‘সুযোগপ্রাপ্ত ও বঞ্চিতদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছেই’
২৬ আগস্ট ২০২২ডয়চে ভেলে : দেশের মানুষ অধিকার সম্পর্কে কতোটা সচেতন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অধিকার সম্পর্কে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সচেতন না৷ যখন মানুষ সমষ্টিগত হয় তখন তারা বেরিয়ে পড়ে, অধিকার সম্পর্কে কথা বলে৷ কিন্তু ব্যক্তি মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা নাই৷ একেবারে নাই বলা ঠিক হবে না, কম আরকি৷ যতটা থাকা দরকার ততটা নাই৷ এই জন্য নাই, কারণ ব্যবস্থাটা অনুকূলে নাই৷ মানুষকে অধিকার সচেতন করার ব্যাপারে ব্যবস্থাটা সমর্থন করে না৷ এই ব্যবস্থা মানুষের অধিকারের ধারণাটা ক্রমাগত সংকুচিত করে আনছে৷ সেজন্য মানুষ ব্যবস্থাটাকে মেনে নেয়৷ মনে করে যে, এটাই স্বাভাবিক৷ যেমন ধরা যাক বিচার৷ বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা নেই৷ বিচার পাওয়া তো মানুষের অধিকার৷ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মানুষের মনে অনেক সংকোচ৷ অধিকাংশ মানুষই তো মত প্রকাশ করতে চায় না, কিন্তু যারা মত প্রকাশ করতে চায় তাদের মনের মধ্যে অনেক সংকোচ থাকে৷ যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের সংকোচ ও শঙ্কা দেখা দেয়৷ কী কথা বলতে, কী কথা বলব তারপর আমি বিপদে পড়ব৷
অধিকার কি কেবল চলাফেরা আর কথা বলার স্বাধীনতা না কি অন্যকিছু?
অধিকার তো সবকিছুই৷ প্রাথমিকভাবে আমরা যে মৌলিক অধিকারগুলোর কথা বলি, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষা- এগুলো তো সর্বজন স্বীকৃত মানবিক অধিকার৷ অধিকাংশ মানুষই তো এগুলো থেকে বঞ্চিত৷ যেমন ধরা যাক বাসস্থান৷ দেশের কত মানুষের বাসস্থান নেই৷ তারা কোথায় থাকে ঠিক নেই৷ এরপর চিকিৎসা সেটা তো এখন ব্যয়বহুল হয়েছে৷ রাষ্ট্রের তো মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা৷ এটা তো অধিকার৷ এগুলো তো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে৷
সুস্থ মানুষ তো তাও কিছু অধিকার ভোগ করে৷ কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ মানুষ কী সেই অধিকারটুকু ভোগ করার সুযোগ পায়?
মোটেই না৷ অসুস্থ্য হওয়া বা প্রতিবন্ধী হওয়াটাকে আমাদের সমাজ অপরাধ মনে করে৷ এটার জন্য যে সে দায়ি না- বিষয়টা সেভাবে দেখা হয় না৷ মনোভাবটা এমন যে, সে একটা অপরাধী৷ ভাবটা এমন, সে অপরাধ করার কারণে বিকলাঙ্গ হয়েছে, অসুস্থ হয়েছে৷ এটা অত্যন্ত নির্দয় মনোভাব৷
অধিকার কি ক্ষমতার কাছে অসহায়?
অবশ্যই৷ অধিকার তো ক্ষমতার সঙ্গেই সম্পর্কিত৷ যার ক্ষমতা আছে সে অন্যের অধিকার কেড়ে নেয় বা অন্যের অধিকারের উপর আধিপত্য বিস্তার করে৷ এটা তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যেই আছে৷ মানুষের অধিকারগুলো তো রাষ্ট্রেরই দেওয়ার কথা৷ রাষ্ট্র যে এগুলো দিচ্ছে না, সেটা আমাদের জন্য দুঃখজনক৷
আমরা দেখি যে রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধীদলে যখন থাকে তখন তারা মানুষের অধিকারের কথা বলে৷ কিন্তু তারাই আবার সরকারে গেলে সেই অধিকার হরণের চেষ্টা করে, এই বৈপরিত্য কেন?
কেউ যখন বিরোধী দল থেকে সরকারে যায় তখন তারা ভুলে যায় আগে কি বলেছিল৷ গোটা ব্যবস্থাটাই পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ রাষ্ট্র এই অধিকারগুলো দেবে না৷ ফলে যারা সরকারে যাচ্ছে তারা ওই ব্যবস্থার অধিনেই চলে যাচ্ছে৷ তখন তারা ওই ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করতে চায়৷ সেজন্য অল্প লোক সুবিধা পায়, অধিকাংশ লোক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়৷ এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় সামাজিক ব্যবস্থার বিধান৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কে এল আর গেল তাতে অধিকারের সুরক্ষা হয় না৷ ফলে সরকার বদলে অধিকাংশ মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে না৷
এই ধরুন চা শ্রমিকদের কথাই বলি৷ তারা দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পায়৷ তাদের কী একটু ভালভাবে জীবন-যাপন করার অধিকার নেই?
এটা তো অমানবিক৷ আমার জ্ঞানের মধ্যেই আসে না যে, একটা লোক ১২০ টাকা দিয়ে একটা দিন কীভাবে পার করবে? যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন তাদের তো নাস্তা খেতেই ১২০ টাকা লাগে৷ তাহলে কি দাঁড়াল ব্যাপারটা৷ তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, দূরে থাকে৷ ফলে তাদের খবর আমরা মধ্যবিত্তরা জানি না, চিন্তাও করি না৷ এটা তো ভয়াবহ পরিস্থিতি৷
এ তো গেল, মানুষের অধিকারের কথা৷ প্রাণীদের অধিকারের ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন?
যেখানে মানুষের অধিকার নেই বা সংকুচিত, সেখানে প্রাণীদের অধিকারও সংকুচিত হবে সেটাই তো স্বাভাবিক৷ গোটা ব্যবস্থাটাই অমানবিক ব্যবস্থা৷ অধিকার বঞ্চিত মানুষ প্রকৃতির উপর অত্যাচার করে, অন্য প্রাণীদের উপর অত্যাচার করে৷ এটা সেই ব্যবস্থা যেখানে মানুষও অধিকার পাই না, প্রাণীরাও পাই না৷ এখানে বঞ্চনাটা খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে৷ প্রাণীদের উপর অত্যাচার এখন চরম আকার ধারণ করেছে৷
সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আদালতে মানুষ কতটা অধিকার ভোগ করতে পারে?
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তো আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান৷ এটা পুরানো আমলাতন্ত্র৷ এটা বদলায়নি৷ বরং আরও কঠিন হয়েছে৷ এখানে মানবিক আচরণ পাওয়া যায় না৷ আদালতে যে বিচারের জন্য কেউ যাবে সেখানে যেতে অনেক টাকা লাগে৷ আদালতে গেলে যে বিচার পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা তো পরের ব্যাপারে৷ আদালতে যাওয়াটাই তো অনেক ব্যয়বহুল৷ সেখানে গেলে যে ঝামেলায় পড়বে সে কারণে অনেকেই বলে বিচার চাই না৷ বিচার কার কাছে চাইব৷ পরিস্থিতি এখন এমন৷
মানুষের অধিকার হরণ না করে কি ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না?
সেটাই তো উচিত৷ কিন্তু আমাদের যে ব্যবস্থা সেটা তো বৈষম্যমূলক৷ এখানে কিছু লোক সুবিধা পাবে এবং অধিকাংশ লোক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে৷ সেজন্য দেখা যায়, ক্ষমতায় যারা যায় তারা সুবিধাপ্রাপ্ত৷ সেই সুবিধাগুলো তারা ভোগ করতে চায়৷ সেজন্যই অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত হয়৷ এটা কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার না বা আমাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না৷ গোটা ব্যবস্থাটাই এমন৷ সুযোগ প্রাপ্ত ও সুযোগ বঞ্চিতদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছেই৷
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের অধিকার সচেতন করতে কতোটা ভূমিকা পালন করছে?
তারা করে৷ তারাই তো তুলে ধরে৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা ইস্যুতে তারাই সোচ্চার হয়৷ কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সীমাবদ্ধতা হল, তারা সংস্কারমূলক৷ তারা সংস্কার চায় কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন নেই৷ এই ব্যবস্থার একটা মৌলিক পরিবর্তন দরকার৷ সেটা তারা বলে না৷ তারা এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেই এর মধ্যে কতটা বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করে৷ তারা মনে করে, এই ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখার জন্য সংস্কার দরকার৷ একটা গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করা দরকার৷ যে রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে অধিকারে কোন বৈষম্য থাকবে না৷ যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে৷ যেখানে জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হবে৷ সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের৷ ওই জায়গাটাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের যাবার কথা না বা তারা যেতেও পারে না৷
মানুষকে কীভাবে আরও বেশি অধিকার সচেতন করা যায়?
যাদের আমরা বিবেকবান বা বুদ্ধিমান মনে করি তারা যতটা সোচ্চার হবে, আর সোচ্চার হতে গেলে আন্দোলন করতে হবে৷ তারা যদি আন্দোলন করে তাহলে পরিবর্তন হবে৷ কিন্তু এই আন্দোলনের আগে একটা সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিও দরকার৷ আগে মানুষের সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার৷ আন্দোলন ছাড়া ভরসার কোন জায়গা নেই৷