হকার উচ্ছেদ: আদৌ কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কলকাতার রাস্তায় হকার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে প্রশাসন। এক মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। এখন কী পরিস্থিতি?
হকার সমস্যা
কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে ফুটপাথে দোকান বা হকারদের বসা নতুন কোনও বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে তা হয়ে আসছে। কিন্তু কয়েক বছর যাবৎ দেখা যাচ্ছে, ফুটপাথে যে হকারেরা ছিলেন, তাঁদের পাশাপাশি আরও ডালা, গাড়ি, ভ্যান যোগ হয়েছে।
দীর্ঘদিনের হকার
যারা দীর্ঘ দিন ধরে হকারি করছেন, তাদের অনেকেরই বক্তব্য, কোভিড-পরবর্তী সময়ে কলকাতা-সহ শহরতলির ফুটপাথে হকারের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত ওই সময় থেকেই তিন ভাগ ফুটপাথ ‘দখল’ শুরু হয়। কলকাতা, সল্টলেক, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন অংশে এই সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। মূলত এই অংশকেই উচ্ছেদ করা শুরু করেছে নবান্ন।
হকার সংগঠনের দাবি
বিভিন্ন হকার সংগঠনের নেতাদের দাবি, কোভিড-পরবর্তী সময়ে কলকাতার ফুটপাথে হকারদের মাথার উপর নির্দিষ্ট মাপের ছাউনি করার কথা বলেছিল পুরসভা। গড়িয়াহাটে বিষয়টি ‘সংগঠিত’ ভাবে হলেও সর্বত্র তা হয়নি। ছবিতে গড়িয়াহাটের ফুটপাতের যে স্টলগুলি দেখা যাচ্ছে সেগুলি স্থায়ী ছাউনি।
পুরসভার সিদ্ধান্ত
সে সময়েই পুরসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশ ফুটপাথে হলুদ রঙের ‘গণ্ডি’ কেটে দিয়েছিল। সেই ‘লক্ষ্ণণরেখা’ পেরিয়ে যাতে দোকানের পণ্য ফুটপাথে রাখা যাবে না, এমনই ছিল শর্ত। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর সেই হলুদ লক্ষ্মণরেখা ফিরিয়ে আনতে চাইছে প্রশাসন। তা নিয়েই সমস্যা।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ
গত ২৪ জুন এক প্রশাসনিক বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার পারিষদদের শহরের ফুটপাত দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন। তড়িঘড়ি তৎপর হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রতিনিধিরা। শহরের কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় অভিযান চালিয়ে ফুটপাত হকারমুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। ঘটনার অভিঘাত আঁচ করে দু-দিন পরেই মমতা ক্ষত মেরামতিতে নামেন এবং বলেন, হকার উচ্ছেদ কখনোই তৃণমূল সরকারের লক্ষ্য নয়।
আবার ফুটপাথে হকাররা
এরপর কেটেছে একপক্ষ কাল সময়। শহরের নানা জায়গা, যেখান থেকে হকারদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই জায়গাগুলিতে আবার ধীরে ধীরে হকার জমতে শুরু করেছে। কোথাও প্লাস্টিকের ছাউনি বা কোথাও খোলা আকাশের নীচে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আবার ফুটপাথে ব্যবসা করার ভরসা ফিরে পাচ্ছেন অনেকে। ওপরের ছবিটি এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের পাশের রাস্তা।
স্টলের পুনর্নির্মাণ
গড়িয়াহাট অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি স্টলের কিছু অংশ ভেঙে দেওয়া হলেও ধীরে ধীরে আবার তা চালু হয়েছে দেখা গেল। জিজ্ঞাসা করায় বিক্রেতা জানালেন, কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের এই মর্মে নির্দেশিকা রয়েছে যে, যাঁরা হকারি করেন, তাঁরা ফুটপাথের এক ভাগ পর্যন্ত দোকান দিতে পারবেন। বাকি তিন ভাগ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে পথচারীদের হাঁটাচলার জন্য। এখন তারা এই নিয়ম মেনেই ব্যবসা চালাচ্ছেন।
গ্র্য়ান্ড আর্কেড
গ্র্যান্ড হোটেলের সামনের ফুটপাথ বহুকাল ধরেই দখল হয়ে গিয়েছে। হোটেলের গাড়িবারান্দার থাম ফুটপাতের ওপরেই। সেই থামের গায়ে প্লাস্টিক লাগিয়ে বিক্রেতারা জামাকাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসতেন। দেখা গেল এখন শুধুই ছাতা লাগানো।
নিউ মার্কেট চত্বর
ধর্মতলা নিউমার্কেট অঞ্চলের ছবিটা অবশ্য বেশ পরিবর্তিত। পথের এই অংশ পুরসভার পার্কিংয়ের জন্য বরাদ্দ। কলকাতা শহরে এই জায়গা নিয়ে একটি রসিকতা চালু আছে। এখানে গাড়ি পার্কিং করে শপিং-এ গেলে ফিরে এসে গাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। গাড়ির ওপর হকারেরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে পড়েন। পুরসভার অভিযানের পর দেখা গেল, এই পথে এখন গাড়ি পার্কিং করা আছে।
ব্য়াগের দোকান
নিউমার্কেটের ঠিক নীচে এই পথে সার দেওয়া ব্যাগের দোকান। ছবিতে গাছটিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, গাছের কাণ্ডের নীচে প্লাস্টিকের ছাউনি টাঙানোর কারণে গাছটিও সেভাবেই শাখা বিস্তার করেছে। প্লাস্টিক খুলে নেওয়ার পর চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগেও রাস্তার ওপর অনেকটা উঠে আসত এই ব্যাগের দোকানগুলো, এখন ফুটপাত ঘেঁষে বসতে হচ্ছে।
চৌরঙ্গীর ছাতা
এই ছবিটি চৌরঙ্গী রোডের উপরে। ছাতা নিয়ে দোকানি রাস্তার অনেকটাই দখল করে নিয়েছেন। এই পথ দখলের ব্যাপারে সরকারি লিখিত কোনও নিয়মের কথা কেউই বলতে পারছেন না। তবে হকারদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগঠন হকারদের পরিচিতিপত্র দেয়। অনেক জায়গায় স্থায়ী ভাবে হকারদের স্টলও করে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা শহরেও পুরসভার তরফে হকারদের ‘রেজিস্ট্রেশন’ দেওয়া শুরু হয়েছে।
লাইট হাউসের সামনে
লাইটহাউজ সিনেমার সামনের এই রাস্তায় কিছুদিন আগেও এই দাগ পেরিয়ে বসতেন হকারেরা। এখন কয়েকদিন হল ছবিটা কিছুটা বদলেছে।
হাতিবাগানের পরিচিত দৃশ্য়
হাতিবাগানের এই স্টলগুলি স্থায়ী হিসেবেই পরিচিত। লোহার রড আর মাথায় টিনের শেড দিয়ে তৈরি। প্লাস্টিক শিটের দেওয়াল পুর-অভিযানে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। হকার বসলেও প্লাস্টিকের শিট এখনও নতুন করে লাগানোর সাহস পাননি বিক্রেতা।
ইতিহাসে বাম অভিযান
১৯৯৬ সালে বাম সরকার কলকাতার ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে ‘অপারেশান সানশাইন’ অভিযান চালায়। রাতারাতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গড়িয়াহাট, শ্যামবাজার, হাতিবাগানের ফুটপাথের দোকান। প্রায় তিরিশ বছরে বদলেছে অনেককিছুই, ধীরে ধীরে আবার দখল হয়েছে শহরের ফুটপাথ, রাস্তা। সরকারি সাহায্যে দখল বৈধতাও পেয়েছে অনেক জায়গায়। ফুটপাথ দখলের পক্ষে বিপক্ষে নানান মতের মাঝে থেকে গিয়েছে অনেক প্রশ্ন, যা হয়তো উত্তরের অপেক্ষাতেই থেকে যাবে।