1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হাইকোর্টের ‘শ্যুট ডাউন’ এবং অর্থ পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৯ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের বেসিক ব্যাংকে লুটপাট ও অর্থ পাচারকারীদের এক মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, যারা জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে তাদের ‘শ্যুট ডাউন' করা উচিত। আদালত দুদকের ব্যাপারেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

https://p.dw.com/p/4JHE7
অর্থ পাচারকারীর প্রতীকী ছবি
অর্থ পাচারকারীর প্রতীকী ছবিছবি: Imago/blickwinkel

আইনজীবী এবং অর্থনীতিবিদেরা বলছেন,"উচ্চ আদালতের এই কথায় অসহায়ত্ব এবং হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। দেশের টাকা লুটপাট হচ্ছে। পাচার হচ্ছে। কিন্তু আইনের ফাঁক এবং রাজনৈতিক কারণে তাদের ধরা যাচেছ না। দেশের অর্থনৈতিক এই খারাপ অবস্থার মধ্যেও এই পরিস্থিতি চলছে, যা দুঃখজনক।”

আদালত যা বলেন:

বেসিক ব্যাংকের  চার হাজার কোটি টাকা পাচার ও লুট সংক্রান্ত একটি মামলার আসামি ও শান্তিনগর শাখার তৎকালীন ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর জামিন শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মঙ্গলবার  ওই মন্তব্য করেন।

আদালত বলেন, "অর্থপাচারকারীরা জাতির শত্রু। কেন এসব মামলার ট্রায়াল হবে না? ”দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্দেশ্যে আদালত বলেন,"কেন চার্জশিট দিচ্ছেন না? যারা জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে তাদের ‘শ্যুট ডাউন' করা উচিত।

আদালত মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বিরুদ্ধে  করা তিন মামলায় তাকে জামিন দেননি। তার বিরুদ্ধে সব মামলার তদন্ত কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেন আদালত।

বেসিক ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় মোট ৫৬টি মামলা হয়েছে। মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ১৯টি মামলা আছে। এরমধ্যে ১৫টি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। পাঁচ বছরেও মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আগামী ২১ নভেম্বরের মধ্যে  তদন্তের অগ্রগতি জানাতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পল্টন থানার করা মামলার মোট আসামি ছয়জন।

‘নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েও অর্থ পাচার থামানো যাচ্ছে না’

ব্যাংকিং খাতে লুটপাট:

সরকারি অর্থের অনিয়মের অর্ধেকই হচ্ছে ব্যাংকিং খাত ঘিরে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অডিট রিপোর্টে  ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়।

এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকাই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের। অর্থাৎ আর্থিক অনিয়মের ৫২. ১৮ শতাংশ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। পাশাপাশি গত নয় বছরে ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ গুণ।

এর আগে  ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মোট ২৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের পরিমাণ ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা।

বেসিক ব্যাংক ছাড়াও ২০১১ সালে হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (হোটেল শেরাটন) শাখা থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ২০১৮ সালে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণের নামে এননটেক্স গ্রুপ  ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

আর সর্বশেষ পিকে হালদার চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ব্যাংকের টাকা মূলত ঋণের নামেই লুটপাট হয়। খেলাপি ঋণের সর্বশেষ যে পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া গেছে তাতে তা সোয়া লাখ কোটি টাকা ছড়িয়ে গেছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিলো এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসেবে জুন মাসে তার পরিমাণ হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।

২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৮. ৯৬ শতাংশ খেলাপি। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ।

তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেয়। ঋণের শতকরা আড়াই থেকে চার শতাংশ  অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এর আগে এটা ছিলো শতকরা ১০  শতাংশ।

অর্থ পাচার:

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জানিয়েছে গত অর্থ বছরে(২০২১-২২) শতকরা ২০ থেকে ২০০ ভাগ অতিরিক্ত আমদানি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা তারা শনাক্ত করেছেন। এই ধরনের সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা গত অর্থ বছরে আট হাজার ৫৭১টি। এই লেনদেনের সংখ্যা  তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি। তখন এমন লেনদেন হয়েছে পাঁচ হাজার ২০৮টি।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছিল তিন হাজার ৬৭৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৫৭৩টি। এতে স্পষ্ট যে ব্যাংকিং চ্যানেলে অব্যাহতভাবে অর্থ পাচার বাড়ছে। আর গত অর্থ বছরের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি রপ্তানির আড়ালে  গত অর্থ বছরে পাচার হওয়া অর্থের হিসাব না দিলেও ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই)  বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা।

কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আরো বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। লুটপাটের টাকা হুন্ডি অথবা অন্য কোনো উপায়ে পাচার হয়।

আদালতও অসহায়:

সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,"দেশ অর্থনৈতিক সংকটে আছে। নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েও অর্থ পাচার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট থামানো যাচ্ছেনা। তাই হয়তো উচ্চ আদালত ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।”

তিনি বলেন,"আমাদের আইনে সমস্যা আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনৈতিক সদিচ্ছায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এগুলো অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।”

তার কথা," ঋণ খেলাপিদের  বিরুদ্ধে কঠোর না হয়ে আরো সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কালো টাকা সাদা বা পাচার করা অর্থ ফেরত আনলেও সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আমরা আগেই বলেছি এতে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাচ্ছেও না। আসলে তারা যেনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।”

এই অর্থনীতিবিদ বলেন,"রিজার্ভ সংকট, ডলার সংকট এসবের পিছনে এই লুটপাট অনেকটাই দায়ী। এটা আগে থেকেই বন্ধ করা গেলে এত সংকট হতো না।”

আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন,"এখানে মামলা দায়ের, তদন্ত, বিচার দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এরমধ্যে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকে বের হয়ে যান। আবার আইনেও ত্রুটি আছে। এই মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি হওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে লুটপাট ও পাচার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই হয়তো আদালত হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাই হয়তো শ্যুট ডাউনের কথা বলেছেন। এটা হতাশার প্রকাশ।”

তিনি দুদক প্রসঙ্গে বলেন," এই ব্যাপারে তারাও তেমন কিছু করতে পারছেনা।”

তার কথা," আইনই যথেষ্ঠ নয়, কারণ ব্যাংকের টাকা একটি প্রভাবশালী গ্রুপ লুটপাট ও পাচার করছে। তারা আবার কেউ কেউ ব্যাংকের মালিকও। তারা একে অপরের সহযোগী। এটা হলে তো বন্ধ করা যাবে না। এটা সবাই জানে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।”