1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্য

সংখ্যা ও প্রতিরোধে ডেঙ্গু

১২ মে ২০২৩

দেশে ডেঙ্গুর সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব ছিল ২০১৯ সালে৷ এটি সরকার অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ভর্তি রোগীর তথ্য দেয় সে হিসেবে৷ তাও আবার সেটি দেশের সব হাসপাতালের না৷

https://p.dw.com/p/4RFf7
Bangladesch | Dengue-Fieber
ফাইল ফটো৷ছবি: Mortuza Rashed/DW

তাদের হিসেবে ওই বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ১ লাখের কিছু বেশি (অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালকে এই তথ্যের আওতায় এখনও তারা আনতে পারেনি)৷ মারা যান ১৭৯ জন৷ এর বাইরেও তখন একটা বড় অংশ হাসপাতালের আউটডোর, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার এবং ঘরে বসে চিকিৎসা নিয়েছেন৷ সেসব তথ্য আজও রয়ে গেছে হিসেবের বাইরে৷

অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের ধারণা রাজধানীর ৬০ ভাগেরও বেশি মানুষ তখন আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ ২০১৯ এর পর গেল বছরও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ডেঙ্গু ভাইরাস৷ ভর্তি রোগীর হিসেবে যা দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব৷ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন৷ তবে মৃত্যু ছাড়িয়ে যায় ২০১৯ সালের হিসেবে৷ রেকর্ড ২৮১ জনের৷

এরপর বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে৷ যদিও সেগুলোর সুনির্দিষ্ট উত্তর আজও মেলেনি৷ ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে একটি ধরনে কেউ আক্রান্ত হয়ে গেলে তার আবার ওই ধরনটিতে আর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ কিন্তু অন্য ধরনে আক্রান্ত হতেই পারে৷ এবং তা যদি হয় অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেই বিপদ৷ ওই রোগীর শরীরে ইন্টারনাল ব্লিডিং মানে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মহাবিপদ সৃষ্টির সম্ভাবনাই বেশি থাকে৷

সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরও স্পষ্ট করেই বলেছিল গেল বছর দেশে চারটি ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় রোগটির তীব্রতা বেড়েছে৷

যেহেতু ঢাকা শহর ও আশপাশের বেশ কিছু শহরের বহু মানুষ এর আগে আক্রান্ত হয়েছিলেনএবং ২০২২ এ মৃত্যুও রেকর্ড ছাড়িয়েছে তাই একটু খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম গেল বছর যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে কি দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু সংক্রমিত হওয়ার রোগীও আছে কিনা৷ খোঁজ নিই ঢাকার সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে৷ যেগুলোতে ডেঙ্গু রোগিও ভর্তি হয় সবচেয়ে বেশি৷ মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এধরণের তথ্য রাখার বিষয়টি প্রয়োজনই মনে করছে না৷ কারণ তাদের দায়িত্ব কেবল চিকিৎসা দেয়া৷ পরিচালক জানালেন এসব নিয়ে ভাববে ইনস্টিটিউট (অথচ হাসপাতালটি একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজও বটে)৷ বোঝা গেল সমন্বয়ের অভাব কতটা!

জানতে চাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালকের কাছেও৷ তিনিও এবিষয়ে কিছুই জানেন না৷ এবার কাতর মনে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালকের অফিসে ছুটে গেলাম৷ ২০১৯ এর মতো ২০২২ সালেও সেখানে মিরপুর, আগারগাঁও, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের রোগীই ভর্তি বেশি ছিল৷ তিনি অবশ্য হতাশ করলেন না৷ শুধু তার হাসপাতালের আনুমানিক ধারণা দিলেন৷ দ্বিতীয় বার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঘটনা ঘটছে৷ যা হতে পারে ১০ থেকে ২০ ভাগ (এরবেশি বিস্তারিত তথ্য অবশ্য আর দিতে পারেননি)৷

খুঁতখুঁতে মন এবার দারস্থ সংক্রামক রোগ গবেষণায় দেশের সবচেয়ে বড় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের৷ তাদের এক কথায় উত্তর ‘‘না, কোনো ক্লিনিক্যাল ডাটা আমাদের হাতে নেই৷ লোক ধরে জিজ্ঞেস করতে হবে৷''

সত্যিই তো! কী অসাধ্য কথা বললাম! এই ৬২ হাজারের ওপরে ভর্তি হওয়া রোগী ধরে এনে জিজ্ঞেস করবে কোত্থেকে! নিজেই খানিকটা বিব্রত হলাম বটে! তবে মনে প্রশ্ন আরো বেড়ে গেলো-

• আচ্ছা যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে কি সেকেন্ডারি ইনফেকশন অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আক্রান্তের ইতিহাস ছিল?

• সেকেন্ডারি ইনফেকশনের রোগীকে সাধারণ ডেঙ্গু ভেবে আউটডোর থেকেই প্রেসক্রিপশন লিখে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে না তো? পরে আরো খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসছে কি? যাকে পরে আইসিইউতে নিতে হয়েছে!

•  একইভাবে কো-মরবিডিটির রোগীকেও প্রেসক্রিপশন দিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে না তো? সেও তো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রোগী! করোনার মতো তাকে তো কোন বার্তা দেয়া হলো না যে আপনার আগে থেকেই জটিল রোগ থাকায় আপনি বাড়ি যেতে পারবেন না৷ আপনার পরিস্থিতি যেকোনো সময় গুরুতর হতে পারে৷

এসব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি৷ তবে এ তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত জরুরি৷ কারণ যা জানা থাকলে রোগীকে শুরুতেই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিয়ে হয়তো দ্রুত সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো যেতো৷ হাসপাতালে দেরিতে আসার এমন তথ্য ছিল অনেক৷ ফলে গেল বছর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভর্তি রোগীদের নিদেন পক্ষে সুস্থ হতে গড়ে সময় লেগেছে সাত দিন৷ এই সাত দিনে একটা পরিবারের ওপর দিয়ে কী যায় তা শুধু ওই পরিবারই জানে৷ আর পরিবারের কর্মক্ষম মানুষ হলে কিংবা কোন খেটে খাওয়া দিন মজুর হলে তো কথাই নেই৷ ওই ক'দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকলে দৈনিক যে আর্থিক ক্ষতি তা পোষানোর নয়৷

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ডেঙ্গুর আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা করেন৷ তাদের গবেষণা মতে, প্রতিজন ডেঙ্গু রোগী তার চিকিৎসার জন্য গড়ে ৩৯ হাজার ৮৯৩ টাকা খরচ করেছেন৷ সরকারি হিসাব মতে ২০১৯ সালে  এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন৷ তাহলে তাদের মোট ব্যয় হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা৷

 

এবার চলুন একটু দৃষ্টি দেয়া যাক ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামলাতে কার উদ্যোগ কেমন৷ আমাদের দেশে মূলত এটি দু'ভাবে মোকাবেলা করা হয়৷ ১. প্রশাসনিক ২. চিকিৎসাসেবা৷

প্রশাসনিক


এই চ্যালেঞ্জটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের৷ যেখানে অন্তর্ভুক্ত থাকে সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরা৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এডিস মশার প্রজনন নিয়ে প্রাপ্ত জরিপের ফল ও সতর্কবার্তা আগেই জানিয়ে দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে৷ সে অনুযায়ী শুরু হয় তাদের তৎপরতা৷

প্রশাসনিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে মূলত লার্ভিসাইটিং (সকালে) ও ফগিং (বিকেলে) এদু'টো পদ্ধতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়৷ পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি অভিযানসহ চলে অল্প কিছু কার্যক্রম৷

তবে মশার লার্ভা ধ্বংসের জন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনে গাপ্পি মাছ ছাড়া ও ব্যাঙ চাষ বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিল৷ যদিও এসব আর ধোপে টেকেনি৷ উল্টো নষ্ট হয়েছে রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা৷ উত্তর সিটি কর্পোরেশন তো গেল বছর মশার লার্ভা মরতে ড্রোন পর্যন্ত ব্যবহার করেছিল৷ কিন্তু সেটিও খুব বেশিদিন চলমান রাখা হয়নি৷

মশা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগগুলো নগরবাসী করেন তা হলো:

  • মশক নিধন কর্মীরা বেশিরভাগ সময়ই ওষুধ ছিটিয়ে যান মূল সড়ক ধরে৷ তাদের বাড়ির ভেতরের দিকে আসতে বললে তারা শোনেন না পাত্তাও দেন না৷ তাদের ইচ্ছে মতো ছিটিয়ে চলে যান৷ আবার এই কার্যক্রম কখনও কখনও একদমই বন্ধ থাকে৷
  • স্কুল-কলেজগুলোতে তো একদমই নজর দেয়া হয় না৷ চিপসের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট, পানির বোতলের মুখ কিংবা মশা জন্মাতে পারে এমন অনেক কিছুই পড়ে থাকে আনাচে কানাচে৷ এসবেও নজর নেই স্কুল কর্তৃপক্ষের কিংবা মশক নিধন কর্মীদেরও৷

গেল কয়েকবছর ধরে নগরবাসীর করা এসব অভিযোগ শুধু অস্বীকারই করে গেছে সংশ্লিষ্ট মহল৷

গেল কয়েকবছর ধরে প্রশ্ন উঠেছে লার্ভিসাইটিং বা ফগিং যে ওষুধ দিয়ে করা হচ্ছে তা মশার ওপর রেজিসটেন্স হয়ে যায়নি তো? গতবছরই বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় ওঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশাও তার সক্ষমতা বাড়িয়েছে৷ তাই বাড়ছে ডেঙ্গু৷ এমনটা হলে ওষুধ নিয়ে ভাবতে হবে এখনই৷ এবিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য দিতে পারেনি কোনপক্ষ৷

আরেকটি প্রক্রিয়া নিয়ে গেল বছর পাঁচেক ধরে আলোচনা হচ্ছে খুব৷ জিএমও (জিনেটিকালি মোডিফাইড অর্গানিজম) পদ্ধতির মাধ্যমে অ্যালবাকিয়া ব্যাকটেরিয়াকে কাজে লাগানো৷ এটি এমন এক ধরণের পদ্ধতি যেটি পুরুষ এডিস মশার শরীরে বিশেষভাবে প্রবেশ করিয়ে পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হয়৷ ফলে এই মশা যখন স্ত্রী মশার সংস্পর্শে আসে তখন এডিসের জীবাণু আর সক্রিয় হতে পারে না৷ এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্যও ঠিক থাকে ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণে আসে৷ উন্নত বিশ্বে এই পদ্ধতি অনেক আগেই ব্যবহার হচ্ছে৷ নিজেদের এক্সপার্ট তৈরির আগে আপাতত অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে এই বিশেষ মশা আমদানি করা যেতে পারে৷ কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এটি পরামর্শ দিলেও এখনও তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি৷ খরচের দোহায় দিয়ে ঝুলে আছে সিদ্ধান্ত৷ যদিও মশক নিধন ওষুধ ছিটানোতেও খরচ কম হচ্ছে না৷ মৃত্যুর প্রশ্নে ব্যয় বেশির যুক্তি আমার কাছে মানানসই মনে হয়নি কখনই৷

পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার শুধু একটি উদ্যোগে নিয়েই এডিস নিয়ন্ত্রণে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ ২০১৮ সালে রেপিড রেন্সপন্স টিম তৈরি করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ সেই টিমের কাজ বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করা৷ কারণ ফুলের টব, এসি-ফ্রিজের জমানো পানি ফেলতে ভুলে যায় মানুষ৷ সব মানুষ একরকম সচেতন হবে না জেনেই তা ধ্বংসের দায়িত্ব নিয়েছিল ওই টিম৷ হাসপাতালে সেবা কিভাবে চলছে সেদিকেও কড়া নজর দারির নির্দেশনা ছিল জনপ্রতিনিধিদের৷ কাউন্সিলররা আক্রান্তদের বাড়ি গিয়েও খোঁজ নেন নিয়মিত৷ এসব উদ্যোগের ফলে পরামর্শ দিতে দিল্লী সরকারের আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি৷ মজার বিষয় হচ্ছে, সেই উদ্যোগের শুরুতে যারা ছিলেন ঘটা করে তাদের একবার আমন্ত্রণও জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার৷ এসব অভিজ্ঞতা শেয়ারও করেছিলেন তারা৷ কিন্তু তাতে স্থানীয় প্রশাসন কতটুকু গ্রহণ করলো তা বলাই বাহুল্য৷ এসব নিয়ে আলোচনা তুললেই সিটি কর্পোরেশন ও জনপ্রতিনিধিরা এক কথায় থামিয়ে দেন এই বলে যে, আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব কার্যক্রম কিভাবে চালাবো? প্রাইভেসি নষ্ট হবে, অনুমতি মিলবে না কিংবা এতো এতো বাসা-বাড়িতে যাওয়ার লোকবল পাবো কই?

অথচ নির্বাচনে ভোট চাওয়ার সময় এতোসব চিন্তা তারা করেন না৷ যখন তখন দলবল নিয়ে ভোট চাইতে ছুটে যান এবাড়ি ওবাড়ি৷ যেখানে এতো এতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে৷ মারা যাচ্ছে৷ সেখানে সেই জনগণের জীবন রক্ষায় তারা একইভাবে দুয়ারে কেন যেতে পারবেন না? বরং জনপ্রতিনিধি বাসায় গিয়ে মিষ্টি মুখ করে যদি এই কার্যক্রমটি চালাতে চান তাহলে ওই বাসার মানুষটি খুশি হবে বৈকি৷ তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এই তুষ্টিতে আরও সহযোগীতা করবে বলেই বিশ্বাস৷

এভাবে চিন্তা করা তো দূরের কথা আমাদের জনপ্রতিনিধিরা তো বলতেও পারেন না তার ওয়ার্ডে কতজন আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুই বা কত জনের হয়েছে৷

Bangladesch Journalist Mahmud Komol
মাহমুদ কমল, সাংবাদিক৷ছবি: private

উদ্যোগ আরো অনেকভাবেই নেয়া যেতে পারে৷ ডেঙ্গু মৌসুমে কাজে লাগানো যেত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও৷ শিক্ষকদের নেতৃত্বে চার-পাঁচ শিক্ষার্থী নিয়ে একটি টিম গঠন করে সপ্তাহে অন্তত একবার তারা সচেতন কার্যক্রম চালাতে বের হতে পারেন৷ বাড়িতে গিয়ে জাস্ট একটু তদারকি করা পানি কোথাও জমে আছে কিনা৷ নারী শিক্ষকদের ওই টিমের দায়িত্ব দিলে এই কাজটি আরো সুচারু রূপে চলবে৷ পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীও ব্যক্তি জীবণে শিখবে সাংগঠনিক অবকাঠামো, নেতৃত্ব ও সামাজিক সম্পর্কের শক্তি৷ আন্তরিক হলে এই কার্যক্রম চালানো কঠিন হবে বলে মনে হয় না৷

আমাদের নগরে সমাজের বিশিষ্টজনদেরও কাজে লাগানো হয় না৷ হলে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যেত ধর্মীয় নেতাদেরও৷ মসজিদের ইমাম সাহেবদের কথাই ধরুন৷ তারা কি খুতবায় কিংবা কোন বক্তব্যে ডেঙ্গু নিয়ে আলোচনা করেন? আমি অন্তত শুনিনি কখনও৷ তাদের দিয়ে জুমার দিন বক্তব্যেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা চালানো যেতেই পারে৷ চাইলেই এমনটা পারা যায়৷ 

এ বিষয়ে একটি পদক্ষেপের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে৷ ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল হক গতবছরের শেষ দিকে সকাল সকাল নাগরিকদের বাড়িতে চলে যেতেন৷ মশার প্রজননস্থলগুলো তদারকি করতেন৷ সচেতন হতে বলতেন৷ এটি নি:সন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ৷ প্রতিবছরই জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এটি চলমান রাখলে হয়তো ডেঙ্গু পরিস্থিতি পাল্টে যেতেও পারে৷

তবে একজন নাগরিক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে ২০১৮ সালে চালু করে ওই বছরই ডিএনসিসির একটি হটলাইন নাম্বার বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে৷ শুধু মশা নিধনে যেটি খোলা হয়েছিল৷ যা নাগরিকদের আস্থার জায়গা তৈরি হতে পারতো৷ বলা হয়েছিল ০১৯৩২৬২৫৫৪৪ এই নাম্বারে কল করলেই নেয়া হবে মশা নিধনের ব্যবস্থা৷ ওই বছর ২৮শে ফেব্রুয়ারির থেকে ৬ই জুন পর্যন্ত জমা পড়া ৮৭৪টি অভিযোগের ৯০ শতাংশই সমাধান করেছিল ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ৷ আর এখন তো নগরবাসী জানেনই না এসংক্রান্ত অভিযোগ বা সহযোগিতা চাইলে কার কাছে করলে মিলবে প্রতিকার! ডিএনসিসি একটা অ্যাপ চালু করলেও সবশ্রেণির মানুষ তা ব্যবহার করতে পারবেন না এটিই স্বাভাবিক৷ তার চেয়ে তুলনামূলক সহজ এটি হটলাইন নাম্বার৷ যেখানে একটি কলেই মিলবে সমাধান৷

চিকিৎসাসেবা

এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগে ভয় এবং শঙ্কা দুটোই কাজ করে৷ পাছে না চিকিৎসকদের চক্ষুশূল হতে হয়৷ তাই বেসিক কিছু বিষয় তুলে ধরাই ভালো৷

  • হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে গেলেই চোখে পড়ে কোন বেডে মশারি টানানো আবার কোন বেডে তা নেই৷ চাপ যখন খুব বেশি হয় তখন রোগী থাকে বারান্দাতেও৷ যখনই প্রতিবেদন কাভার করতে কোন সাংবাদিক হাসপাতালে ঢোকেন তখনই মশারি টানানোর তোড়জোড় শুরু হয়৷ বিশেষ করে ওয়ার্ডবয়রা তখন বিশাল দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন৷ কখনও কখনও তো সাংবাদিকদের ১০/১৫ মিনিট বসিয়ে রেখে ওয়ার্ডে যাওয়ার অনুমতি দেন হাসপাতালের পরিচালকরা৷ ততক্ষণে মশারি টানিয়ে ফিটফাট রাখা হয় পরিবেশ৷ সাংবাদিক চলে গেলেই আবার যেই সেই৷ গরমের দোহাই দিয়ে রোগীর স্বজনরা মশারি না টানালেও হাসপাতালে এসে আক্রান্তের ইতিহাস কম নয়৷ ডেঙ্গু ওয়ার্ডে মশারি ছাড়া রোগী থাকলে পাশেই থাকা অন্য ওয়ার্ডের রোগীরাও যে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কিন্তু অজানা নয়৷ তবুও চলে এই চোর-পুলিশ খেলা৷
  • হাসপাতালে ভর্তির হওয়া ডেঙ্গু রোগীর একটা অংশকে দেখা যায় পরিস্থিতি খারাপের একদম শেষ দিকে আসছেন৷ খোঁজ নিলেই দেখা যায় জ্বরের প্রাথমিক অবস্থায় তারা বাড়ির পাশের গলির ফার্মেসিতে গিয়েছিলেন এবং সেই দোকানি তাকে ৭ দিনের অ্যান্টিবায়োটিকের একটা কোর্স দিয়েছেন৷ চিকিৎসকেরা স্পষ্ট করেই বলেন ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে ইন্টারনাল ব্লিডিং এবং প্লাজমা লিকেজ হয়ে রোগী দ্রুত শকে চলে যাবে৷ স্বাভাবিকভাবেই দুইয়েকদিন ওই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে রোগির পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায় এবং পরবর্তীতে সুস্থ হতেও সময় লাগে৷ এই দুই লাখ ফার্মেসিকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ সরকার আইন করেও নিতে পারেনি৷ এসব ক্ষেত্রে সরাসরি তারা মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেই চলেছে৷ নিউজ প্রতিবেদনেই এসব নিয়ে আলোচনা হয় বেশি৷ অথচ এলাকায় মাইকিং করেও নগরবাসীকে এব্যাপারে সতর্ক করা যেতো৷
  • প্লাটিলেটের অপব্যবহার৷ এটি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে৷ বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালে দেখা যায় ৫০ হাজারের নিচে নামলেই প্লাটিলেট দেয়ার জন্য স্বজনদের বলা হচ্ছে৷ অথচ ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় গাইড লাইনে বলা আছে  প্লাটিলেট ১০ হাজারে নামলেই তা প্রয়োগ করতে হবে৷ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বারবারই সতর্ক করে বলছেন ডেঙ্গু চিকিৎসায় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট সবচেয়ে বড় বিষয়৷ এটি জেনেও বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞ চিকিৎসকরা গাইডলাইনের বাইরে গিয়ে প্রেসক্রাইব করেন৷ এক ইউনিট (২০০ মিলিলিটার) প্লাটিলেট পেতে জোগার করতে হয় চারজন ডোনার৷ ফলে ডেঙ্গু মৌসুমে অন্য সময়ের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যায় অন্তত তিনগুণ৷ তৈরি হয় হাহাকার৷ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্লাড ব্যাংক কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের গেল বছরের তথ্য বলছে ১০ হাজারের নামার আগে তাদের কাছে এর চাহিদা এসেছে অন্তত ১০ ভাগ৷ এসব নজরদারি করার কথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার৷ কিন্তু জনবলের অভাবের কথা শুনিয়ে বারবারই এড়িয়ে যাচ্ছে তারা৷ চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএমডিসি তো রীতিমতো চোখে টিনের চশমা পরে বসে থাকে৷ এদিকে নজর দেয়ার দায়িত্ব বোধই কখনও দেখা যায়নি তাদের৷ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো দূর কি বাত! অথচ এটা এক ধরনের অপরাধ৷ প্লাটিলেট সংগ্রহকে কেন্দ্র করে হাসপাতাল কিংবা ব্লাড ব্যাংকের ব্যবসাও কিন্তু কম হয় না৷ এসব বিষয় সামনে আসলেই মনে হয় আর কতদিন চলবে এই চোর-পুলিশ খেলা৷

ডেঙ্গু নিয়ে সামনে আরেকটা বড় দূর্যোগ অপেক্ষা করছে৷ যার আভাস মিলেছে গেল বছর৷ আগে এই রোগটিকে শহুরে রোগ বলা হলেও ২০২২ সালের পরিসংখ্যান বলছে রোগী বাড়ছে রাজধানী ঢাকার বাইরেও৷ শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও৷ গেল বছর মোট ৬২৩৮২ ভর্তি রোগীর মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগী ছিল ২৩১৬২ জন৷ এর বাইরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিতে যা ছিল ১৫৩৫২ জন৷ এবছরও ঢাকা শহর ও ঢাকার বাইরে ভর্তি রোগির সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি৷

পরিশেষে বলতে হয়, নগরায়ণ হচ্ছে৷ সরকারের উন্নয়ণের ধারায় গ্রাম হয়ে যাচ্ছে শহর৷ উন্নত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা৷ এটি নিঃসন্দেহে খুশির খবর৷ তবে সেই খুশির খবরে এডিস যেন তার বিস্তৃতি বাড়াতে না পারে সেদিকেও প্রশাসনের নজর রাখতে হবে৷ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আভাস দিয়ে রেখেছেন শহর থেকে গাড়িতে করেও এডিস মশা চলে যেতে পারে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়৷ জেলাগুলোতে মশা নিধন অবস্থা কেমন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এব্যাপারে জেলাগুলোতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া আছে দাবি করলেও জনপ্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করলেই অবাক হন৷ বরাদ্দ তাহলে কোথায় উল্টো সে প্রশ্ন করেন মন্ত্রণালয়কে৷ জেলা প্রশাসকও কিছু গতবাধা দেখভালের বুলি আওড়ান৷ কিন্তু গতবছর থেকে কীটতত্ত্ববিদেরা স্পষ্ট করেই বলছেন, আর পুরোনো ব্যবস্থা নয়৷ প্রয়োজনে আলাদা দপ্তর খুলে ঠেলে সাজাতে হবে সব৷ না হলে হয়তো আরও দেরি হবে৷ মুখে বড় বড় বানী ছেড়ে সে ক্ষতি পোষানো যাবে না কোনভাবেই৷ কারণ যিনি স্বজন হারানোর ব্যাথাটা তিনি ছাড়া আর কেউ বোঝে না৷ সে উপলব্ধীটা নীতিনির্ধারকদেরও হতে হবে৷ কারণ শুধু জীবিত প্রাণই নয়, দেশ হারাচ্ছে একটা কর্মক্ষম মানুষও৷ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণে অবদান আছে সে তারও৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য