1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সুফীতত্ত্ব - নানা ধর্মের মাঝে এক সেতুবন্ধ

দেবারতি গুহ১৫ আগস্ট ২০০৮

ধর্ম, অথচ ধর্ম নয়৷ এ যেন জীবন বোধ৷ মানুষে-মানুষে সংযোগ৷ তত্ত্বের তির্যক বাকযুদ্ধকে পিছনে ফেলে মর্মের গভীরে অনুপ্রবেশ৷ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান - সব ধর্মের মানুষ যেখানে একই সূত্রে বাঁধা৷ এক স্বরে ঈশ্বরের নৈকট্যকামী৷

https://p.dw.com/p/EyCO
এরাই সুফী (ফাইল ফটো)ছবি: DW / Ayari

এরাই সুফী৷ সম্প্রতি জার্মানির কাল শহরে হয়ে গেল বাত্‌সরিক সুফী ফেস্টিভেল৷ কাল শহর আমাদের এই বন শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়৷ ট্রেনে করে মাত্র ঘন্টা খানেক ৷ সেখানে পৌঁছে দেখি কাল শহরের ওসমানি মসজিদের পাশে বিশাল সবুজ মাঠটি সাজানো হয়েছে রঙ-বেরঙের তাঁবু, প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের রকমারি খাবার দোকান আর মস্ত বড় স্টেজ দিয়ে৷ এ যেন এক মেলা৷ নানা দেশ থেকে হরেক রকম পোষাক পরে শয়ে শয়ে মানুষ ভীড় করেছে সেখানে৷ মাথায় নানা ধরনের পাগড়ি, মুখে লম্বা দাড়ি, অনেকের পরনে আবার আলখাল্লা৷ দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে - এ কি মৌলবাদীদের কোন মজলিস ! কিন্তু না৷ ইংল্যান্ডের বারমিংহ্যাম থেকে আসা গানের দলটি তাদের গান শুরু করতেই বুঝলাম, হিসেবে কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে৷

Sufi Gemeinde in der Eifel
সুফী ফেস্টিভেলে নারীদের অংশগ্রহণও ছিলো (ফাইল ফটো)ছবি: DW / Ayari

সে গান ছিল এই প্রজন্মের৷ আধুনিকতার রঙিন ফিতেয় মোড়া৷ মানুষে-মানুষে ভালোবাসার কথায় সাজানো৷ ব্যান্ডটির নাম ছিল আশিকে রসুল৷ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে নিঃসৃত এক চিরায়ত আবেগের প্রকাশ৷ যা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মূলমন্ত্রকে যেন এক সূত্রে বেঁধেছে৷ বেঁধেছে ধর্মকে সংস্কৃতির সঙ্গে৷ প্রেমকে শান্তির সঙ্গে৷ মানব মনকে স্বপ্নের সঙ্গে৷ সুফী ঘরানার সঙ্গীত সেখানে মিশে গেছে কাওয়ালীর তালে তালে৷

এই তরুণ দলটির জন্য কি এই সুফীতত্ত্ব ?

আশিকে রসুল বলেন, এ ধরনের সুফী ফেস্টিভালে নানা ধর্মের মানুষ এসে থাকে৷ সুফীতত্ত্বের এটাই প্রধান বিষয়, যে এই তত্ত্ব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের একই সঙ্গে আকর্শন করে৷ এটাই সুফীতত্ত্ব৷ যেখানে মানবতাবাদ উচ্চারিত হয়৷ এটা ইসলাম ধর্মের একটি আধ্যাত্মিক দিক৷ যেখানে বলা হয় হৃদয়ে-হৃদয়ে যোগসূত্রের কথা৷ বলা হয় ভালোবাসার কথা৷

সবুজ সেই প্রাঙ্গনে ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হয়ে যায় এমন অনেকের সঙ্গে৷ বন্ধুত্ব পাতাই ইরান, সিরিয়া, তুর্কি, পাকিস্তান, হল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড, জার্মানি থেকে আসা অগুন্তি মানুষের সঙ্গে৷ সবারই সেই এক কথা৷ যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই৷ ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ নয় - চাই সহনশীলতা, চাই একে অপরের প্রতি সহানুভূতি৷ চাই সংলাপ৷

এই পারস্পরিক বোঝাপড়াই ধ্বনিত হচ্ছিল গানের কথায় আর সুরে৷ এমনকি নব্য যুগের ব্যান্ড চালদুনের সঙ্গীতের সঙ্গে আশিক রসুলের গানেও প্রতিফলিত হচ্ছিল এক আবেগ৷ রেগে, হিপ হপ, ব্লুসও-এর সঙ্গে কাওয়ালীর সংমিশ্রণ যেন পৌঁছে যাচ্ছিল মানুষ থেকে মানুষে৷ হৃদয় থেকে হৃদয়ে৷

সুফী প্র্যাকটিসের অন্যতম বিতর্ক

প্রশ্ন হল, সুফী সন্তরা পয়গম্বরের আদি সঙ্গী বা শিষ্য বা তাঁর পরিবারের কারোর উত্তরাধিকারী কিনা৷ এটা আপেক্ষিকভাবে সুফী সন্তদের লেজিটিমেসি নিয়ে প্রশ্ন৷ সুফীদের কারো কারো দাবী যে সুফীদের বাণী, কাব্য বা সঙ্গীতে এমন বহু রূপক আছে - যা সরাসরি ইসলামের ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে ইটিমোলোজির বন্ধনে বাঁধা৷ সত্যিই কি তাই ?

আকাশকন্যা নামে খ্যাত তুর্কি বংশদ্ভূত হুল্যা কান্দেমীর কিন্তু তাই বললেন, আমি আমার বিষয় কখনই এককভাবে নির্দিষ্ট করি না৷ আমার কাছে এটা যেন পূর্ব নির্ধারিত৷ এক দৈব নির্দেশ৷ আল্লাহই যেন আমাকে বিষয়গুলি বলে দেন৷ তবে আমি দেখেছি যে ভালোবাসাই এর মূল বিষয়বস্তু৷ ভালোবাসা যেন নানা ভাবে, নানা আকারে আমাদের কাছে ধরা পরে৷ সঙ্গীত যখন কারুর মনের ভাব প্রকাশ করার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা একটি নদীর মতো কাজ করে৷ নিজের অভিজ্ঞতা তখন আপনিই চলে আসে কথায়, সঙ্গীতের মাধুরি মিশিয়ে৷ চলে আসে ভালোবাসার নানা অভিব্যাক্তিতে৷

আকাশকন্যার অনবদ্য সঙ্গীতে যখন মাতোয়ারা জনতা, তখন মাঠের অন্য এক প্রান্ত থেকে ভেসে এলো কাবাবের গন্ধ৷ কি করি ? গেলাম সেখানে৷ ছেলেমেয়ারা একসঙ্গে বসে কাবাব বানাচ্ছে৷ তাদের দেখাদেখি আমিও একটা লাল রঙের কাপড় কিনলাম৷ ঢেকে ফেললাম মাথা৷ আর কিছুক্ষণ পরেই যে মসজিদের ভিতরকার হলটা খোলা হবে৷ যেখানে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন অন্যতম সুফী মিউজিসিয়ান শেইখ হাসান৷

শেইখ হাসানকে দেখে মনে পড়ে গেল মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কথা৷ সেই মধ্যযুগীয় মুসলিম সুফী যিনি হাস্যরসাত্মক চরিত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷ তাঁর হাস্যরসাত্মক গল্প এবং জীবনবেদী উক্তিগুলিই বার বার যেন উঠে আসছিল বিস্মৃত অনুসঙ্গ থেকে৷ শেইখ হাসানের আমুদে সঙ্গীত পরিবেশনা থেকে৷

ঈশ্বরের আরাধনায় নিমগ্ন সবাই

ততক্ষণে সূর্য অস্ত গেছে৷ মাঠের থেকে উঠে শয়ে শয়ে মানুষ এসে বসেছে মসজিদ প্রাঙ্গনে৷ গান ধরেছেন তাঁর কন্ঠে যেন যাদু৷ সেই যাদুর তালে গা ভাসিয়ে ঈশ্বরের আরাধনায় নিমগ্ন উপস্থিত সকলে৷ কেউ ভাবলেশহীন৷ চোখ বন্ধ৷ আবার কেউ হাত তুলে দিয়েছে অদেখা, অধরা ভাবনার দিকে৷ একের পর এক গান৷ হাজারটা ফরমায়েস৷ গান চলে সমস্ত রাত ধরে৷ মন্ত্রমুগ্ধ এই আমিও৷

গানের শেষে করতালির আওয়াজে যেন ঘুম ভেঙে যায়৷ গভীর এক ঘুম - অনেকটা স্বপ্নের মতো৷ ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্কের কথা তুলে ধরলেন পাকিস্তান থেকে আসা বিখ্যাত কাওয়ালী গায়ক মাহমুদ সাবরিও৷ কাওয়ালী হাজার বছরেরও পুরোন এক সঙ্গীত ঘরানা৷ খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি ছিলেন এর জনক৷ মানুষের হৃদয়ের, জীবনবোধের খুব কাছের জিনিস হল কাওয়ালী৷ এ এক অনুপম উপলব্ধি৷ এই যে এখানে এতো ধরনের গায়ক, তাঁদের গায়কী, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, বাজনা৷ ধর্মচর্চার সঙ্গে এর কোন বিরোধ নেই ?

মাহমুদ সাবরি বলেন, হে আল্লাহ, তুমিই সত্য৷ সৌন্দর্য তোমারই দান৷ সৌন্দর্যের প্রকাশও তোমারই করুনা৷ তোমার ইচ্ছা পূরণ ছাড়া আমার আর কিছু করণীয় নেই৷ আমি তাতেই রাজি, যাতে তোমার সম্মতি আছে৷ কাজেই, তাঁর মর্জি অনুযায়ী যদি কাজ করা হয়, তবে সবকিছুই সফল হবে৷

কথায় বলে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই৷ এটাই কি সুফীতত্ত্বের মূল কথা ? বাংলার বাউল আর সুফীতত্ত্ব - দুটোর মূলেই রয়েছে মানবতাবাদ, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম আর ভালোবাসার কথা৷ আল্লাহকে আপন করার কথা৷ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে খোঁজার, খুঁজে পাওয়ার কথা৷