1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইনই বলুক মামলা চলাকালে কে দেবে সন্তানের ভরণপোষণ

শামীমা নাসরিন
শামীমা নাসরিন
২২ জুলাই ২০২২

চার বছরের ছোট্ট এক শিশু আদালতের বারান্দায় খেলছে৷ বুঝতেও পারছে না তার বাবা-মা তাকে নিয়ে পরষ্পরের বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে নেমেছে৷ তার কাস্টডি পেতে নয় বরং তাকে না নিতে তাদের এই লড়াই৷

https://p.dw.com/p/4EVD5
বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সন্তানের আইনগত অভিভাবক শুধু তার বাবা
বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সন্তানের আইনগত অভিভাবক শুধু তার বাবাছবি: Mortuza Rashed/DW

২০১৯ সালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এই খবরটি দেখে থমকে গিয়েছিলাম৷ ছোট ওই শিশুটি এখন কেমন আছে জানি না৷ খানিকটা চেষ্টা করেও তার বর্তমান অবস্থার খোঁজ পাইনি৷

ওই শিশুটির মত অনেক শিশুই দিনের পর দিন বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে চক্কর কাটে৷ কখনো বাবা-মা বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের কাস্টাডি পেতে আইনি লড়াইয়ে নামে৷ কখনো মা সন্তানের ভরণপোষণের দাবি নিয়ে আদালতের দ্বারে উপস্থিত হন৷

দুজন মানুষ বিয়ে করে সংসার শুরু করেন৷ তাদের কোল আলো করে আসে সন্তান৷ এক সময় নানা কারণে ওই দুজন মানুষের মতের অমিল দেখা দেয়৷ যখন একসঙ্গে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন আলাদা হওয়াই শ্রেয় মনে করে তারা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান৷ বাবা-মার বিচ্ছেদে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা৷ কার কাছে যাবে তারা, কার সঙ্গে থাকবে৷ কে তাদের ভরণপোষণ দেবে? এসব নানা প্রশ্ন তখন সামনে চলে আসে৷

বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে স্পষ্ট করেই বলা আছে৷ আইনটি সম্পর্কে জানতে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের আইনজীবী এমডি আমিনুল ইসলামের সঙ্গে৷

তিনি বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সন্তানের আইনগত অভিভাবক তার বাবা৷ মা আইনগত অভিভাবক নন, মা শুধু জিম্মাদার বা হেফাজতকারী৷

‘‘ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর এবং মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মা হেফাজতে থাকবেন৷ তারপর বাবা চাইলে সন্তানদের নিয়ে যেতে পারবেন৷ তবে নির্দিষ্ট বয়সের পরও মা সন্তানকে নিজের জিম্মায় রাখার আবেদন আদালতে করতে পারেন এবং সন্ত‍ানের কল্যাণ বিবেচনায় আদালত মা কে সন্তান নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিতে পারেন৷

‘‘তবে সন্তানের ভরণপোষণ সবসময় বাবাকেই দিতে হবে৷ সন্তান যার কাছেই থাকুক, এটা সম্পূর্ণ রূপে বাবার দায়িত্ব৷”

সম্প্রতি এক জাপানি মায়ের সন্তানের কাস্টডি পেতে বাংলাদেশে এসে আইনী লড়াইয়ে নামার বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল৷ বাংলাদেশি বাবা এবং জাপানি মা দুইজনই তিন মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান

বাবা বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন৷ তাদের নিয়ে যেতে মাও আসেন৷ নানা টানাপোড়েন ও নাটকীয়তার পর আদালত শেষ পর্যন্ত বড় দুই মেয়েকে বাবার কাছে রাখার অনুমতি দেন৷

জনপ্রিয় অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের মেয়েকে নিজের হেফাজতে পেতে আইনী লড়াইয়ের খবরও গণমাধ্যমের বদৌলতে সবার জানা৷ বিবাহবিচ্ছেদের পর বাঁধনের মেয়েকে নিয়ে তার বাবা কানাডা চলে যেতে চেয়েছিলেন৷ মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে মরিয়া হয়ে লড়াই করেছেন বাঁধন৷ সেই সমেয় মানসিকভাবে তিনি এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তাকে মনরোগের চিকিৎসা নিতে হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাঁধনই জেতেন৷ আদালত মেয়েকে তার জিম্মায় দেন৷

বিচ্ছেদের পর বাবা-মায়ের সমঝোতার ভিত্তিতে সন্তানদের বড় করার ঘটনাও আমাদের চারপাশে দেখতে পাওয়া যায়৷

বিচ্ছেদের পর সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের অবস্থানের যে তিনটি উদাহরণ উপরে দিলাম সেগুলো যেমন দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি বাবার বিরুদ্ধে সন্তানের ভরণপোষণের দাবি নিয়ে হাজার হাজার মায়ের আদালতের দ্বারস্ত হওয়ার ঘটনাও প্রচুর৷ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের সমাজে আমি বরং এ ধরনের ঘটনাই বেশি দেখতে পেয়েছি৷

পরিসংখ্যানও সেই কথাই বলছে৷ ঢাকায় পারিবারিক কলহের মামলাগুলোর বিচার কাজ তিনটি পারিবারিক আদালতে হয়৷ সেখানে গত পাঁচ বছরে (২০১৬ থেকে ২০২০ সাল) ৩৯ হাজার ৭২২টি মামলা হয়েছে৷ তারমধ্যে বিচারের পর্যাপ্ত উপাদান না থাকায় পাঁচ হাজার ৩০টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে৷ রায় হয়েছে এক হাজার ২৫২টি মামলার৷ যার মধ্যে ভরণপোষণ সংক্রান্ত মামলা ৬৫ শতাংশ৷ (সূত্র: জাগো নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

বাংলাদেশে কজন বাবা বিচ্ছেদের পর সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করেন? কজন মানেন তার কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়া তার সন্তানের আইনি অধিকার৷

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণত পুরুষ আয় করেন, নারী সংসার-সন্তান সামলান৷ সময় পাল্টেছে, মেয়েরাও এখন ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেখাপড়া করছেন৷ তাদের কেউ কেউ কর্মজীবনও শুরু করেন৷ কিন্তু বিয়ে এবং বিশেষ করে সন্তান হওয়ার পর উপযুক্ত সহযোগিতার অভাবে অনেক মেয়ে সংসার ও পেশা জীবনে ভারসাম্য রাখতে না পেরে ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে সংসার ও সন্তান লালনপালনে মনযোগী হন৷

সংসার-সন্তান সামলানো সেই নারীরই যখন বিবাহবিচ্ছেদ হয় তখন তিনি যেন অথৈ সাগরে পড়েন৷ কোনো কোনো মেয়ের বাবার বাড়িতে একটু ঠাঁই মিললেও তার সন্তানের দায়িত্ব সাধারণত সেখানেও কেউ নিতে চায় না৷

কোনো কোনো মা তখন উপায় না পেয়ে মরিয়া হয়ে সন্তানের বাবার বিরুদ্ধে সন্তানের ভরণপোষণের দাবি নিয়ে আদালতে যান৷ এটা ওই নারী ও তার সন্তানের আইনি অধিকার এবং বাবার আইনি দায়িত্ব৷

একক মায়েদের ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয়: সৈয়দা জিনিয়া মোমেন

মেয়ের ভরণপোষণের দাবি নিয়ে আদালতে যাওয়া সৈয়দা জিনিয়া মোমেন শুনিয়েছেন তার লড়াইয়ের গল্প৷ বাংলাদেশের খ্যাতনামা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা জিনিয়ার বিয়ে হয় ২০১২ সালে৷ পরের বছর তার মেয়ের জন্ম হয়৷ ২০১৪ থেকে তিনি স্বামীর থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন, ২০১৫ সালে তার সাবেক স্বামী তাকে তালাকনামা পাঠান৷

তালাকে আপত্তি না থাকলেও যেহেতু তাদের একটি মেয়ে আছে তাই তিনি মেয়ের বাবার কাছে সন্তানের কী হবে সেটা জানতে চান৷

‘‘মেয়ের বাবা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়৷ আমি তাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না৷ তখন আমি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) শরণাপন্ন হই৷ সেখান থেকে সালিশের জন্য তাকে একটি চিঠি পাঠানো হয়৷ তিনি আসেন এবং সরাসরি বলেন, তিনি বাচ্চাকে কোনো ভরণপোষণ দেবেন না৷ এমনকি দেখতেও আসবেন না৷

‘‘বাধ্য হয়ে ২০১৬ সালে ব্লাস্টের মাধ্যমে আমি পারিবারিক আদালতে মামলা করি৷ আমার আবেদন ছিল, বাচ্চাকে ভরণপোষণ দিতে হবে এবং তাকে দেখতে আসতে হবে৷ দেখতে আসার বিষয়টিতো পুরোপুরি মানবিক৷ আইন দিয়ে তো আর জোর করা যায় না৷ কিন্তু ভরণপোষণ তো দিতে হবে৷”

পাঁচ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নিজের পক্ষে রায় পান জিনিয়া৷ আদালত তার মেয়ের বাবাকে মেয়ের ভরণপোষণের জন্য প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ দেয়ার নির্দেশ দেয়৷ মামলাটি এখনো উচ্চ আদালতে চলমান বলেও জানান জিনিয়া৷

বাংলাদেশের বর্তমান আইন নিয়ে খানিকটা দুঃখ করে জিনিয়া বলেন, ‘‘দেখেন, বাচ্চার অভিভাবক তো বাবা৷ আমি হেফাজতকারী৷ এই যে এত বছর ধরে মামলা চললো, এই সময়ে বাচ্চা আমার কাছে ছিল৷ তার সব খরচ আমাকেই দিতে হয়েছে, সবার সেই আর্থিক সঙ্গতি থাকেও না৷ একজন সিংগেল মাদার হিসেবে চাকরি, বাচ্চা, বাসা সামলানো সব আমাকে একা করতে হচ্ছে৷

‘‘আমার মনে হয় এখানে আইনে একটু অসঙ্গতি আছে৷ আমি এমনকি বাচ্চার পাসপোর্ট পর্যন্ত করতে পারিনি৷ যেহেতু বাবা গার্ডিয়ান, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় তাকে ফোন করা হয়৷ তিনি বলেন, বাচ্চার মায়ের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে৷ তার পাসপোর্ট করার অনুমতি আমি দিচ্ছি না৷ তাকে আদালত থেকে অনুমতি নিতে বলেন৷

‘‘আদালতের অনুমতির জন্য এখন আমাকে কাস্টডি মামলা করতে হবে৷ আগেরটা তো ভরণপোষণের মামলা৷ যেহেতু বাচ্চার বাবা তার কাস্টডি চায় না৷ তাই মামলা করলেই আমি হয়তো কাস্টডি পেয়ে যাব৷ কিন্তু একটা মামলা আমি অলরেডি করেছি, এখন কাস্টাডির মামলা করতে হলে আবার আমাকে টাকা খরচ করতে হবে৷ আবার তারিখের পর তারিখ পড়বে৷”

শামীমা নাসরিন, সাংবাদিক
শামীমা নাসরিন, সাংবাদিকছবি: privat

তাই বর্তমান আইনের কিছু পরিবর্তন চান জিনিয়া৷ বলেন, ‘‘যেহেতু আদালত দেখছেন বাবা বাচ্চাকে একদমই দেখতে আসছে না৷ সেক্ষেত্রে ভরণপোষণের মামলাতেই বাচ্চার কাস্টাডিও যদি মা পেয়ে যান তবে বিষয়গুলো খানিকটা সহজ হয়৷ হ্যারাসমেন্টও অনেক কমে যায়৷ কারণ, আলাদতে উকিলেরাও নিজেদের স্বার্থে অনেক ভুলভাল বোঝায়৷ এমনকি আপনার উকিলও অর্থের লোভে পড়ে আপনাকে নয়ছয় বুঝিয়ে প্রতিপক্ষকে জিতিয়ে দেবে৷ এমন ঘটনা আমি নিজে দেখেছি৷

‘‘তাই আমার মনে হয়, যদি সরকারিভাবে বাচ্চার ভরণপোষণের কোনো ব্যবস্থা করা হতো বা ডিভোর্সের সময় যদি বাবার কাছ থেকে অন্তত এক বছরের জন্য বাচ্চার ভরণপোষণ আগেই নিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হতো, যেহেতু বাবাই প্রকৃত অভিভাবক এবং সন্তানের ভরণপোষণ দেওয়া সম্পূর্ণ তার দায়িত্ব৷ আর তালাকের পর একটি মেয়ে যে কত খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে! মেয়েটার বাবা-মাই এটা মেনে নেয় না৷ তাকে সব জায়গায় অপমানিত হতে হয়৷

‘‘একক মায়েদের ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয়৷ আমি এটা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি৷”

২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত একটি আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করতেন জিনিয়া৷ মা আগেই মারা গেছেন৷ সহযোগিতা না পেয়ে বিয়ের পর ক্যারিয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন৷ এখন ঢাকার ফার্মগেটে একটি প্রি-স্কুলে শিক্ষকতা করেন৷ মেয়ে সেই স্কুলেই পড়ে৷ থাকছেন বাবার বাড়িতে৷ জানান, বিচ্ছেদের পর আইনি লড়াইয়ের সময় তার বাবা তাকে খুব সাহায্য করেছেন৷

জিনিয়ার বাবাও আর জীবিত নেই৷ এখন আট বছরের মেয়েকে ঘিরেই তার জীবন৷ মেয়ের বাবা আবার বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন৷ হেসে জানান, তিনি এখনো মেয়েকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পরছেন না৷

আজকাল ব্যস্ততার চাপে মানুষ যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে৷ বাড়ছে বিচ্ছেদের সংখ্যা৷ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজধানীতেই গড়ে প্রতিদিন ৩৭টি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে৷ আর ৭০ শতাংশ আবেদনকারী নারী৷ তাই আইনের খানিকটা সংস্কার করে জিনিয়াদের একা পথচলার সংগ্রামকে কিছুটা সহজ কী করা সম্ভব?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান