কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যারা হেঁটে বেড়ান শহরের পথে পথে, অলিতে-গলিতে, জমাটি আড্ডায় চায়ের কাপে মেরেছেন হাতি-ঘোড়া, তারাই সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে৷ যার একদিকে রয়েছেন বাঙালি, অন্যপক্ষে পাহাড়ি৷
৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ‘মব জাস্টিস'৷ গত প্রায় দুই মাসে মব জাস্টিসের শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন৷ ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ এ ঘটনার জেরে পরদিন দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে শুরু হয় সহিংসতা৷ তারপর আবার তিন জনের প্রাণহানি৷ তার রেশ এসে লাগে রাঙামাটিতেও৷
সেদিন জার্মানির বন শহরে যখন আমার ঘুম ভাঙে, তখন বাংলাদেশের ঘড়িতে দুপুর একটা৷ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই জানতে পারি পুড়ছিল শহর, ঝরছিল রক্ত৷ তার কণ্ঠে স্পষ্টতই আতঙ্কের ছাপ, অজানা শঙ্কা৷ আগুন দেয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদেও৷ সেখান থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব পায়ে হেঁটে ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড৷ একে একে বিভিন্ন স্থাপনায়, ধর্মীয় উপাসনালয়ে, মানুষের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া আর দোকানপাট ভাঙচুরের খবর পেতে থাকি৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাঙামাটিতে তখন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷
অথচ রাঙামাটি তো এমন ছিল না, এমন রাঙামাটির কথা শুনিনি আগেও৷ শৈশব-কৈশোরে রঙিন দিনগুলো আমার পাহাড়ি শহরটাতেই কেটেছে৷ বর্ষবরণ কিংবা বর্ষবিদায়ের আয়োজন, বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু, ঈদ, দুর্গাপূজা, কঠিন চিবর দান কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সবসময় ছিল সম্প্রীতি৷ একসঙ্গে খেয়েছি, গেয়েছি, নেচেছি, আনন্দে মেতেছি৷
আমাদের বাড়িতে পাহাড়িদের আনাগোনায় কোনো বাধা ছিল না, তাদের দিক থেকে আমিও সেই বাধা কোনোদিন পাইনি৷ ধর্মীয় আর সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা ভিন্নতা আছে, কিন্তু বন্ধুত্বে, নিমন্ত্রণে এসব কখনও আমাদের মাঝে দূরত্ব হয়ে দাঁড়ায়নি৷
স্কুলের দিনগুলোতে আমরা পাশাপাশি বসে ক্লাস করেছি৷ খেলার মাঠে একসঙ্গে খেলেছি৷ কলেজের দুরন্ত দিনগুলোও কেটেছে সহাবস্থানে৷ কোনোদিন আমরা একে অপরের প্রতিপক্ষ ভাবিনি৷ তেমন কোনো প্রেক্ষাপট অন্তত আমাদের সামনে আসেনি৷
রাজনীতি আর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সহিংসতার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে৷ যদি ভুল না হয় সেটিও প্রায় এক যুগ আগে, অন্তত রাঙামাটি শহরে৷ কিন্তু রাঙামাটির এমন বীভৎস রূপ সেভাবে আর চোখে পড়েনি কখনও৷ কিন্তু এবারকার রাঙামাটি ছিল অচেনা, অন্যরকম৷ তবে কি সম্প্রীতির আড়ালে আসলে ঘৃণার চাষাবাদ ছিল?
সহিংসতা পরবর্তী সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া পরিণত হয়েছিল গুজবের কারখানায়৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১১টি গুজব শনাক্ত করেছে ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪)৷ সেই গুজব ঘৃণাকে উসকে দিয়েছে আরো তীব্রভাবে৷
দীর্ঘ সংগ্রাম, সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে অনেকাংশে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে গোটা জনপদজুড়ে৷ তবে চুক্তি বাস্তবায়নের দুই দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও সবকটি ধারা বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষোভ তো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়ে গেছে৷ গত ২৫ বছর ধরে সেই দাবি আদায়ে তাদের সংগ্রাম অব্যাহত আছে৷
কিন্তু আমার প্রশ্নটা অন্যখানে৷ মব জাস্টিস এর শিকার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ হারিয়েছেন মানসিকভাবে অসুস্থ তরুণ তোফাজ্জল৷ কিন্তু এরপর তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করা হয়নি, বা পুড়িয়ে দেয়া হয়নি৷ মব জাস্টিস-এর ভয়ঙ্কর ঘটনার আরো উদাহরণ আছে এই অন্তবর্তীকালিন সরকারের সময়ে৷ প্রশ্নটা সেখানেই৷
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় মামুনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পর অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল৷ এবং সেটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া৷ কিন্তু সেখানে তা না হয়ে, ঘটনাটি রূপ নিয়েছে জাতিগত সংঘাতে৷ কেন এমন হলো, এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই সমস্যার সমাধান৷ মব জাস্টিসের ঘটনা থেকে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে যে পরিস্থিতি সেখানে তৈরি করা হয়েছে, তার পেছনে কারা আছে?
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সবসময় প্রশ্ন রয়েছে৷ রয়েছে পক্ষ-বিপক্ষ বিভিন্ন মত৷ সেনাবাহিনীর বিপক্ষে বরাবরই প্রশ্ন তুলে আসছেন পাহাড়িরা৷ দেশের মূলধারা রাজনৈতিক দলগুলোও সেখানে কম-বেশি সক্রিয়৷ তাদেরও নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে৷ বলা হয়, খুব কৌশলে তৈরি করা বিভেদের রাজনীতি দিয়ে সেখানে অন্তর্কোন্দল তৈরি করে রাখা হয় সবসময়৷
শান্তি চুক্তির পর পাহাড়িদের মধ্যেও পক্ষে-বিপক্ষ মত দেখা দেয়৷ তাতে জনসংহতি সমিতি ভেঙে গড়ে ওঠে আরেকটি দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)৷ সংগঠনটির নেতা প্রসিত বিকাশ খীসা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েও পাহাড়ি রাজনীতিতে তার শক্তিমত্তা জানিয়েছিলেন৷ যা ছিল শান্তি চুক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ৷ এই দুই সংগঠনে আবার ভাঙন আসে৷ ফলে সব মিলিয়ে পাহাড়িদের প্রধানত চারটি সংগঠন সক্রিয় রয়েছে পাহাড়ি জনপদে৷
শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরাও গড়ে তোলেন সম অধিকার আন্দোলন নামে একটি সংগঠন৷ পাহাড়িরা যখন পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে, এই সংগঠনটি করছে তার বিরোধিতা৷ তারা বলছেন, চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য জনপদে বসবাসরত বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণ পাহাড়িদের হাতে চলে যাবে৷
বাঙালিদের মধ্যেও আবার দুটি ভাগ আছে৷ স্থায়ী বা আদি বাঙালি আর সেটেলার বাঙালি৷ আবার সেটেলার বাঙালিরাও নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভক্ত৷ আর সাম্প্রতিক সহিংসতার মধ্য দিয়ে একটি বিষয় সামনে এসেছে নতুন করে৷ আর তা হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাহাড়ে বাঙালির কাছে বাঙালি, পাহাড়ির কাছে পাহাড়িও নিরাপদ নন৷ দুটি দিকেই এমন কিছু উগ্রপন্থি মানুষেরা রয়েছেন, যারা সত্য ও নিরপেক্ষ বয়ানকে গ্রহণ করতে পারেন না, বরং ছড়িয়ে দেন ঘৃণা৷
তবে পাহাড়ের সমস্যাগুলো নিয়ে সমতলের মানুষেরা অনেক সময় নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন৷ কখনও সেসব বক্তব্য পাহাড়ের পাহাড়ি কিংবা বাঙালিদের বেশ আঘাত করে৷ কারণ পাহাড়ের পুরো বিষয় পর্যালোচনা না করে একপেশে মতামত ঘৃণাকে আরো উসকে দেয়৷ আর কৌশলী হয়ে ঘৃণা ছড়ানোর এই চর্চা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে পাহাড়ের শান্তি ফেরানো কঠিনই হবে৷