শিশু নিগ্রহের দায় কার?
৪ ডিসেম্বর ২০১৭দুই শিক্ষক, দু'জনেই পুরুষ৷ কলকাতার একটি নামি মেয়েদের স্কুলে শারীরিকশিক্ষার শিক্ষক হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে কর্মরত৷ স্কুলের এক ছাত্রী, যার বয়স মাত্র চার বছর, নেহাতই শিশু, সে একদিন স্কুলের পোশাকে রক্ত নিয়ে বাড়ি ফেরে৷ বাচ্চাটির মা দেখেন, মেয়ের দুই পায়ের ফাঁক দিয়েও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷ আরেকটু খতিয়ে দেখে বোঝা যায়, শিশুটির রেচনাঙ্গ, যা এখনও যৌনাঙ্গ হিসেবে অভিহিত হওয়ারও সময় আসেনি, তা ক্ষতবিক্ষত৷ শিশুটিকে প্রশ্ন করে জানা যায়, স্কুলেরই দুই শিক্ষক তাকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই তার সঙ্গে এমন করছে৷ কী করছে, সেটা বোঝার বয়স তার হয়নি, কিন্তু তাতে যে তার খুব কষ্ট হয়েছে, তা সে মাকে বলে৷ এরপর বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছালে, ছবি দেখে ওই দুই শিক্ষককে চিহ্নিতও করে দেয় ওই শিশু৷
এমন উদ্বেগজনক ঘটনার পরও স্কুলের অধ্যক্ষার নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া ক্ষুব্ধ করে ওই শিশুটির বাবা-মা এবং স্কুলের বাকি ছাত্রীদের অভিভাবকদেরও৷ কারণ অধ্যক্ষা এবং সহ-শিক্ষিকাদের কথায় এবং হাবেভাবে স্পষ্ট হচ্ছিল, এটাকে তাঁরা নিছকই ছোট ঘটনা, সুতরাং বেশি শোরগোল না করে ভুলে যাওয়াই ভালো — এমন একটা মানসিকতা নিয়েই দেখছেন৷ ফলে অভিভাবকদের বিক্ষোভ শুরু হয়, সক্রিয় হয় সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়, সচকিত হয় প্রশাসন এবং শেষ পর্যন্ত ওই দুই অভিযুক্ত শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়৷ কিন্তু তার পরেও সামাজিক পর্যায়ে মানুষের ক্ষোভ কমছে না, বিশেষত স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে৷ কেন তারা একটি শিশুর যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়ায়৷ সেই সূত্রে উঠে আসতে থাকে শহরের আরও কয়েকটি বড় স্কুলে একই ধরনের যৌন হেনস্থার ঘটনা৷ যেসব ঘটনা এতদিন হয়ত স্কুল কর্তৃপক্ষের চাপে, বা হয়ত লোকলজ্জার ভয়ে সামনে আসেনি৷
স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কি এমন কোনো চাপ থাকে, থাকে কি কোনো অলিখিত নির্দেশ এ ধরনের নিন্দনীয় ঘটনাকে লঘু করে দেখানোর, চেপে যাওয়ার? কলকাতার একটি মন্টেসরি স্কুলের শিক্ষিকা সুপর্ণা মিত্র ডয়চে ভেলেকে খোলাখুলি জানালেন, ‘‘হ্যাঁ, থাকে৷'' কিন্তু তার পরেই যেটা থাকে, বা থাকা উচিত, সেটা হলো শিক্ষক শিক্ষিকাদের মানবিক দায়িত্ব৷ যে শিশুটি নির্যাতিত হলো, তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ও রকম আরও অনেক শিশুর কথা ভেবে সরব হওয়া৷ কিন্তু এই প্রসঙ্গে সুপর্ণার প্রশ্ন, খালি শিক্ষকদেরই দায় থাকবে কেন? বাকি সমাজের কি কোনো দায় নেই? এবারেই যেমন অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষ সমর্থনে আদালতে দাঁড়াবেন আইনজীবী৷ হতে পারে সেটা তাঁদের পেশাগত দায়, কিন্তু ঠিক কী বলে ওই দুই শিক্ষকের কাজকে বৈধ প্রমাণ করবেন তাঁরা? নাকি প্রমাণ করার চেষ্টা হবে, ওই শিশুটি মিথ্যে বলেছে? বস্তুত অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের একজন ইতোমধ্যেই দাবি করেছেন, যে তিনি নির্দোষ! সেটা অচিরেই প্রমাণ হয়ে যাবে৷
ঘটনাটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া যখন তোলপাড়, তখন ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের এক প্রাক্তনী, গবেষক স্রোতা দত্ত৷ দুই অভিযুক্তের একজন পাঠভবনেই পড়েছেন৷ তাঁর বাবা ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক৷ স্রোতা তাঁর পোস্টে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, পাঠভবনের একজন প্রাক্তন ছাত্র কীভাবে এমন জঘন্য একটা কাজ করতে পারেন৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে স্রোতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, পাঠভবনের শিক্ষা কী এমন জীবনবোধ তৈরি করে দেয়, যার জন্য তিনি এত অবাক হচ্ছেন৷ স্রোতা জানালেন, পাঠক্রমের বাইরেও নানাভাবে জীবনের পাঠ নেওয়ার সুযোগ আছে শান্তিনিকেতনে৷ আছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে প্রায় পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ, যা স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়েও সঙ্গে থাকে৷ যে কোনো অভিজ্ঞতা, বয়ঃসন্ধির অস্থিরতা, হতাশাও তাঁরা স্বচ্ছন্দে ভাগ করে নিতে পারেন, এখনও৷ সেখানেই তাঁর অবাক লাগছে যে, কী করে পাঠভবনের এক প্রাক্তনী এমন একটা অপরাধে প্রবৃত্ত হলেন৷
এ বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷