হাতির অদৃশ্য দাঁত ও গণমাধ্যমের মালিক
৭ মে ২০২১বইটি লিখে ২০১৯ সালে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন৷ তার এক সময়কার কর্মস্থল গার্ডিয়ান আর সানডে টাইমসে কিভাবে সংবাদমূল্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ঘটনা ছাপা হতো না তার কিছু বিবরণ বইটিতে তুলে ধরেছেন৷ মালিক আর অর্থের যোগানদাতাদের স্বার্থ কিভাবে গণমাধ্যম রক্ষা করা চলে সে অনিয়ম আর প্রতারণার গল্পগুলো তিনি বইটিতে প্রকাশ করেছেন৷ যে গণমাধ্যমকে ‘সমাজের দর্পণ’, ‘কন্ঠস্বরহীন মানুষের কন্ঠস্বর’, ‘চতুর্থ রাষ্ট্র’, ‘সরকারের চোখ’, ‘প্রহরী’ ইত্যাদি নানা বিশেষণে ভূষিত করা হয় সে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ডেভিসের এই মন্তব্য বেশ প্রণিধাণযোগ্য৷ পুরো বইটিতে গণমাধ্যম একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো ফুটে উঠেছে৷ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হতে হলে দুটি জিনিস সর্বাগ্রে দরকার৷ এক. সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের প্রতি একাগ্রতা, দুই. সে দায়িত্ব পালনের জন্য স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন৷ কিন্তু বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এটি পরিষ্কার যে, নানামুখী চাপ গণমাধ্যমের দায়িত্ব এবং তার স্বাধীনতার সীমারেখার মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করে তা পেশাটিকে সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে৷ এই নানামুখী চাপের মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান চাপ হলো মালিকপক্ষ ও অর্থের যোগানদাতাদের চাপ৷
বাংলাদেশে সম্প্রতি কথিত এক ‘আত্মহত্যার’ ঘটনায় তীব্র বিতর্ক চলছে গণমাধ্যমের কাভারেজ নিয়ে, তোলপাড় চলছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় মালিক ও অর্থের যোগানদাতাদের চাপ নিয়ে৷ এক তরুণীর আত্মহত্যার প্ররোচণা মামলায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের নাম আসার পর ঘটনাটি কিভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, কিংবা ঘটনাটি কিভাবে অনেকগুলো শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম চেপে গেছে, অথবা তরুণীর চরিত্র হননের জন্য কিভাবে ‘সিন্ডিকেট সাংবাদিকতা’ করা হচ্ছে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ এসব বিতর্কের সুর একটাই, গণমাধ্যম ও তার কর্মীরা মালিকদের কাছে জিম্মি৷ মালিকরা যেভাবে চান সেভাবেই সাংবাদিকরা তথ্য উপস্থাপন করেন৷ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আসলে মালিকের অধীনতা৷ সাংবাদিকরা মালিকের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে সেলফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে৷
গণমাধ্যম ও মালিকপক্ষের এই দ্বন্দ্ব শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই মোটামুটি বিদ্যমান৷ জেনকভ, ম্যাকলেইশ, নেনোভা এবং শ্লেইফার ২০০১ সালে বিশ্বের ৯৭টি দেশে গণমাধ্যমের মালিকানার ধরণগুলোর উপর একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেন৷ সেখানে তারা দেখান যে, মালিকদের স্বার্থের গণ্ডি দিয়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্বায়ত্তশাসনের সীমানা রচিত হয়৷ বেসরকারি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যাদের মূখ্য উদ্দেশ্য থাকে বাণিজ্যিক প্রসার সেসব গণমাধ্যমের আধেয়ের প্রধান লক্ষ্য মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের তুষ্টি সাধন৷
রিপোর্টার্স স্যঁ ফ্রঁতিয়ে (উইদাউট বর্ডারস) বা আরএসএফ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করে থাকে৷ ২০১৬ সাল থেকে সংগঠনটি বলে আসছে, বিশ্বে গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা দুর্বল হয়েছে, যা ‘গভীর ও বিচলিত হওয়ার মতো’৷ সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো দুটি৷ একটি, বিশ্বনেতারা বৈধ সাংবাদিকতা নিয়ে একধরনের নির্যাতনমূলক ভীতি বা মানসিক বৈকল্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছেন, আর দ্বিতীয়টি, বিশ্বজুড়ে বড় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলো গণমাধ্যমের মালিকানা কিনে নিচ্ছে এবং চাপ সৃষ্টি করছে৷ সরকারের চাপের সঙ্গে এই চাপ যুক্ত হওয়ায় জটিলতা আরও বাড়ছে৷
গণমাধ্যম ও মালিকপক্ষের এই সংঘাতকে হাতির দাঁতের সাথে তুলনা করা যায়৷ হাতির দুটি দাঁত শুধু আমরা দেখতে পাই৷ এগুলো হাতির শোভাবর্ধনকারী দাঁত৷ কিন্তু যে দাঁতগুলো দিয়ে হাতি খায়, সেগুলো আমরা দেখতে পাই না৷ শুঁড়ে ঢাকা এই ভেতরের দাঁতগুলো অতি ধারালো ও তীক্ষ৷ এই দাঁতগুলো দিয়ে হাতি প্রকাণ্ড বৃক্ষও সাবাড় করে ফেলে৷ গণমাধ্যম মালিকরাও যখন নতুন কোন গণমাধ্যম যাত্রা শুরু করেন তারা দেশ, সমাজ এবং সর্বোপরি মানুষের কল্যাণের জন্য ভাল ভাল কথা বলেন৷ সেসব শোভাবর্ধনকারী কথা৷ কিন্তু হাতির ভেতরে থাকা দাঁতের মতই আসল লক্ষ্যগুলো অব্যক্ত থেকে যায়৷ বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এসব লক্ষ্য খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে৷ মাহুতের নির্দেশ মত যেমন হাতি পরিচালিত হয় তেমনি মালিকের নির্দেশনানুযায়ী গণমাধ্যম কর্মীরাও বিশেষ পরিস্থিতিতে মালিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ সিন্ডিকেট সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে সেল্ফ সেন্সরশিপ সবই প্রয়োগ করেন৷
প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর মালিকপক্ষের এই যে চাপ এটি কি একক ও বিচ্ছিন্ন কোন সমস্যা? মালিকানার নীতিতে সংযোজন-বিয়োজন ঘটালেই কি এ চাপ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে? সম্পাদক ও সাংবাদিকরা মালিকপক্ষের হুকুম না মেনে সেল্ফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ না করলেই কি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে? অথবা সরকারি চাপমুক্ত হলেই কি গণমাধ্যম স্বাধীন হয়ে যাবে? প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেসব কারণে প্রশ্নের মুখে পড়ে সেগুলোর প্রত্যেকটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই৷ কারণ গণমাধ্যম একটি সিস্টেম বা ব্যবস্থা৷ সমাজের অন্য সিস্টেম বা ব্যবস্থাগুলোর বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সেগুলোর সাথে গণমাধ্যমের সম্পর্কের ওপরই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব৷ কিন্তু বাংলাদেশে কোন একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট একটি কারণ আলোচনায় উঠে আসে, সামাজিক গণমাধ্যম থেকে চায়ের টেবিলে তোলপাড় পড়ে৷ ফলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় বটে, কিন্তু সমস্যার মূলে আমরা পৌঁছতে পারি না৷ সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো, বাংলাদেশে আদৌ গণমাধ্যম ব্যবস্থা বলতে কিছু আছে কীনা, থাকলে এর ধরন কি, এই ব্যবস্থার চলকগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন তা নিয়ে এখনও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোন গবেষণা পর্যন্ত হয়নি৷ ফলে একাডেমিক থেকে শুরু করে পেশাগত এবং রাষ্ট্রীয় কোন পর্যায় থেকে গণমাধ্যমের একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ সে অর্থে কখনই হয়নি৷ এ কারণে যখন ইস্যু সামনে আসে তখন আমরা কখনও মালিকপক্ষকে, আবার কখনও সরকারি চাপকে কিংবা কখনও নির্দিষ্ট কোন আইনকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখি থাকি৷
গণমাধ্যম ব্যবস্থার ওপর যতগুলো প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব আছে তার মধ্যে ডেনিয়েল সি. হালিন এবং পাওলো মানচিনির ২০০৪ সালে দেয়া তত্ত্বটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য৷ পশ্চিমের ১৮টি দেশের তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে হালিন ও মানচিনি বলেছেন, একটি দেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা দেখার জন্য চারটি চলক বিশ্লেষণ করতে হয়৷ এক. গণমাধ্যমের বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, দুই. পলিটিক্যাল প্যারালেলিজম বা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে গণমাধ্যমের সম্পর্ক, তিন. সাংবাদিকতার পেশাদারত্বের উন্নয়ন এবং চার. গণমাধ্যম ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের খবরদারির মাত্রা ও প্রকৃতি৷ এই চলকগুলো পরস্পর সম্পর্কিত৷ এগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই৷
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ম্যাস-অডিয়েন্স বা ম্যাস-সার্কুলেশন গড়ে না উঠা, সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের উন্নয়ন না হওয়া, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিক ও রাষ্ট্রীয় চাপ বেড়ে যাওয়া, এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার সূচকের মান ক্রমশ নিম্নগামী হওয়ার কারণগুলোকে একবিন্দুতে স্থাপন করা যায়৷ সেটি হলো, নব্বইয়ের পর গত তিন দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থায় ঘটে যাওয়া ‘পলিটিক্যাল প্যারালেলিজম’-এর বিবর্তন৷ হালিন ও মানচিনির ‘পলিটিক্যাল প্যারালেলিজম’টি বাংলাদেশে নব্বইয়ের পর ‘কর্পোরেট-কাম-পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টিলিজম’-এ রূপ নিয়েছে৷
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে নব্বইয়ের পর গণতন্ত্রের পুনঃজন্মের মধ্য দিয়ে৷ এরশাদের পতনের পর শত ফুল ফুটতে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের প্রসার ঘটে৷ এসেছে নতুন নতুন পত্রিকা, বেড়েছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা৷ কিন্তু যে হারে কর্মসংস্থান আর সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে কমেছে গুণগত মান৷ কারণ হলো, রাজনৈতিক চাপের সাথে কর্পোরেট চাপ একত্রিত হয়েছে৷ নব্বইয়ের আগে বাংলার ভূখণ্ডে গণমাধ্যমের মালিকানা আসতো রাজনীতি থেকে৷ তখন বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা পত্রিকা প্রকাশের জন্য এগিয়ে আসতেন না৷ তবে প্রবাদ প্রতিম সাংবাদিকরা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার বাইরে যাননি৷ এখন গণমাধ্যমের মালিকানায় বড় আকারে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটছে৷ কিন্তু মালিকানা নির্ধারিত হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়৷ সেসব ব্যবসায়ীদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে যারা ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী৷ বাংলাদেশের সব কটি টিভি চ্যানেলের মালিক কোন না কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ও দল-সংশ্লিষ্ট৷ কয়েক মাস আগে ড. আলী রীয়াজ ও মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান বাংলাদেশে গণমাধ্যমের মালিকানা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন৷ সেখানে তারা ব্যাখ্যা করেছেন কেন বেশি গণমাধ্যম থাকার অর্থ গণমাধ্যমের বেশি স্বাধীনতা থাকা নয়৷ তারা বলেছেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মালিকানাগুলো তিন ধরনের৷ এক. পারিবারিক মালিকানা, দুই. রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্ট মালিকানা, এবং তিন. বড় কর্পোরেট হাউজ মালিকানা৷ ড. রীয়াজ ও রহমান তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বরাতে একটি চমকপ্রদ তথ্য যোগ করেছেন৷ ২০১৬ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর দেয়া তথ্য উল্লেখ করে অনলাইন পত্রিকাটি লিখেছিল, বাংলাদেশে ৯৩ শতাংশ সংবাদপত্রের মালিক সম্পাদক, প্রায় ১০০ সংবাদপত্র পেশাদার সম্পাদকের অধীনে চলে৷ এই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে বলতে হবে, শুধু মালিকানা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতার মূখ্য কারণ নয়৷ বরং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর মত আমাদের দেশের গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হলো রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমতি/লাইসন্সে প্রাপ্তি এবং কর্পোরেট স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালনা নীতি৷
গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে থাকা মালিকানা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো নির্ধারণ করে না, বরং আধেয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে৷ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্রব শুধু মালিকদের মধ্যে নয়, সাংবাদিকদের মধ্যেও আছে৷ সাংবাদিকদের দুর্দশা নিয়ে যারা কথা বলবে, মালিকপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াবে সেই ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত৷ ইউনিয়নের নেতারা এখন রাজনৈতিক কর্মীর মতই আচরণ করেন৷ ফলে বাইরের দেশে সাংবাদিকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য ইউনিয়নগুলো যে ভূমিকা দেখা যায় সেটি আমাদের এখানে অনুপস্থিত৷ দৃশ্যত বাংলাদেশ সরকার/রাজনৈতিক দল – মালিক – সাংবাদিক মিলে একটি ত্রিপক্ষীয় ক্লায়েন্টিলিজম বা আন্তঃসম্পর্ক তৈরি হয়েছে৷ এই সম্পর্কের মাধ্যমে এমন একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে যেটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ব্যবস্থার কাঠামোগত জায়গাটিকে প্রতিনিয়ত দুর্বল করছে৷ এই কাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সরকার ও মালিকপক্ষ৷ স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য সরকারগুলো ৫৩টি আইন ও নীতিমালা জারি করেছে৷ গণমাধ্যম ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এই আইনগুলোর কোনটিই বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার প্রয়োজন মেটাতে পারেনি৷ উপরন্তু এগুলোর সবকটিই কোন না কোনভাবে গণমাধ্যমের নিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ও হচ্ছে৷ গণমাধ্যমের মালিকানার সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা না থাকায় চমস্কি এবং হারম্যানের প্রপাগাণ্ডা মডেলের পাঁচটি ফিল্টারই বাংলাদেশে খুব সহজে মালিকপক্ষ ও সরকার প্রয়োগ করতে পারে৷ গণমাধ্যমের মালিকানা, বিজ্ঞাপন, সংবাদের উৎসের সীমাবদ্ধতা, সমালোচনা আর কমিউনিজম – এই পাঁচটি ফিল্টারের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয় যে, শেষপর্যন্ত যে সংবাদটি জনগণের কাছে পৌঁছাবে, সেটি হবে মূল সংবাদের একটি সেন্সরকৃত সংস্করণ৷ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশ্বের অনেক দেশ গণমাধ্যম নীতিমালা ও কাঠামো – দুটোই ঢেলে সাজাচ্ছে৷ যেমন সবশেষ মালয়েশিয়ায় আইন করা হয়েছে, রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গণমাধ্যমের ১০ শতাংশের বেশি মালিকানা রাখতে পারবেন না৷
সিরাজউদ্দৌলা নাটকের একটি সংলাপে সিরাজ তার বিশ্বস্ত ভৃত্যকে বলতে শোনা যায়, ‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, উপায় নাই গোলাম হোসেন৷' বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা বেগতিক৷ এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সমস্যাটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে উপায় সত্যিই পাওয়া যাবে না৷ এই সমস্যার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা অনেক দূর গড়িয়েছে৷ মনে রাখতে হবে, ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাঁশট্যাঁশ’৷