বিশ্বজুড়েই এখন সাংবাদিকতার বেহাল দশা চলছে। সাংবাদিকতার নানা ধরন রয়েছে। সিরিয়াস গণমাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বেশি প্রাধান্য পায়। ট্যাবলয়েড সংবাদমাধ্যমে সাধারণত চটুল এবং সেনসেশনাল নানা সংবাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে অনেকক্ষেত্রে এই পার্থক্য বিলীন হয়ে গেছে। সেটা কেন, বলছি।
সংবাদমাধ্যমের বাজার যখন কেবল অফলাইনে ছিল, অর্থাৎ কেবল ছাপা পত্রিকা, রেডিও এবং টিভিতে সীমাবদ্ধ ছিল, তখন বিজ্ঞাপনের ধারাও ছিল একরকম। গণমাধ্যম ছাড়া দেশব্যাপী জনগণের কাছে সহজে নিজের পণ্যের নাম ও ব্র্যান্ড পৌঁছে দেয়ার আর কোনো সহজ বিকল্প উপায় ছিল না ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর। বিজ্ঞাপন বেশি এবং গণমাধ্যম পরিচালনার খরচ বিপুল হওয়ায় হাটে-ঘাটে-মাঠে পত্রিকা বা টিভি খোলার সুযোগও তেমন একটা ছিল না।
এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে (বা অকল্যাণে) বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আর খুব বেশি সংবাদমাধ্যমের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। বরং, সংবাদমাধ্যমগুলোই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কিভাবে ভালো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, যাতে তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার খরচ উঠে আসে। এর পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিতভাবে গজিয়ে ওঠা হাজার হাজার অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুক, ইউটিউব, সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে গণমাধ্যম।
ফলে অফলাইনে টিভির টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট), সংবাদপত্রের সার্কুলেশন (কয় কপি বিক্রি, তার হিসাব) এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিউ, রিচ, লাইক, এংগেজমেন্ট হয়ে উঠেছে সংবাদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার কুপ্রভাব আমরা দেখছি। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের বদলে যেনতেন প্রকারে পাঠকপ্রিয়তা অর্জনই হয়ে উঠেছে অধিকাংশ গণমাধ্যমের লক্ষ্য।
ভিডিওতে যত ভিউ, তত অর্থ উপার্জন, আবার সরকারি বিজ্ঞাপন না পেলে পত্রিকা চালানো মুশকিল। ফলে একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দর্শকদের চাহিদা মেটানো, অন্যদিকে ছাপার অক্ষরে সরকারকে বিপদে না ফেলার চর্চাটা সব গণমাধ্যমেরই বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবিবরণীতে পরিবর্তন এখন আর নতুন কিছু না।
এর ফলে সাময়িক লাভ হয়তো গণমাধ্যমের হচ্ছে, কিছু লাইক আর ভিউ কামানো যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গণমাধ্যমের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা আমরা কিভাবে সামলাবো, তা জানি না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম নিজের মতো করে চলছে না। সেটা কবে চলেছিল, জানা নেই। কিছু সংবাদমাধ্যম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করেছে, কিছু টিকে থাকার জন্য আত্মসমর্পণ করেছে, কিছু সরাসরি দলীয় এজেন্ডা গণমাধ্যমের রূপ ধরে প্রচার করেছে।
এটা কেবল গত ১৫-১৭ বছরের সংকট না। এই সংকট আরো গভীরে, আরো অতীতে।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর ইত্তেফাক পত্রিকায় জাল পরা বাসন্তীর ছবির কথা তো সবারই মনে আছে নিশ্চয়ই? এ নিয়ে দেশজুড়ে তখন তুলকালাম কাণ্ড হয়। কবি রফিক আজাদ লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা 'ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো'। পরবর্তীতে এই ছবিটি সাজানো জেনে রফিক আজাদই আবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "আমি সবার কাছে বলতে চাই সেই বাসন্তী ছিল সাজানো। কবিতা লেখার সময় বা তারপরেও জানি না যে ছবিটা ছিল ভুল। সে মরার আগে আমাকে সেই কথা বলেছে। ঐ শালা ফটোগ্রাফারের ছবি দেইখা তো আমি কবিতাটি লিখতে বসেছি। সে জন্য আমি নিজেকে দোষী ভাবি না। ভাবি, বিস্তারিত জানা উচিত ছিল।" (রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার, বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ মার্চ, ২০২০)
এই ঘটনার সত্য-মিথ্যা নিয়ে ৫০ বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। তবে আমি যেতে চাই অন্য বিতর্কে।
সংবাদমাধ্যমের ওপর তখনও ছিল মানুষের প্রবল অনাস্থা। তার মূলে ছিল একটাই কারণ। মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে সংবাদমাধ্যম আসলেই সঠিক সংবাদ পরিবেশন করছে কিনা।
সংবাদমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করলেও তার একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে পারে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থাকে। অ্যামেরিকায় ঘোষণা দিয়েই অনেক সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক দল বা নেতার পক্ষ সমর্থন করে। ভারতে আবার অধিকাংশ মূলধারার সংবাদমাধ্যম নিজেদের নিরপেক্ষ দাবি করে মোদীর সরকারের জয়গান গায়, যাকে অনেকে নাম দিয়েছেন 'গোদি মিডিয়া'।
বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি স্বাধীনতার আগে থেকেই ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেই কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পাদনায় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধিও ছিলেন। তখনও সংবাদমাধ্যম যে সরাসরিই রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ অবলম্বন করতো, সেটা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে বোঝা যায়।
তিনি লিখেছেন, "দৈনিক আজাদই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলীম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থন করতো।" ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ২০ জানুয়ারি আসাদুজ্জামান আসাদ নিহত হওয়ার পর তার রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল হয়। চার দিনেও এর প্রতিবাদ করে কোনো সম্পাদকীয় না লিখে পাকিস্তানপন্থি অবস্থান নেয়ায় ক্ষুব্ধ জনতা ঢাকায় মর্নিং নিউজের কার্যালয়ে আগুন দেয়। পত্রিকাটির মালিক ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দিনের আত্মীয় খাজা নূরউদ্দিন। একই ভবনে অবস্থিত পাকিস্তান সরকার পরিচালিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানের কার্যালয়ও পুড়ে যায়।
কিন্তু দৈনিক পাকিস্তান সরকারি পত্রিকা হলেও এর অবস্থান ছিল সরকারি অবস্থানের ঠিক বিপরীত। পত্রিকাটিতে ১৯৭১ সালে সিনিয়র সাব-এডিটর হিসাবে কাজ করতেন অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান। তার বক্তব্যে, "ওই সময়টায় প্রেস ট্রাস্টের যারা মালিক ছিলেন, তারা সংবাদপত্রটির কাছেই ভিড়তেই পারতেন না। ... মার্চের আগের দিকে ফার্স্ট এবং সেকেন্ড লিডে কোনো রকমে মোনায়েম খান, আইয়ুব খানের নামে দিয়ে বাকি সব নিউজে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অভিলাষ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখালেখিতে ভর্তি ইত্যাদি থাকতো।"
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পর ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের দৈনিক পাকিস্তানের ছবিটি নিশ্চয়ই সবাই দেখেছেন। দৈনিক পাকিস্তানে পাকিস্তান কেটে দিয়ে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশ। কয়েকদিন পর থেকে আবার নাম বদলে সেটি প্রচারিত হতে শুরু করে দৈনিক বাংলা নামে।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ॥৯৭৫ সালে সেই বঙ্গবন্ধুই চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন। দলে দলে সাংবাদিকেরাও বাকশালে যোগ দিলেন। অন্তত ৫২৮ জন সাংবাদিক বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন বলে নানা তথ্যে জানা যায়।
২০২৪ সালে অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ২০২১ সালে ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। সে বছরের ৩০ আগস্ট আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী প্রেস ইনস্টিটিউটের কর্মশালায় বাকশাল ও সাংবাদিকতা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। তার দাবি অনুযায়ী, পত্রপত্রিকার সংখ্যা কী হবে সেটির জন্য বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের নিয়েই একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। এবং তাদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতেই চারটি ছাড়া বাকি পত্রিকায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল।
হাছান মাহমুদের আরেকটি দাবি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, "যখন বাকশাল গঠন করা হয় তখন এনায়েত উল্লাহ খান বলেছিলেন, দিস ইজ টাইম টু স্ট্যান্ড বিহাইন্ড বাকশাল। যখন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করলেন তখন তিনি বললেন, দিস ইজ টাইম টু স্ট্যান্ড বিহাইন্ড খন্দকার মোশতাক।"
তার এই দাবির সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে যাচ্ছি না। কারণ, হাছান মাহমুদের দেয়া তথ্য়ের বিপরীত নানা তথ্যও সর্বজনবিদিত। এনায়েত উল্লাহ খানের উইকলি হলিডে পত্রিকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়া বুদ্ধিজীবীদের তথ্য সন্ধানে গঠিত সার্চ কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি।
অথচ সেই হলিডে পত্রিকাই ১৯৭৫ সালে সরকারের সমালোচনা করে লেখা প্রকাশের দায়ে নিষিদ্ধ করা হয়, এনায়েত উল্লাহ খানকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছিল। এনায়েত উল্লাহ খানের প্রতিষ্ঠিত নিউ এইজের সম্পাদক নুরুল কবীরকেও আমরা দেখেছি ১/১১ পরবর্তী সেনাসমর্থিত সরকারের সমালোচনামূলক অবস্থান নেয়ায় হুমকির মুখে পড়তে।
আবার সেই ১/১১ সরকারের সময় সেনাগোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর সরবরাহ করা তথ্য যাচাইবাছাই না করে প্রকাশ করার জন্য পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন আরেকটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। সেটাও আমরা দেখেছি। সেই সম্পাদকের পত্রিকাকেই আমার 'সরকারের বিরুদ্ধে' সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে গণভবনে বা সরকারি কোনো আয়োজনে নিমন্ত্রণ না পেতে দেখেছি। আবার ইদানিং সেই সম্পাদককেই 'প্রধান উপদেষ্টার হাতকে শক্তিশালী করুন' শিরোনামে সম্পাদকীয়ও লিখতে দেখেছি।
যখন সম্পাদকই কোনো সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে বলেন, তখন তার অধীনে কর্মরত সাংবাদিকদের আর তা করা ছাড়া উপায় কী! এর আগেও এমন অনেক 'হাত শক্তিশালী' করার উদাহরণ তো আমাদের পেছনে রয়েছেই। এর বিপরীত উদাহরণও রয়েছে অবশ্য। যেমন ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আসাদের মৃত্যু নিয়ে লেখা 'আসাদের শার্ট' কবিতার লেখক কবি শামসুর রাহমানকে ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমগুলোও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বিরোধী মতের গণমাধ্যম বন্ধ, দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করা ব্যবসায়ীদের মালিকানায় নতুন গণমাধ্যমের যাত্রা, ইত্যাদির মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে সাংবাদিকতার মুখোমুখি। প্রভাবশালী গুটিকয়েক সাংবাদিক ছাড়া বাকি সাংবাদিকদের বিপদ দুই তরফেই। তাদের বসের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কেন মালিকের পছন্দ মেনে সংবাদ তৈরি করা হলো না। অন্যদিকে, রাস্তায় জনগণের কাছে উত্তর দিতে হয় কেন তারা সত্যি কথা তুলে ধরেন না।
অনাস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন সত্যটাকেও আর সত্য বলতে জনগণ রাজি না। অন্যদিকে গুজবটাকে তারা সানন্দে 'আসল সত্যি' বা 'লুকিয়ে রাখা সত্যি' বলে মেনে নিচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তথ্য অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করায় যমুনা টেলিভিশন আন্দোলনকারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে এখন ঘনঘন তাদের ঘোষণা দিতে হচ্ছে, কোন সংবাদটি আসলে তাদের নয়, বরং তাদের নাম দিয়ে অন্যরা ফেসবুকে চালিয়ে দিচ্ছেন।
কেবল ফেসবুক নয়, ভুলভাল সংবাদ জাতীয় সংবাদমাধ্যমে এত বেশি স্থান করে নিচ্ছে যে শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারকে শিরোনাম করতে হচ্ছে, 'এ বছরের প্রথম ছয় মাসে আমরা কোনো ভুল সংবাদ প্রকাশ করিনি'।
এখন বিটিভিতে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে অকল্পনীয়। অথচ এটাই হওয়ার কথা ছিল। রাষ্ট্রটা যে সরকারের না, বরং জনগণের, বিটিভি পরিচালনার টাকাটা যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নিজের পকেট থেকে দেন না, বরং জনগণের টাকা, সেটা সবাই ভুলে যান। আমি কাজ করি জার্মান জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে। সরকারের এমন কোনো ভুল নেই, যা এই গণমাধ্যম প্রচার করে না। কারণ এই গণমাধ্যম মনে করে, তারা জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ, কোনো দল বা ব্যক্তির কাছে নয়।
শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মূল সংকট এর তারল্যে। অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিকানা বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে, কারণ এত বড় অবকাঠামো পরিচালনা, ভালো সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত বেতন দেয়ার সামর্থ্য অন্য কারো নেই। আর গণমাধ্যম পরিচালনায় রয়েছেন প্রভাবশালী সাংবাদিকেরা, যারা আসলে সরকারি নীতিকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন যে সাংবাদিকতার নীতিই সেখানে দুর্বল হয়ে পড়ে।
একসময় আমরা সাংবাদিকদের মুখে শুনতাম ম্যাডাম, তারপর শুনলাম নেত্রী, তারপর এত সর্বব্যাপী না হলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে শুনছি স্যার।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের পরিচলনা ও ক্ষমতাতেও পরিবর্তন এসেছে বলে দেখতে পাচ্ছি। একটা দলের মনোভাবাপন্ন সাংবাদিকদের বদলে অন্য মতের সাংবাদিকদের কর্তৃত্বে এসেছে অধিকাংশ গণমাধ্যম। কিন্তু মালিকানার কী হবে? সেটাও কি এক দলের ব্যবসায়ীদের বদলে অন্য মতের ব্যবসায়ীদের কাছে যাবে, নাকি সমঝোতার মাধ্যমে একই মালিকানাতে একইভাবে কেবল নতুন বোতলে সংবাদ পরিবেশন হবে?
অনেকেই মনে করেন, এখনো সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি মানা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে কেবল প্রেস রিলিজের মতো সরকার বা পুলিশের ভাষ্য তুলে দেয়া হচ্ছে পত্রিকায়, টিভিতে। অনেকক্ষেত্রে এমন ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরা যাবে। কোথাও কোথাও হামলা করছে 'দুর্বৃত্তরা', কোথাও 'একদল শিক্ষার্থী', কোথাও 'একদল বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী' যাদের কোনো পরিচয় কেউ জানে না। অনেকক্ষেত্রে হামলাটাও হয়ে যাচ্ছে 'হট্টগোল'। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য মারা গেলেও এইটুকু ছাড়া আর কোনো তথ্যই জানা যাচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে সাংবাদিক নেতা আখাউড়া সীমান্ত থেকে আটকে গিয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছেন ময়মনসিংহ সীমান্তে।
নানা কিছু ঘটছে, আমরা জানছি। কিন্তু কেন ঘটছে, কে ঘটাচ্ছে, কিভাবে ঘটাচ্ছে, অনেকক্ষেত্রেই সেগুলো আমরা জানতে পারছি না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদে মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় কেন বদল ঘটলো, সংবিধান সংস্কার কমিশনের দায়িত্বে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই কেন পরিবর্তন হলো, এমন নানা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
সাংবাদিকেরা অনেকেই এখন অতীত সংবাদমাধ্যমের ভাবমূর্তির কারণে দ্বিধায় রয়েছেন বলেই মনে হয়। প্রশ্ন করলে এখন কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই 'এতদিন কোথায় ছিলেন' বলে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে এমন না, স্বয়ং উপদেষ্টাদের মুখ থেকেই সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে প্রশ্ন করলে শুনেছি 'আমিনুলের গ্রেপ্তার নিয়ে তো প্রশ্ন করেননি', আদালত চত্বরে হামলা নিয়ে প্রশ্ন করলে শুনেছি 'আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা নিয়ে তো প্রশ্ন করেননি'। কথাটা এমনও হতে পারতো, 'আগে আপনারা প্রশ্ন করেননি, এখন করুন, আমরা চলে গেলেও প্রশ্ন থামাবেন না।'
হতে পারে রক্তক্ষয়ী এই গণঅভ্যুত্থানের পর হয়তো সংবাদমাধ্যমও একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, দিকনির্ধারণ করছে। কিন্তু সেটা যেন আবার আগের মতোই এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে গিয়ে না পড়ে।
একটা সরকার পরিবর্তন হলে তার গা ঝাড়া দিয়ে কাজ শুরু করতে সময় লাগে। বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে সরকার এসেছে, তাদের হয়তো একটু বেশিই সময় লাগবে। কিন্তু অতীতটা মনে না রেখে গঠনমূলক সমালোচনার কঠোর অবস্থান ধরে না রাখলে সাংবাদিকতা আবার একই বৃত্তে ঘুরপাক খাবে।
বিটিভি যাতে রাষ্ট্রের কথা বলে, অন্য সব সংবাদমাধ্যম যাতে সত্যিকারের সাংবাদিকদের হাতে থাকে, জনগণ বা সরকারের তুষ্টি না করে সাংবাদিকতার নীতি মেনে পরিচালিত হয়, সেজন্য কমিশন গঠন করুন।
সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এই স্তম্ভ যদি রাষ্ট্রের নীচ থেকে সরে গিয়ে সরকারের ভারসাম্য রক্ষা শুরু করে, তাহলে সরকার কোনোমতে কিছুদিন টিকে গেলেও রাষ্ট্র খোঁড়া হতে বাধ্য। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, সরকার কেবলই সেই মালিকদের নির্বাচিত ম্যানেজার। ফলে সরকারের হাত শক্তিশালী না করে রাষ্ট্রের পা শক্তিশালী করাটা বেশি জরুরি।