শিক্ষায় ক্যাডার, নন-ক্যাডার প্রশ্নে বিরোধ
২৮ নভেম্বর ২০১৭বাংলাদেশে ২৮৩টি বেসরকারি কলেজকে সরকারি (জাতীয়করণ) করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত এপ্রিল মাসে৷ এর আগেও ধাপে ধাপে কিছু বেসরকারি কলেজকে সরকারি করা হয়েছে৷ এত বেশি সংখ্যক কলেজ একসঙ্গে সরকারি করার সিদ্ধান্ত এই প্রথম৷ এছাড়া এ পর্যন্ত ৫৩টি কলেজ সরকারি করার চূড়ান্ত আদেশ জারি হয়েছে৷ সেখানকার শিক্ষকরাও ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন৷ পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোর ব্যাপারেও আদেশ জারি হবে৷ আর এতেই আপত্তি সরকারি কলেজে কর্মরত বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের৷ তাঁদের কথা, ‘‘বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি করা হোক৷ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক৷ তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নাই৷ তবে তাঁরা বিসিএস পরীক্ষা না দিয়েই বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হবেন, এটা আমরা মানতে পারি না৷''
দেশে বর্তমানে ১৫ হাজারের বেশি ক্যাডারভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন৷ তাঁদের মধ্যে ১৩ হাজার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এবং দু'হাজার এর আগে বিভিন্ন সময় জাতীয়করণকৃত কলেজের আত্মীকৃত শিক্ষক৷
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার এবার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মোট ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণ করছে৷ এতে করে ১৫-১৬ হাজার বেসরকারি শিক্ষক সরকারি হবেন৷ তাঁদের যদি ক্যাডারভুক্ত করা হয়, তাহলে আমরা যাঁরা প্রকৃতই বিসিএস ক্যাডার, তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়বো, মাইনরিটি হয়ে পড়বো৷ আমাদের পদ, পদোন্নতি, সিনিয়রিটি – এ সব বিষয় নিয়ে আমরা জটিলতায় পড়বো৷ এই জটিলতায় মামলা-পাল্টা মামলা হবে৷ এটা ন্যায়নীতি বিরোধী৷ কারণ আমরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হয়েছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নতুন যেসব কলেজ সরকারি হবে তার শিক্ষকরা ঐ কলেজেই থাকবেন৷ বদলি হবেন না৷ প্রধানমন্ত্রীর এই কথাতেই ইঙ্গিত আছে যে, তাঁরা বিসিএস ক্যাডার হবেন না৷ ক্যাডার হলে তো বদলির বিষয় থাকত৷ তাছাড়া ২০১০ সালের শিক্ষা নীতিতেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়রিটি ও তাঁদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বলা হয়েছে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা এ মাসে দু'দিন ( ২৬ ও ২৭ নভেম্বর) কর্মবিরতি পালন করেছি৷ ডিসেম্বর মাস যেহেতু বিজয়ের মাস, তাই ঐ মাসে কোনো কর্মসূচি দেইনি৷ জানুয়ারি মাসের ৬, ৭ ও ৮ তারিখে ফের কর্মবিরতিতে যাব৷ তাতেও যদি আমাদের দাবি আদায় না হয়, তাহলে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি দেবো৷''
তাঁর কথায়, ‘‘কলেজ জাতীয়করণ হোক তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই৷ তাঁদের বেতন-ভাতাসহ আমাদের মতো অন্যান্য সুবিধা দিলেও আপত্তি নেই৷ আমাদের দাবি, ঐ সব শিক্ষককে নন-ক্যাডার মর্যাদায় রাখতে হবে৷ তাঁদের বদলি করা যাবে না এবং পদোন্নতির পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে৷ এ জন্য আলাদা একটি বিধিমালা জারি করতে হবে৷''
অন্যদিকে জাতীয়করণের আওতাভুক্ত শিক্ষকরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁদের ক্যাডারভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে৷ কলেজ জাতীয়করণের আদেশ ২০০০-এ এ কথা উল্লেখ আছে৷ তাই তাঁরা মনে করেন, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে না এলেও বিসিএস ক্যাডারদের চেয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা কম নয়৷''
জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মাত্র তিনটি কলেজ সরকারি ছিল৷ ১৯৭৮ সাল থেকে কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে৷ এরপর পর্যায়ক্রমে ২০০টি কলেজ সরকারি হয়েছে৷ ঐ সব কলেজের শিক্ষকরা ক্যাডার হিসেবেই নিয়োগ পেয়ে আসছেন৷ তবে এখন এটা নিয়ে কথা উঠছে কেন? যাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি কলেজ স্থাপনের বিরোধী, তাঁরাই এখন এ সব কথা বলছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘২০০০ বিধি অনুযায়ী, যেসব বেসরকারি কলেজ সরকারি কলেজ হিসেবে আত্মীকৃত হবে, সেসব কলেজের শিক্ষকরাও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে আত্মীকৃত হবে৷ সরকারের এবারের সিদ্ধান্তে বিসিএস শিক্ষায় নতুন ১৫ হাজার পদ সৃষ্টি হবে৷ কিন্তু এঁদের এই বিরোধিতার কারণে নতুন পদ সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ এই ১৫ হাজার শিক্ষকের বড় একটি অংশ ৫-৬ বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবেন৷ তখন নতুনদের জন্য বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা সরকারি কলেজের শিক্ষক হলে তাঁদের নন ক্যাডার করার কথা বলা হয়নি৷ বলা হয়েছে, শিক্ষা ক্যাডারের অধিকার সংরক্ষণের কথা৷ তাঁদের কোনো অধিকার কেটে তো আমাদের দেয়া হবে না৷ আমাদের যা দেবে সরকার দেবে, রাষ্ট্র দেবে৷ তাতে তাঁদের আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না৷''
তিনি আরো বলেন,‘‘আমাদের যদি নন ক্যাডার করা হয় তাহলে তা হবে বৈষম্যমূলক৷একই কলেজে একই সিলেবাসে পড়াবেন আর দু'জন শিক্ষকের মর্যাদার বৈষম্য হবে, এটা তো হয় না৷''
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওয়াহিদুজ্জামান এ নিয়ে ডয়চে ভেলের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ তিনি শুধু বলেন, ‘‘এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়৷'' এদিকে এই সংকট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য এখনো দেয়নি৷ তবে গত রবিবার এ নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে৷
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এখন সরকারি কলেজ ৩১৫টি৷ আর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরো ২৮৩টি কলেজ সরকারি হলে মোট সরকারি কলেজ হবে ৫৯৮টি৷