছে, কিছু ওষুধও কিনতে হচ্ছে। অনেকেই বলেছেন, পরে যখন বিকল্প পা লাগাতে হবে, তখন তারা সহযোগিতা করবেন।”

'হাসপাতাল ফ্রিতে চিকিৎসা দিলেও কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনছি'

শরীরে প্রায় তিন শতাধিক গুলির স্প্রিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মো. রাশেদুল করিম ওরফে রাফাত (২৮)। স্বপ্ন ছিল বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করার। কিন্তু এখন বৃদ্ধ বাবা-মার বোঝা হয়ে গুলির যন্ত্রণা নিয়ে কাটছে দিন। রাফাত রাজবাড়ি পৌরসভার কাজীকান্দা এলাকার মো. সামছুউদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে। ২০২২ সালে আসহানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেছেন। ঢাকার গোলাপবাগে বড় বোনের বাসায় থাকতেন তিনি। গত ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসার বাজার করতে বের হয়ে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পিঠ ও হাতে গুলিবিদ্ধ হন রাফাত। এ সময় তার হাত ও পিঠে প্রায় ৪ শতাধিক ছররা গুলি লাগে। গুলিগুলো খুব কাছ থেকে করায় চামড়া ভেদ করে মাংসপেশীর ভেতরে ঢুকে যায়। পাশাপাশি তার বাম হাতের কব্জি ভেঙে যাওয়াসহ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। তার চিকিসা নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন পরিবার।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী
সংঘাত-সহিংসতায় কত মানুষ আহত হয়েছেন, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি।ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে আন্দোলনের সময় আহত ১৬০ জন রোগী ভর্তি আছেন। তাদের জন্য ‘স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিট' করা হচ্ছে। এই ইউনিটের জন্য পৃথক চিকিৎসক ও নার্স থাকবে। সেখানে মানুষের অবাধ যাতায়াত থাকবে না। হাসপাতাল থেকেই যথাসম্ভব ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শুধু হাসপাতালের ওষুধ নয়, বাইরে থেকে যেসব ওষুধ কিনতে হচ্ছে, সেটাও আমরা কিনে দিচ্ছি। ফলে এখানে যারা আছে, তাদের চিকিৎসার জন্য রোগীকে কোন ধরনের খরচ করতে হচ্ছে না।”

কবে থেকে এই ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে? জানতে চাইলে জনাব আসাদুজ্জামান বলেন, "সাবেক প্রধানমন্ত্রী যখন হাসপাতালে এসেছিলেন, তিনিও বলেছিলেন। তার আগে থেকেই মূলত ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। হাসপাতালের একটি বিশেষ ফান্ড থেকে এই খরচগুলো দেওয়া হচ্ছে। সরকার থেকে এখনও আমরা সরাসরি কোনো ফান্ড পাইনি। তবে ফান্ড ছাড়ের বিষয়গুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, খুব সহসাই পাওয়া যাবে।”

'হাসপাতাল থেকেই যথাসম্ভব ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে'

বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আহতদের চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছে। ব্র্যাক ছাড়াও সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন (এসএএএফ) এই সহযোগিতা করছে। সংস্কার আন্দোলকারী সমন্বয়কদের সঙ্গে মিলে আহতদের চিকিৎসায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে তারা কাজ করছে। ফাউন্ডেশনটি শনিবার বেশ কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। সেখানে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ছাড়াও তিন জন সমন্বয়ক ও হাসপাতালের ঊর্ধ্বতনরা উপস্থিত ছিলেন।

ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র আশা পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলোকে বলেছি, রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি সুবিধার বাইরে আরও কিছু লাগলে সেগুলো আমরা দিচ্ছি। যেমন ধরেন, কারও পা ভেঙে গেছে বা কেটে ফেলতে হবে। তখন অপারেশনের সময় অনেক সরঞ্জাম লাগে। সেগুলো আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিনে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আমরা ঢাকার তিনটি হাসপাতালে ২১০ জন ও ঢাকার বাইরে ১১টি জেলায় ১১০ জন রোগীকে সহযোগিতা করেছি।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনে জখম শিক্ষার্থী
স্বাস্থ্য বিভাগের ধারণা, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO

সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং কো চেয়ারম্যান আনিস আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা শুধু আর্থিক সহযোগিতাই প্রদান করব না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যমে যারা আমাদের বাক স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের সুযোগ দিয়েছেন তাদের পুরোপুরি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবো। এর জন্য আমাদের বাজেটের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। যত বরাদ্দ লাগে সেটা করা হবে।”     

চিকিৎসায় এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। যে যার মতো সহযোগিতা করছে। এগুলো গুছিয়ে করা যেত কিনা জানতে চাইলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার কাছে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসেছিল। ব্র্যাক ও সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন। আমি তাদের কাজের সমন্বয় করছি। তারা যে তালিকা করেছে, আমি সেগুলো দেখে তাদের সঙ্গে কাজ করছি। আসলে হাসপাতালে যারা এখন চিকিৎসাধীন আছেন তাদের চিকিৎসায় আরও অনেক টাকার প্রয়োজন। ফলে সরকার কেবল যে ঘোষণাটি দিয়েছে চিকিৎসা ফ্রি করবে, সেটা দেখতে হবে তারা কতটা ফ্রি করে। এর বাইরে আহত প্রতিটি ব্যক্তিকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে।”

সংঘাত-সহিংসতায় কত মানুষ আহত হয়েছেন, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের ধারণা, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর সাতটি সরকারি হাসপাতালে ৪৩৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের ১০ জনের পা কাটা গেছে, এক জনের এক হাত কাটা গেছে। অনেকের হাতে, পায়ে বা শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর ক্ষত আছে। ৩২ জনের চোখে আছে ছররা গুলির আঘাত।

ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী
বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আহতদের চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছে। ব্র্যাক ছাড়াও সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন (এসএএএফ) এই সহযোগিতা করছে।ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO

এছাড়া সরকারি ঘোষণার পর আহত রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মুবিন খান। তিনি জানিয়েছেন, "এই রোগীদের বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটা কার্যকর করা হবে।”