৭৫ বছরে মাদারীপুর থেকে আসা মানুষদের তৈরি জনপদ দমদম পার্ক
মাদারীপুর থেকে কলকাতায় আসা বাস্তুহারা কিছু মানুষ হোগলার বন কিনে গড়ে তুলেছিলেন এক জনপদ। পঁচাত্তর বছরে পা দিলো সেই জনপদ দমদম পার্ক।
বসতি গড়লেন মাদারীপুর থেকে আসা মানুষরা
দুই বাংলা ভাগ হওয়ার পর কলকাতার কাছেই দমদম অঞ্চলে গড়ে উঠছিল বাস্তুহারা মানুষদের একের পর এক জবরদখল কলোনি। এর মধ্যে মাদারীপুর থেকে আসা কিছু মানুষ বসতি গড়ে তুলেছিলেন উল্টোডাঙা অঞ্চলে। তাদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন আইনজীবীও। তারা চেয়েছিলেন একটি কো-অপারেটিভ গঠন করে সরকারের কাছ থেকে জমি কিনে আইনসিদ্ধ কলোনি তৈরি করতে।
জমির হদিশ
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে একটা নিচু জমি পাওয়া গেল, যার পশ্চিমপ্রান্তে যশোহর রোড, দক্ষিণে বাগজোলা খাল, উত্তরে মার্টিন বার্ন কোম্পানির ন্যারো গেজ রেল লাইন আর পূর্ব প্রান্তের ভিআইপি রোড তখনও তৈরি হয়নি, ছিল নয়ানজুলি। উপরের ছবিটি ওই অঞ্চলের ভিআইপি রোডের এক প্রান্তের।
হোগলার বনে বসতি
সেদিনের দমদম পার্কের প্রায় পুরোটাই হোগলা বন আর কচুরিপানায় ভর্তি ছিল। বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করা কার্যত অসম্ভব ছিল। প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ওই জমিতেই বসতি স্থাপন করতে তৈরি হলো ‘কৃষ্ণপুর রিফিউজি অপারেটিভ কলোনি লিমিটেড’। এই কৃষ্ণপুর রিফিউজি অপারেটিভ কলোনিই আজকের দমদম পার্ক।
২৬৬ বিঘার জনপদ
এই বছরে ‘কৃষ্ণপুর রিফিউজি কো-অপারেটিভ কলোনি লিমিটেড’ ৭৫ বছর পূর্ণ করছে। সোসাইটির এক সদস্য বলেন, ‘‘এমন সমবায় সমিতি তৈরি করে বসতি স্থাপনের নিদর্শন পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় নজিরবিহীন ছিল। ২৬৬ বিঘা জমিতে ছয়শটি প্লট দিয়ে শুরু হয়েছিল কলোনি। দমদম পার্কের বৈশিষ্ট হলো, এখানে এমনভাবে রাস্তা তৈরি হয়েছে যে ব্লাইন্ড লেন বলে কিছু নেই। তখন হোগলার বন পরিষ্কার করে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছিল। আমরা যার সুফল পাচ্ছি।”
২২০ টাকা কাঠা
১৯৪৯ সাল। কো-অপারেটিভ সোসাইটি জমি উন্নয়নের সময়ে কাঠাপিছু দাম রেখেছিল ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। ঠিক তখনই তৈরি হচ্ছিল পাশেই লেক টাউন, বাঙ্গুর। শোনা যায় মূল শহর থেকে কিছুটা কাছে হওয়ায় ওই অঞ্চলগুলোয় তখন জমির দাম ছিল চড়া। কাঠাপিছু ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ফলে বাস্তুহারা নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষেরা বসতবাড়ি তৈরির জন্য তখন অপেক্ষাকৃত কম দামের দমদম পার্ককেই বেছে নিয়েছিলেন।
জলা ভরাট করতে জলাশয়
হোগলার জঙ্গলে ঘেরা নিচু জলা জমি ভরাট করতে প্রয়োজন ছিল নব্বই লক্ষ ঘনফুট মাটি। সমবায়ের সদস্যরা বুদ্ধি খাটিয়ে ওই অঞ্চলে মোট একচল্লিশ বিঘা জমিতে পাঁচটি দিঘি কাটার সিদ্ধান্ত নেন। সেই দিঘিগুলোর মাটি দিয়েই এলাকার বাকি অংশ ভরাট করা হয়। দিঘিকে ঘিরে করা হল বৃক্ষরোপণ। জলা ভরাট করতে গিয়ে জন্মানো ওই পাঁচটি দিঘি দমদম পার্ক অঞ্চলের সম্পদ।
আর যা যা কাজ
দিঘি খনন, গাছ লাগানো ছাড়াও সমিতির উদ্যোগে এখানে ছেলে ও মেয়েদের দু’টি হাইস্কুল, কিন্ডারগার্টেন স্কুল তৈরি হয়। এখন অবশ্য হাইস্কুল দু’টি সরকারি সহায়তায় চলে। এখন দমদম পার্ক দক্ষিণ দমদম পুরসভার অন্তর্গত। তবে কৃষ্ণপুর রেফিউজি কো-অপারেটিভ কলোনি লিমিটেডও সমান সক্রিয়।
আছে ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও
স্থানীয় মানুষদের উদ্যোগেই এখানে ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চলে। প্রতিদিন সকালে স্থানীয় কচিকাঁচার দল ভবিষ্যতের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখানে অনুশীলন করতে আসে।
'গর্বের সুপরিকল্পিত জনপদ’
ষাটের দশকেই গড়ে উঠেছিল দমদম পার্কের এই ছোট্ট বাজার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন হোম ডেলিভারি অ্যাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়েও টিকে থাকা এই বাজারের এক দোকানমালিক অসিত সাহা। ষাট বছর ধরে দমদম পার্কের বাসিন্দা। বললেন, “কাঁচা রাস্তা থেকে পিচের রাস্তা, টিনের চালের বাড়ি থেকে বহুতল — দমদম পার্কের আমুল বদল দেখেছি চোখের সামনে। তবে এমন সুপরিকল্পিত জনপদ আমাদের গর্বের।”
দুর্গাপুজোর খ্যাতি
১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে দমদম পার্কে সমবায়ের নেতৃত্বে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছিল বলে জানা যায়। বাজার, মহিলা সমিতি, ক্রেতা সমবায় বিপনন, খেলার মাঠ — এইসবের সঙ্গে একটি মন্দিরর স্থাপন করা হয়। ১৯৫৩ সালে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজো হয় দমদম পার্কে, যদিও বর্তমানে এখানে বেশ কয়েকটি দুর্গাপুজো হয়, যার মধ্যে তিনটি কলকাতা শহরের বিখ্য়াত পুজোর মধ্যে পড়ে।
‘বদলেছে অনেককিছুই’
পঁচাত্তর বছরে কলেবর থেকে সংস্কৃতি, অনেক কিছুই বদলেছে এই জনপদের। সেদিনের কৃষ্ণপুর রিফিউজি অপারেটিভ দমদম পার্ক হয়েছে। বসতবাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাটবাড়ি। প্রৌঢ়া কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭৮ সাল থেকে দমদম পার্কের বাসিন্দা। বললেন, “এখানে থাকার মত শান্তি অন্য কোথাও মিলবে না। দিঘির দিকে মুখ করা বাড়ি, গাছে গাছে পাখির আনাগোনা দেখতে দেখতে দিন কেটে যায়।''
‘মার্টিন গাড়ি’
একসময় দমদম পার্কের গা ঘেঁষে চলতো মার্টিন বার্নের ন্যারো গেজ রেলগাড়ি। সেসব আজ আর নেই। শামবাজার থেকে হাসনাবাদ যাওয়ার পথে দমদম পার্ক ছুঁয়ে যেত স্থানীয় মানুষের ‘মার্টিন গাড়ি’ বা ‘ছোটো গাড়ি’। ১৯৫৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় সেই ‘মার্টিন গাড়ি’। রেললাইনের শেষ চিহ্নটুকুও বেশ কয়েকবছর আগে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সেখানেও বসতি গড়ে উঠেছে বহুকাল। বাস্প ইঞ্জিনের ধোঁয়া আর ভোঁ এলাকার কিছু পুরনো নাগরিককে আজও স্মৃতিমেদুর করে তোলে।