পুলিশের আছে শুধু ‘আশার বাণী’
১৩ নভেম্বর ২০১৭ড. মোবাশ্বার হাসান সিজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক ছাত্র৷ সাংবাদিকতাও করেছেন তিনি৷ সিজারের সন্ধান দাবিতে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা৷ সেখানে ছিলেন একই বিভাগের সাবেক ছাত্র এবং বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’-এর বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিজার আমাদের একই বিভাগের শুধু ছাত্রই ছিলেন না, আমার সহকর্মীও ছিলেন৷ আমরা যখন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদভিত্তিক অনলাইন (নিউজ পোর্টাল) বিডিনিউজ শুরু করি, সিজার সেখানে একজন উদ্যমী তরুণ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন৷ তিনি তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন৷ পাস করে বের হওয়ার পর সিজার শিক্ষকতায় চলে যান৷ আমাদের কাছে মনে হয়ছে সিজারের জন্য আমাদেরও কিছু করার আছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সিজার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে যদি মত প্রকাশের কোনো কারণ থেকে থাকে, তাহলে তা তো সাংবাদিকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়৷ আর সাংবাদিকরা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সিজারকে উদ্ধারের জন্য আরো চাপ সৃষ্টি করতে পারে৷’’
তবে জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, ‘‘এইসব ঘটনায় যেমন সামাজিক চাপ সৃষ্টি হওয়া দরকার, তেমন হচ্ছে না৷’’
বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোরডটকমের খবর অনুযায়ী, রবিবারের সমাবেশে সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, ‘‘কারো একার পক্ষে সিজারকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়৷ এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷’’
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘‘এ দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, জাতির জনকের হত্যার বিচার হয়েছে, মুবাশ্বার কী এমন অপরাধ করেছে, যেটির বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাকে অগোচরে শেষ করে দেওয়া হবে?’’
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শবনম আযীম বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে সিজার একদিন ফোনে বলেছিল– কিছু একটা ঘটবে, আমার ভালো লাগছে না৷’’
‘‘আজ সে নিখোঁজ৷ রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে অনুরোধ, সিজারের শাস্তি পাওনা হলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হোক, কিন্তু জীবিতভাবে সামনে আনা হোক৷’’
সমাবেশে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘‘এই গুম আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে৷’’ সমাবেশে উপস্থিতরা ৭২ ঘন্টার মধ্যে সিজারকে উদ্ধারের দাবি জানান৷ এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তাঁরা৷
সিজার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন৷ দেশে ফিরে এসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন৷ তাঁর কর্মক্ষেত্র নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা এখন তাঁকে নিয়ে উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় রয়েছেন৷ তবে ওই বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা এখনো কোনো প্রকাশ্য সমাবেশ বা র্যালি করে প্রতিবাদ জানাননি৷ জানা গেছে, আগামী কাল মঙ্গলবার (১৪.১১.১৭) ছাত্রদের উদ্যোগে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি আহ্বান করা হয়েছিল৷ ফেসবুকে এ নিয়ে প্রচারও হয়৷ পরে অজ্ঞাত কারণে ওই কর্মসূচি বাতিল করা হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা বেলাল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সিজার যে বিভাগের শিক্ষক, সেই বিভাগের চেয়ারম্যান সিজারের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন৷ সিজারের ব্যাপারে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি৷ এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নাই৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত সিজারকে উদ্ধারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকরা কোনো ধরনের কর্মসূচি পালন করেনি৷ কোনো কর্মসূচি দেয়াও হয়নি৷’’
এদিকে ছয় দিনেও সন্তানের খোঁজ পাওয়া না যাওয়ায় সিজারের বাবা মোতাহার হোসেন ভেঙে পড়েছেন৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা হয় সিজারের ছোট বোন তামান্না তাসনিমের৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো একমাত্র আশাই করতে পারি৷ সিজারের ব্যাপারে কোনো তথ্য নাই, আপডেট নাই৷ আশা ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি! আশাই তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ বা সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে , আমরা চেষ্টা করছি৷ আশা হারাবেন না৷’’
তামান্না রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে ছিলেন৷ সেখানে তিনি ‘অতি দ্রুত’ সিজারকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান৷ পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি ভিত্তিহীন প্রচার না চালানোর আহ্বানও জানান তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘কিছু সংবাদ মাধ্যম এমন সব তথ্য দিচ্ছে, তা ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ যা সঠিক নয়, তা দেয়া ঠিক নয়৷ সিজারকে যাতে পাওয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যেই কাজ করা উচিত৷’’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমানের কাছে সিজারের ব্যাপারে সর্বশেষ তথ্য জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তাঁকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি৷ কিন্তু এখনো তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷’’
তিনি জানান, সিজারকে উদ্ধার করার বিষয়ে ‘সব কলা কৌশল’ এবং ‘গোয়েন্দা তথ্য’ই কাজে লাগাচ্ছে পুলিশ৷
এদিকে রবিবার ঢাকার মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘‘নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে সময় লাগবে৷ অপহৃতদের খুঁজে না পাওয়া ব্যর্থতা নয়৷ একটু সময় দিতে হবে৷ তাঁদেরকে ফিরে পাওয়া যাবে৷ তাঁদের উদ্ধারে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে৷’’
প্রসঙ্গত, সিজার গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে সিজার নিখোঁজ৷ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সম্পৃক্ততাও ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়৷ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি৷ তবে তাঁর এক বন্ধু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সিজারের এসব কাজ ছিল পুরোপুরি গবেষণাধর্মী৷ এই গবেষণার মধ্যে জঙ্গি দমন বা এ জাতীয় কিছু ছিল না৷ তবে সে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল৷ এ কারণে সম্প্রতি সে তার বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিল৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...