1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শেখ হাসিনার আমলে বছরে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১ ডিসেম্বর ২০২৪

গত আগস্টে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে৷ রোববার অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে৷

https://p.dw.com/p/4ncY2
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্বেতপত্র কমিটি ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছে যে প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে৷ ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭,৮০,০০০ কোটি টাকা৷
গত আগস্টে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা (ফাইল ফটো)ছবি: Peerapon Boonyakiat/SOPA Images/IMAGO

এদিকে, যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছেন একদল অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷ ওই দেশটির আবাসন খাতে তাদের বিনিয়োগ করা সম্পত্তির পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ড বা ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে৷

৪০ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তি

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অবজারভার ও বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের ৪০ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান৷ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ৷

লন্ডনের মেফেয়ার, গ্রোসভেনর স্কয়ারের মতো আভিজাত্যপূর্ণ এলাকায় অন্তত সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিক শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের পরিবার৷

সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান ২০২২ সালের মার্চে এই এলাকায় দুই কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেন৷ এখানে তার একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে যার দাম তিন কোটি ৫৫ লাখ পাউন্ড৷ জানা যায়, লন্ডনে শায়ানের এই বাড়িতেই বিনা ভাড়ায় থাকতেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা৷ 

‘এখন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে’

সালমানের পরিবারের আরেক সদস্য আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের চারটি সম্পত্তি রয়েছে গ্রোসভেনর স্কয়ারে, যার দাম দুই কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড৷

সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান৷ তিনি বর্তমানে বাংলাদেশে কারাবন্দি অবস্থায় রয়েছেন৷ তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)৷ এছাড়া সালমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)৷

প্রতিবেদনে শুধু সালমান এফ রহমান নয়, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়াররম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের এমন অনেক সম্পত্তির তথ্য চিত্র উঠে আসে৷

অনুসন্ধানে যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নামে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে৷ এর মধ্যে ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সুবিশাল অট্টালিকা পর্যন্ত আছে৷ 

যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের তিনশরও বেশি সম্পদ আছে যার দাম কমপক্ষে ১৬ কোটি পাউন্ড৷

বাংলাদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে বিএফআইইউ৷ তার ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার৷ তবে ধারণা করা হচ্ছে এরইমধ্যে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ এ ছাড়া অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)৷

যুক্তরাজ্যে আকবর সোবহানের পরিবারের সাত সদস্যদের অন্তত এক কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের দুটি সম্পত্তি রয়েছে৷ তাদেরও ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷

নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার পরিবারের লন্ডনের কেনসিংটনে অন্তত পাঁচটি বিলাসবহুল বাড়ি আছে যার দাম তিন কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড৷ এসব সম্পত্তির বেশিরভাগ ভাড়া দেয়া৷

নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে সিআইডি৷ তার সম্পত্তিও জব্দ করা হয়েছে৷

এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডসের মতো অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে বলেও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷

অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন

রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তার তেজগাঁও কার্যালয়ে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন৷ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস বিভাগ জানিয়েছে, প্রতিবেদনে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলের গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে৷ অর্থ পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে বিচারকাজ শুরুর পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্বেতপত্র কমিটি ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছে যে প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে৷ ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭,৮০,০০০ কোটি টাকা৷

পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১,১৪,০০০ কোটি টাকা৷ অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে ১,৯৫,০০০ কোটি টাকা করা হয়৷ ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷

গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সাত লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷

বিগত শাসনামলে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ৷ এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত বলে জানান তিনি৷

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে, এবং ১০ শতাংশ যদি অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এই প্রতিবেদনটি শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হবে৷

সরকারের উদ্যোগ

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে৷ এই টাস্কফোর্সের উদ্দেশ্য হলো:

  • বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিতকরণ ও তদন্তে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সহযোগিতা করা
  • পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে দায়ের করা মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও তা দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়া
  • বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া
  • জব্দ বা উদ্ধার হওয়া সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া
  • এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশি, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য আহরণ করা
  • পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্ষমতা বাড়ানো ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই টাস্কফোর্সের সদস্য৷ দুদক বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত ১২টি দেশে ৭১টি চিঠি ও মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে৷ এরমধ্যে ২৭টি এমএলএআরের জবাব পেয়েছে সংস্থাটি৷ দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ডয়চে ভেলেকে এই তথ্য জানিয়েছেন৷ 

‘কাজের গতি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে’

দুদক মহাপরিচালক বলেন, ‘‘মানি লন্ডারিং, পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফেরত পেতে পারি তা নিয়ে আমরা অর্থ পাচার হওয়া দেশগুলোর নাম তাদের কাছে তুলে ধরেছি৷ বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে মানি লন্ডারিং বেশি হয়৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমরা এমএলএআর ছাড়াও পাচার বিরোধী এগমন্ডগ্রুপের সদস্য হিসেবে তাদের মাধ্যমেও কাজ করছি৷ আরো কিছু ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ আছে তাদের সঙ্গেও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কাজ করছি৷ আমরা যেসব দেশকে চিঠি দিয়েছি তাদের জবাবের ওপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেব৷ পাচারের অর্থ ফেরত আনতে আমাদের বেশ কয়েকটি বিভাগ কাজ করছে৷ কাজের গতি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে৷''

দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পর নতুন চেয়ারম্যান এখানো নিয়োগ দেয়া হয়নি৷ কমিশনও পুনর্গঠন হয়নি বলে জানান তিনি৷ সেটা হলে তাদের কাজের গতি আরো বাড়বে বলেন জানান হোসেন৷

আর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে যা ইতিবাচক৷ এর মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী টাঙ্কফোর্স গঠন অন্যতম৷ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এখন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের এখন সহযোগিতা করতে প্রস্তুত৷ আমাদের এই সুযোগ নিতে হবে৷ আর এজন্য আমাদের নিজস্ব আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপারে নজর দিতে হবে৷''

‘‘আর এখনো অর্থ পাচার হচ্ছে৷ অর্থ পাচার যে বন্ধ হয়েছে সেটা ভাবার কোনো কারণ নাই৷ তাই পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের পাশাপাশি অর্থ পাচার রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তার জন্য যার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের কাজ করতে হবে,'' বলেন তিনি৷

তার কথা, ‘‘যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারের মাধ্যমে যে সম্পদের কথা আমরা এখন জানতে পারছি তা পাচার হওয়া অর্থের সামান্যই৷ পাচার করা অর্থে যুক্তরাজ্যে যারা বাড়ি করেছেন বা সম্পদ কিনেছেন তারা কীভাবে এটা করলেন? সেখানে তো আইনে এর সুযোগ নাই৷ তাহলে পাচারকারীরা কোনো কৌশলে পাচার হওয়া অর্থ বৈধ হিসাবে দেখিয়েছেন৷ বাংলাদেশ সরকারের সেই আইন বা প্রক্রিয়াগুলো বুঝতে হবে৷ এজন্য দক্ষ আইন উপদেষ্টা ও সলিসিটারদের কাজে লাগাতে হবে৷ আইনজীবী প্যানেল তৈরি করতে হবে যারা এ নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপারে দক্ষ৷''

‘‘সঠিক উদ্যোগ নিলে পাচার বন্ধ এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়৷ তবে সময় সাপেক্ষ,'' বলেন তিনি৷