৭ই মার্চের ভাষণ: প্রাপ্য শ্রদ্ধা, প্রাসঙ্গিক আক্ষেপ
৭ মার্চ ২০২১এই ভাষণও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘকাল৷ কলঙ্কের সেই অতীত অনেকেরই জানা৷ তখন টেলিভিশনে যুদ্ধাপরাধীর ভাষণ দেখা যেতো, কিন্তু বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টার নাম, ছবি, ভাষণ সবই ছিল নিষিদ্ধ৷ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টার, তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারও ‘নিষিদ্ধ’ ছিল তখন৷ হ্যাঁ, তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ ক্ষমতাসীনেরা নিতো না, বরং গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের জন্য গণআদালত প্রতিষ্ঠার কারণে লেখিকা, শিক্ষাবিদ, শহিদ জননী, একাত্তরের ঘাতক, দালালবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হতো৷
কিন্তু সেই সময় পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ৷ দেশে গোলাম আযমসহ অনেক যুদ্ধাপরাধীরই বিচার এবং সাজা হয়েছে৷ ক্ষমতা দখলের লালসায় চালানো ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি ৷ ৭ই মার্চের ভাষণও নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের মনোজগত ছাড়া বাকি সব জায়গায় উন্মুক্ত হয়েছে৷
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ৷ চলতি মার্চে তো ঐতিহাসিক সেই ভাষণ নিয়ে ফ্রান্সে বাংলাদেশের দূতাবাস ও ইউনেস্কোয় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষায় তার মোড়ক উন্মোচনও হয়ে গেল৷
খন্দকার মোশতাকের সরকার (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর), আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সরকার (১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল), জিয়াউর রহমান সরকার (১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে), আব্দুস সাত্তার সরকার (১৯৮১ সালের ৩০ মে থেকে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ), হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার (১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর)এবং খালেদা জিয়া সরকার (১৯৯১ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ)-এর আমলে যা প্রকাশ্যে শোনা ছিল ভয়ঙ্কর অপরাধের মতো, তা এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বহু দূর পর্যন্ত স্বীকৃত, সম্মানিত!
এত ক্ষমতার দাপটে এতকাল নিষিদ্ধ রেখে কতটুকুই বা লাভ হয়েছে?
শেষ পর্যন্ত সারা দেশে প্রকাশ্যে, সগর্বে ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচারের দিন তো এসেছেই৷ খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরে সারা বিশ্বের ইতিহাসের সেরা ভাষণগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে৷ ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস- দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’ নামের সেই গ্রন্থেও ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স' শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ৷
৭ই মার্চের ভাষণের এমন প্রচার, এমন স্বীকৃতি শতভাগ প্রাপ্য৷ এমন প্রাপ্তিতে আমরা আনন্দিত, গর্বিত৷ তবে ৫০ বছর আগে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা এক ধরনের আক্ষেপও জন্ম দেয় মনে৷ সেই আক্ষেপের সঙ্গে খন্দকার মোশতাক নামটা খুব জড়িত৷
মোশতাক আওয়ামী লীগই করতেন৷ তার মুখেও ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা৷ প্রশংসায় তিনি বরং অন্য সবার চেয়ে বহু বহু ক্রোশ এগিয়েই ছিলেন৷ তার এত প্রশংসার উদ্দেশ্যটা নাকি বঙ্গবন্ধু বুঝতেন৷ বুঝতেন মোশতাক আসলে তোষামোদকারী বা ‘চাটা' শ্রেণির লোক৷ এক সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু জানতেন মোশতাক কী পরিমাণ ধূর্ত৷ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘মোশতাক তোমাকে ডান পকেটে করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে আবার বাঁ পকেটে নিয়ে এলে তুমি টেরও পাবে না৷’’ (ভোরের কাগজ, ১৪ আগস্ট, ১৯৯২)৷
কিন্তু যা হয়, তোষামোদকারীদের ভীড়ে সত্যটা একসময় আড়ালে পড়েই যায়৷ পা-চাটা ধূর্ত মোশতাক ও তার সঙ্গীরা ভেতরে ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা করলেও বঙ্গবন্ধু তা টের পাননি৷ কে না জানে, ৭ই মার্চের ভাষণের বলিষ্ঠ কণ্ঠ চিররুদ্ধ হয়েছিল মোশতাক গংয়ের কারণেই! মোশতাককে সময় থাকতে পুরোপুরি চিনতে না পারার আক্ষেপ বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে চিরকাল৷
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগারে মারা যান মুশতাক আহমেদ নামের এক লেখক৷ মুশতাক আহমেদ অনলাইনে লেখালেখি করতেন৷ সেই লেখার কারণে ২০২০ সালের ৬ মে র্যাব তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে৷ তারপর ছয়বার জামিনের আবেদন করা হলেও মুশতাক আহমেদ জামিন পাননি৷ কারাগারেই মৃত্যু হয় তার৷ তাকে কারাগারে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে৷ কারা কর্তৃপক্ষের তদন্তে কোনো ‘গাফিলতি’ না পেলেও নির্যাতনের অভিযোগ এখনো উঠছে৷
৭ই মার্চের ভাষণ যে খোন্দকার মোশতাক এবং তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমমনাদের নিষেধাজ্ঞার প্রাচীর ভাংতে পেরেছে- এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক৷ তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই স্বস্তিকে ম্লান করে দেয় একজন লেখকের এমন মৃত্যু৷