1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিল্পী সমাজের মাঝে রাজনীতির ‘দেয়াল’

জনি হক ঢাকা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক পালাবদলের পটভূমিতে বাংলাদেশের বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীদের মাঝে বিভাজন দেখা দিয়েছে৷ দলাদলির মারপ্যাঁচে তাদের অনেকে জনরোষে পড়েছেন৷

https://p.dw.com/p/4lE2B
সংস্কৃতিকর্মীরা দলনিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রাখবেন বলে আশা করেন অনেকেই৷ ফাইল ফটোছবি: DW/M. Rahman

অথচ বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীরা অনেক ক্ষেত্রে চাইলেও রাজনীতির বাইরে থাকতে পারেন না৷ যদিও সংস্কৃতিকর্মীরা দলনিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রাখবেন বলে আশা করেন অনেকেই৷ কারণ, প্রত্যেক শিল্পীর কিছু দায়বদ্ধতা থাকে৷

শিল্পীদের দায়বদ্ধতার উদাহরণ দিতে গিয়ে আশির দশকের একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা৷ বছর দেড়েক আগে নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল-মামুনের জন্মজয়ন্তীতে স্মারক-বক্তৃতায় বিটিভির ‘সংশপ্তক' ধারাবাহিক নাটকের শুটিংয়ের স্মৃতিচারণ করেন তিনি৷ তখন এরশাদ সরকারের আমল৷ বিটিভির স্টুডিওতে তখন দুই দিন ‘বহুব্রীহি'র ও দুই দিন ‘সংশপ্তক'-এর রেকর্ডিং হতো৷ সুবর্ণা ‘সংশপ্তক’-এর শুটিংয়ের দিন জানতে পারলেন আগের দিন ‘বহুব্রীহি'র শুটিং হয়নি, কারণ, আসাদুজ্জামান নূর ও লাকী ইনামকে বিটিভির স্টুডিওতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ এ ঘটনা শুনে সুবর্ণাসহ ‘সংশপ্তক' নাটকের কুশলীবরা যে যার মতো বাড়ি চলে যান৷ সেদিন সন্ধ্যায় সুবর্ণাকে ফোন করেন বিটিভিতে সেই সময় পরিচালক পদে কর্মরত নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাবলে জানতে চাইছি, তোমরা কি আজ রেকর্ডিং করবে, নাকি করবে না?'' তাকে সুবর্ণা বলে দেন, ‘‘শুটিং করবো না, মামুন ভাই৷'' এরপর আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাবলের প্রশ্ন শেষ৷ এবার একটা কথা বলি৷ তোমাদের আজকের পদক্ষেপ আমার মাথা অনেক উঁচু করে দিয়েছে৷ তোমাদের সবাইকে এই মুহূর্তে অনেক শ্রদ্ধা করছি৷ তোমরাই পেরেছো এভাবে প্রতিবাদ করতে৷’’

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বিটিভিতে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ৷ সেই অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেউ যদি বিএনপি, কিংবা আওয়ামী লীগ করে, আমি কিন্তু অপরাধ মনে করি না৷ রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে৷ কিন্তু এজন্য প্রতিশোধ নেওয়ার যে প্রবণতা, এটা খুবই দুঃখজনক৷ এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বহুবার আমি নিজেও এর শিকার হয়েছি৷ প্রত্যেকের আলাদা রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, এটা অন্যায় কিছু না৷ রাজনৈতিক দলগুলোরও সেটা মাথায় রাখা উচিত৷’’

আসাদুজ্জামান নূর, লাকী ইনাম ও মামুনুর রশীদের মতো রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্যকে কেন্দ্র করে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন অনেকে৷ বিশেষ করে কয়েকজন সংগীতশিল্পী বিএনপি সমর্থন করায় আওয়ামী সরকারের আমলে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বিভিন্নভাবে৷এর উদাহরণ বেবী নাজনীন, আসিফ আকবর, নাজমুন মুনিরা ন্যানসি প্রমুখ৷

গায়ক আসিফ আকবর বিএনপির একনিষ্ঠ সমর্থক৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, বিটিভি ও বেতারে ১৬ বছর তার গান গাওয়া হয়নি৷ ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে দেড় দশকের বেশি সময় আওয়ামী সরকারের রোষানলে ছিলেন তিনি৷ সরকার পতনের পর রাষ্ট্রীয় টিভি-রেডিও থেকে গাওয়ার প্রস্তাব পেলেও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন৷

শিল্পীরা মনের ভেতর প্রতিহিংসা রাখলে সৃষ্টিশীল কাজ কীভাবে হবে: মামুনুর রশীদ

রাজনীতির কারণে শিল্পীদের আলাদা করা উচিত নয় বলে মনে করেন আসিফ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যদি চোখের বদলে চোখ তুলে ফেলি, তাহলে তো জাতি অন্ধ হয়ে যাবে৷ শিল্পীরা জাতির একটি মেরুদণ্ড৷ তাদের দিয়েই বিশ্ব আমাদের চেনে৷ সুতরাং, আমরা যদি দলীয়করণের মাধ্যমে তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে দেই, তাহলে তো হবে না৷ তিমির নন্দী আওয়ামী লীগ করেন না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, তাকে কি ফেলে দিতে পারবো আমরা? নজরুলসংগীত শিল্পী শাহীন সামাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী৷ তাকে কি ফেলে দেবো আমরা? এটা তো হয় না৷ সবসময় সুজিত মোস্তফার মতো শিল্পী জন্ম নেয় না৷ প্রতিভাবান শিল্পীদের জন্য যে-কোনো সরকারের আমলে কাজ করার পরিবেশ রাখতে হবে৷ কারণ, কণ্ঠশিল্পী কিংবা কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিভা কিন্তু প্রতিদিন ঘরে ঘরে জন্ম নেয় না৷ তারা খুব বিরল৷’’

গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে হামলার শিকার হন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী৷ এর আগে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর শিকার হন চিত্রনায়ক শান্ত খান ও তার বাবা চলচ্চিত্র প্রযোজক সেলিম খান৷ চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সেলিম খান৷ গত ৫ আগস্ট ‘গণপিটুনি'তে মারা যান বাবা সেলিম খান ও তার ছেলে শান্ত খান৷ সেলিম খান ও শামীম আহমেদ রনির পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন অবলম্বনে ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই' সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শান্ত খান৷ ২০২১ সালে মুক্তি পায় ছবিটি৷ শান্ত খান অভীনিত আরো তিনটি ছবির নাম প্রেমচোর, বিক্ষোভ এবং প্রিয়া৷

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার' চলচ্চিত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করা আরিফিন শুভকে সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দ দেওয়া রাজউকের প্লট ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে৷ এ বিষয়ে উপস্থাপক ও নির্মাতা আব্দুন নূর তুষার বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে শুভকে সরাসরি চূড়ান্ত করেন পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ও চিত্রনাট্যকার শামা জায়েদি৷ এক্ষেত্রে কোনো দলের প্রভাব ছিল না৷ শুভর প্লট বরাদ্দ বাতিল করা অযৌক্তিক৷ তার অভিনয়-মডেলিং ক্যারিয়ার ২৪ বছরের৷ সে কখনো রাজনীতিতে ছিল না৷ আরিফিন শুভর সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে৷’’

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে নুসরাত ইমরোজ তিশা, সাবিলা নূর ও নুসরাত ফারিয়া ছিলেন যথাক্রমে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা চরিত্রে৷ আব্দুন নূর তুষারের প্রশ্ন, ‘‘এখন কি তারাও সাজা পাবেন? শিল্পীর কাজ অভিনয় করা৷ এজন্য তাকে শাস্তি দেওয়া সঠিক না৷ তাহলে কি কল-রেডি মাইক ব্যবসা বন্ধ করা হবে? ছবি চালিয়েছে বলে মাল্টিপ্লেক্স বন্ধ হয়ে যাবে?’’

বায়োপিকে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান চরিত্রে অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী৷ সেই সূত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি৷ তাকে গান গেয়েও শুনিয়েছেন৷ সেসব ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকের রোষানলে পড়তে হয়েছে চঞ্চলকে৷ এসব বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া নিতে ডয়চে ভেলে থেকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘কথা না বলি, কথা না বলি৷ পরে কথা হবে৷ কাজে ব্যস্ত আছি৷ ভালো থাকবেন৷’’

আক্রমণাত্মক এবং আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে ফেসবুকের কমেন্ট করার অপশন ‘লিমিটেড' করে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন চঞ্চল৷

গ্রাফিতি দিয়ে সমাজ বদলের লড়াই

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিটিভি পরিদর্শন করা,  হোয়াটসঅ্যাপে ‘আলো আসবেই' গ্রুপের স্ক্রিনশট ফাঁস হওয়া এবং গণবিক্ষোভকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ছোট পর্দার কুশলীবদের সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘের অবস্থান নেওয়ার কারণে শিল্পীদের একাংশ এখন বৈরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন৷ ছাত্র-জনতার প্রাণহানির ঘটনায় নীরব থাকায় গালমন্দ খেয়েছেন তারা৷ অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিও উঠেছে৷

চলমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, রাজনীতির ডামাডোল থেকে শিল্পীদের দূরে থাকাই কি ভালো? আসিফ কিন্তু এমনটা মনে করেন না, ‘‘শিল্পীরা অবশ্যই রাজনীতি করবেন৷ রাজনীতির বাইরে তো পৃথিবীর একটা পাতাও নড়ে না৷ রাজনীতির মধ্যে আকাশ-পাতাল, পানিসহ সবকিছুই সম্পৃক্ত৷’’

একই সুরে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে-কোনো দলকে সমর্থন করা দেশের নাগরিক হিসেবে আমার মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে৷ সাধারণ মানুষের মতোই শিল্পীদেরও সর্বদা রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে থাকতে হয়৷ আমরা প্রত্যেকে রাজনীতির অংশ৷ যদি কেউ কোনো ধরনের অপরাধ করে থাকে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু তাকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়৷ আমাদের এমন মানসিকতা থেকে বের হওয়া খুব জরুরি৷ প্রকৃত শিল্পীর ভাবনার জায়গা থেকে পুরোপুরি মুক্ত পরিবেশ দরকার, যাতে তিনি ভালোভাবে কাজ করে যেতে পারেন৷’’

রাজনীতির উত্তাপে শিল্পীদের বিভক্তিকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে৷ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিল্পীসমাজে ‍দূরত্ব এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আগের মতো মিলেমিশে কাজ করার পরিবেশ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারেও সংশয় জাগছে৷

এ প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে একজন তরুণ অভিনেতার কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছি৷ সে নাকি তালিকা করে রেখেছে কার কার সঙ্গে কাজ করবে না৷ এভাবে তো অন্যের অধিকার হরণ করা হবে৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন শিল্পীকে পছন্দ না করতে পারি, কিন্তু আমাকে কোনো নাটকে নিলে তাকেও যদি নেওয়া হয় আমি বাধা দেই না৷ আমি কিন্তু কোনোদিন বলিনি, অমুকের সঙ্গে কাজ করবো না৷ বরং যারা এসব বলতো তাদের রাজি করাতে বোঝাতাম, কেন কাজ করবে না? সব মিলিয়ে এখন যা হচ্ছে খুব দুঃখজনক৷ আমি মনে করি, শিল্পীদের বিভাজন খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাওয়া উচিত, তা না হলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে৷ শিল্পীদের যার যার রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকতে পারে, তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে অন্য শিল্পীদের কথা বলা ঠিক নয়৷ শিল্পীদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত আচরণে কেন সেটা প্রকাশ পাবে?’’

রাজনৈতিক মতভেদের কারণে অমুসলিম শিল্পী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও কটূক্তি শুনতে হয়েছে৷ প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী তেমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন৷ তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের একজন নেত্রী৷ ফাল্গুনী নন্দী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘আমাদের কথায় কথায় ‘আওয়ামী সরকারের এজেন্ট' বলা হয়, ‘ভারতের দালাল' বলা হয়৷ আমাকে দেশ ছাড়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়৷ কেন? ভারতে যাওয়ার জন্য এ দেশে জন্মগ্রহণ করি নাই৷ আমরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই, যেন সবাই একসঙ্গে থাকতে পারি৷’’

অমুসলিম শিল্পীদের মধ্যে অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি শিল্পকলা একাডেমির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে পরিচালক হিসেবে থাকায় কর্মস্থলে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু সহকর্মীদের রোষানলে পড়েন তিনি৷ এক পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে৷ এরপর ফেসবুক লাইভে এসে কাঁদতে কাঁদতে জ্যোতি বলেন, ‘‘অভিনয়ে তিল তিল করে নিজেকে গড়েছি৷ পড়াশোনাও করেছি৷ চাইলেই তো আমি উন্নত দেশে স্থায়ী হতে পারতাম৷ হইনি৷ এখন চাকরিও হারালাম৷ অভিনয় শিল্পীদের মধ্যেও দেখছি বিভাজন৷ ফলে অভিনয়ও আর করতে পারবো না৷ তাহলে কি এই দেশে কেউ দল সমর্থন করবে না? কেউ হিন্দু হতে পারবে না? তাহলে কি এই দেশ আমার নয়?’’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে  চালু করা ‘আলো আসবেই' হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আদান-প্রদান করা কিছু চ্যাটের স্ক্রিনশট গত ৩ সেপ্টেম্বর ফাঁস হওয়ার পর জ্যোতিকা জ্যোতির মতো আরো কিছু শিল্পী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন৷ যেসব স্ক্রিনশট ফাঁস হয়েছে, সেগুলোতে তাদের ফোন নম্বর দেওয়া ছিল৷ এ কারণে অনেকে হয়রানির শিকার হন৷

গত কিছুদিনে শিল্পীদের কেউ কেউ নিজেকে ওই গ্রুপে সক্রিয় রাখেননি জানিয়ে এসব চ্যাটের সঙ্গে জড়িত নন বলে সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেন৷ আবার কেউ কেউ নিজের ভুল স্বীকার করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন, কেউবা ক্ষমা চেয়েছেন৷ একই পেশার বয়োজ্যেষ্ঠরা গ্রুপে যুক্ত করায় অসম্মান হতে পারে ভেবে বেরিয়ে যাননি বলে দাবি করেন কেউ কেউ৷

প্রকৃত শিল্পীর ভাবনার জায়গা থেকে পুরোপুরি মুক্ত পরিবেশ দরকার: আজমেরী হক বাঁধন

অভিনেতা মিলন ভট্টাচার্য তাদের একজন৷ আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার দাবি, বিভিন্ন হুমকির কারণে ‘আলো আসবেই' গ্রুপে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি৷ একইভাবে অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবুর মন্তব্য, ‘‘ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক নয়৷ যে-কোনো গ্রুপের অ্যাডমিনের কাছে ফোন নম্বর থাকলে তিনি সেই গ্রুপে যাকে খুশি, যতজন খুশি যুক্ত করতে পারেন৷ আলো আসবেই গ্রুপে আমি কখনও ঢুকিনি৷’’

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটিতে যুক্ত ছিলেন অভিনয়শিল্পী সংঘের বেশ কয়েকজন শিল্পী-নেতা৷ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছোট পর্দার অভিনয়শিল্পীদের এই সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ অভিনয়শিল্পী সংঘ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ‘অশিল্পীসুলভ' আচরণ করেছেন বলে মনে করেন আন্দোলনকারী শিল্পীরা৷

এ প্রসঙ্গে বাঁধন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অভিনয়শিল্পী সংঘ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন৷ কিন্তু এই সংগঠন একটি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় বিবৃতি দিয়ে সেই দলের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এমন মুহূর্তে, যখন বাংলাদেশের মানুষ সংকটাপন্ন ছিল৷ আমাদের গঠনতন্ত্রে যে বিধিমালা আছে, সেখানে এটি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক৷ অভিনয়শিল্পী সংঘ অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি বজায় রাখা হয়নি৷ এর নির্বাচিত কমিটি প্রশ্নবিদ্ধ জায়গায় চলে গেছে৷’’

যদিও অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিমের দাবি, অরাজনৈতিক ও সর্বদলীয় নীতি বজায় রেখেছেন তারা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অরাজনৈতিক সংগঠনের বিধি শতভাগ আমরা মেনে চলার চেষ্টা করি৷ সকল দলের, সকল মতের মানুষের সংগঠন এটি৷ সংগঠনটির ব্যানারে বিগত সরকারের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়নি৷ এমনকি এই সংগঠনের অফিসে সরকার প্রধানের কোনো ছবি, কিংবা এমন কোনো কিছু কখনো টানানো হয়নি৷ রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডের প্রচার এই সংগঠনের ব্যানারে নেই৷’’

আওয়ামী সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছাত্রদের আন্দোলনবিরোধী কার্ড পোস্ট করায় সংঘের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছেন তরুণ অনেক শিল্পী৷ কার্যনির্বাহী পরিষদ ও উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি প্রকাশ্যে অনাস্থা জানিয়ে সংগঠন সংস্কারের দাবিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর ৪৬ জন শিল্পী বৈঠকে বসেন৷ তারাই গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে সমবেত হয়ে ‘দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীসমাজ' ব্যানারে মুক্ত আলোচনায় নির্বাচিত কমিটিকে পদত্যাগের সময় বেঁধে দেন৷ এরপর সংঘের নেতারা বিশেষ সাধারণ সভা ডাকেন৷ ইতিবাচক সংস্কারের মাধ্যমে সংগঠনকে আরো সদস্যবান্ধব করার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন হয়েছে৷ এর প্রধান থাকছেন অভিনেতা-নির্মাতা তারিক আনাম খান৷ আগামী চার মাস সংস্কারে কাজ করবে অন্তর্বর্তী কমিটি৷ এরপর নির্বাচন আয়োজনের পদক্ষেপ নেবে এই কমিটি৷

বিতর্ক প্রসঙ্গে আহসান হাবিব নাসিমের যুক্তি, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরে ফেসবুকে একটি ডিজিটাল কার্ড পোস্ট করায় আমাদের নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছিল৷ আমাদের সাংগঠনিক ধারার ২৬-এর ৩ ধারায় লেখা আছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সুদৃঢ় অবস্থান নিতে পারবে সংঘ৷ পরে আমরা বুঝতে পেরেছি, সেটি পোস্ট করা তখনকার সময়ের জন্য উপযোগী ছিল না৷ ভাষাগত কারণে আন্দোলনের সময় সেটি সার্বজনীন হয়নি৷ সেজন্য অনেকেই ধরে নিয়েছেন এটি রাজনৈতিক প্রভাবে করা হয়েছে৷ যদিও রাজনৈতিক কোনও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অভিনয়শিল্পী সংঘের কোনও সম্পর্ক নেই৷ সাংগঠনিকভাবে সংঘ কখনোই রাজনীতিতে যুক্ত ছিল না৷ আর ওই কার্ডের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি, কারণ সেটি সার্বজনীন হয়নি৷ এই একটি ঘটনার জন্য সংগঠন কিন্তু দলীয়করণ করা হয়নি৷’’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নেমেছিলেন বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক শিল্পী৷তখন সরব হওয়ায় তারা এখন প্রশংসায় ভাসছেন৷ বাঁধন তাদেরই একজন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘আমাদের কাজের ক্ষেত্রে সংগঠনের অনেক কিছু পরিবর্তন আনা দরকার৷ সংস্কার কমিটি সেক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা করবেন বলে আশা করি৷’’

তবে অন্তর্বর্তী কমিটি গঠনের পরও সমাধান আসবে বলে মনে করেন না মামুনুর রশীদ৷ টেলিভিশন শিল্পী-কলাকুশলীদের ১৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) চেয়ারম্যান তিনি৷ তার দৃষ্টিতে, ‘‘নতুনভাবে আবারও নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি আসবে ঠিকই, কিন্তু এটাকে আমার কোনো সমাধান মনে হয় না৷ কারণ মনের ভেতর রেষারেষি রেখে সমাধান আসে না৷ শিল্পীদের মাঝে বিভাজন মোটেও প্রত্যাশা করি না আমরা৷ এমনিতেই আমাদের টেলিভিশনের অবস্থা নাজুক৷ তার ওপর শিল্পীরা যদি মনের ভেতর প্রতিহিংসা রেখে দেয় তাহলে সৃষ্টিশীল কাজ কীভাবে হবে?’’

সেক্ষেত্রে উত্তরণের পথ কী হতে পারে? শিল্পীদের মধ্যকার সম্পর্কে স্থিতিশীলতা  ফিরিয়ে আনতে কী হতে পারে সমাধান? এ প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিল্পীদের নিজেদের রাজনীতির মাত্রা বুঝতে হবে৷ অনেকের মধ্যে অতিরিক্ত দলাবদ্ধতার একটা প্রবণতা দেখা যায়৷ শিল্পীদের এই দলাবদ্ধতা কখনও এত বেশি প্রকাশ্য হয়ে যায় যে, পরবর্তী সময়ে যে সরকার আসে তারা একটা প্রতিশোধ নেয়৷ গণতান্ত্রিক দেশে এটা একেবারেই কাম্য নয়৷’’

দলীয়করণের মাধ্যমে শিল্পীদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিলে হবে না: আসিফ আকবর

শিল্পীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন আসিফ আকবর৷ তবে তার অভিমত, দলকানা হওয়া উচিত নয় কারও৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বিএনপি করি বলে দলের সমালোচনা করতে পারবো না, এমনটা ভাবি না৷ যদি অপরাধী না হই, অবশ্যই আমি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি দেখলে সমালোচনা করবো৷ এজন্য সাহস থাকতে হবে৷ যদি সৎ থাকি, সুবিধাভোগী না হই, অপকর্ম ও দুর্নীতি যদি না করি তাহলে সত্যি কথা বলতে অসুবিধা কোথায়৷ সমস্যা হলো, আমাদের বেশিরভাগই তো সৎ থাকে না৷ কেউ জাতীয় পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছে, কেউ সংসদ সদস্য হয়েছে৷ আমি এগুলো করিনি কখনো, কারণ, আমি দলকানা নই৷ বিএনপির আমলে কিন্তু আমি জাতীয় পুরস্কার পাইনি, পেয়েছি তত্ত্বাবধায়কের আমলে৷ চাইলে দল থেকে এই সুবিধা নিতে পারতাম৷ অতীতে আমি যেমন নীতি বজায় রেখে এসেছি, এখন এই পর্যায়ে এসে এর ব্যত্যয় ঘটার কারণ নাই৷’’

‘রেহানা মরিয়ম নূর' তারকা বাঁধন যোগ করেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, সত্যিকারের রাজনীতিবিদরা জনগণের পাশে থাকেন৷ একজন সত্যিকারের শিল্পীরও জনগণের পাশেই থাকার কথা৷ তার কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে থাকার কথা না৷ যদি কোনও কারণে সেই রাজনৈতিক মতাদর্শ জনতার সঙ্গে না থেকে ক্ষমতার সঙ্গে থাকে, সেক্ষেত্রে মানুষ তার দিকে আঙুল তোলে৷ শিল্পীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ নিজের জায়গাকে কতটুকু প্রশ্নবিদ্ধ করবেন আর জনগণের পাশে কিংবা ক্ষমতার সান্নিধ্যে কতটা থাকবেন সেসব কিন্তু মুখ্য৷ শিল্পীরা রাজনীতি কোন পর্যায় পর্যন্ত করবেন সেটা বোঝা জরুরি৷ আপনি জনগণের মাধ্যমে একজন শিল্পী হয়ে উঠলে একপর্যায়ে গিয়ে অবশ্যই মানুষের কথাই ভাবা প্রয়োজন৷ আমি বিশ্বাস করি, আমরা শিল্পীরা নিজের জন্য যতটা না, তার চেয়ে মানুষের জন্যই কাজ করি বেশি৷ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে একসময় প্রশ্ন উঠবেই৷’’

শিল্পীদের জন্য মুক্ত পৃথিবী রাখার কি কোনো বিকল্প আছে? গায়ক মনির খান মনে করেন, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় কোনো বাধা বা দেয়াল থাকতে নেই৷ শিল্পীর কণ্ঠকে রোধ করতে নেই৷ তার আশা, ‘‘নতুন সূর্যের আলোয় নতুন করে পাখা মেলবে শিল্প-সংস্কৃতি৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান