1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘শিক্ষকদের সাথে রীতিমতো অসভ্যতা করা হয়েছে’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩০ আগস্ট ২০২৪

মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের অধ্যাপক৷ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের নানাভাবে অপমান, অপদস্থ করে পদত্যাগে বাধ্য করার বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি৷

https://p.dw.com/p/4k7bP
প্রতীকী ছবিছবি: Fotolia/ThorstenSchmitt

ডয়চে ভেলে: দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষকদের অপমান, অপদস্থ করছেন৷ তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ উপাচার্যদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ এই ঘটনাগুলো আপনি কীভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা ভালো প্র্যাকটিস না৷ এটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না৷যে শিক্ষার্থীরা এই কাজ করছেন, তারা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে  এগুলো করছেন৷ তবে আমি মনে করি, অভিযোগ থাকলে তারা অভিযোগ করতে পারেন৷ বিচার চাইতে পারেন৷ কিন্তু তারা শিক্ষকদের অপমান,  অপদস্থ করছেন৷ আমাদের এখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে সংস্কৃতি তার সঙ্গে এই ঘটনাগুলোকে মেলানো যায় না৷

অভিযোগ থাকতে পারে৷ কিন্তু শিক্ষদের টেনে হিঁচড়ে বের করা৷ তাদের গায়ে হাত দেয়া৷ এগুলো কীভাবে নেবেন?

এই ঘটনাগুলো বেদনাদায়ক, অনাকাঙ্খিত এবং অনুচিত৷ 

‘এটা কোনো রেগুলার সরকার না’

এখন এসে শিক্ষা উপদেষ্টা এব্যাপারে কথা বলছেন৷ প্রধান উপদেষ্টাও বলছেন৷ কিন্তু এত দেরিতে কেন?

এটা কোনো রেগুলার সরকার না৷ অন্তর্বর্তী সরকার৷ ফলে তাদের বুঝতে সময় লেগেছে৷ রিআ্যক্ট করতে সময় লেগেছে৷ তারা সময়মতো এ ব্যাপারে রিঅ্যাক্ট করতে পারেনি, ব্যবস্থা নিতে পারেনি৷ তাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল৷  আমি মনে করি, এই ধরনের ঘটনা ঘটার আগেই তাদের  সতর্ক হওয়া দরকার ছিল৷ আর শুরুতেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার ছিল৷

শিক্ষার্র্থীরা নিজেরাই দায়িত্ব হাতে তুলে নিলো৷ তারা কোনো শিক্ষককে বিদায় করছে, পছন্দের কাউকে বসাচ্ছে৷ এতে তাদের মানসিক অবস্থার এক ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে৷ তার কী হবে?

এটা শুধু শিক্ষার্থীদের  ওপর নয়, শিক্ষকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ তারা মনে করবে যে, বাচ্চাদের আমি এতদিন ধরে পড়ালাম, তারা আমার সাথে এইরকম ব্যবহার করছে৷ আমার সাথে না করলেও আমার সহকর্মীর সঙ্গে করছে৷  ফলে ছাত্র- শিক্ষকের যে সম্পর্ক আমাদের দেশে, তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ তাই এটা দ্রুত বন্ধ করা এবং যা ক্ষতি হয়েছে তা আবার রিপেয়ার করা দরকার৷

এটা কীভবে রিপেয়ার হবে? প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘‘ছাত্ররা আমাদের নিয়োগ দিয়েছে৷'' ছাত্ররা মনে করছে, তারাই এখন দেশ চালাচ্ছে৷  এই মানসিকতার পরিবর্তন কীভাবে হবে?

আসলে ‘আমরা দেশ চালাচ্ছি'- এমন ভাব, ছাত্ররা আমাদের নিয়োগ দিয়েছে৷ এগুলো কোনো কংক্রিট বিষয় নয়৷ মূল বিষয় হলো, সরকারের অ্যাপ্রোচ৷ তার ওপরেই আসলে অনেক কিছু নির্ভর করে৷ এখন ছাত্ররা যদি মনে করে, ‘‘আমরা দেশ চালাচ্ছি৷ আমাদের মতো করেই সব কিছু হবে, তাহলে কিন্তু তারা এক ধরনের অথোরাইজেশন পেয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু দিন শেষে তো রাজনীতিবিদরাই দেশ চালাবেন৷ মিনিমাম যে সংস্কার দরকার সেটা শেষ করে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এই মেসেজটা যদি  তারা পরিস্কার করে দেন, তাহলে তার একটা প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে৷ শিক্ষার্থীরা বুঝবেন তাদের জায়গা হলো ক্লাসরুম৷  যে শিক্ষকরা নিপীড়ন করেছেন, নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷

সেই ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ছাত্ররা নিতে পারেন না..

না, অবশ্যই না৷  তারা অভিযোগ করতে পারেন, ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা প্রশাসন বা সরকার৷

আপনি কি খেয়াল করেছেন, এখানেও ছাত্রদের পিছনে কিছু শিক্ষক আছেন, যারা শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়েছেন, তাদের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন৷

এটা যে একেবারে দেখিনি, তা নয়৷ তবে পরিস্কার কোনো এভিডেন্স আমার কাছে নাই, কোথাও যে সরসরি শিক্ষকরা উসকানি দিয়েছেন বা ছাত্রদের অন্য শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, তার প্রমাণ আমার কাছে নেই৷ তবে শোনা যাচ্ছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে  বিভিন্ন রকম কমিটি আছে, তাদের দ্বন্বেও হতে পারে৷

৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের  ভিসি পদত্যাগ করেছেন৷ আবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে  ক্লাশও হচ্ছে না, ছাত্ররা ক্লাসে ফেরেনি৷ শিক্ষায় অচলবস্থা সৃষ্টি হয়েছে৷

আসলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একরকম আবার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল, কলেজে যা হয়েছে, তা আরেক রকম৷ দুইটিকে এক করে দেখার সুযোগ নেই৷ আমরা জানি যে, উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়৷ আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হলেই যে, তারা সবাই খারাপ, তা কিন্তু আমি বলছি না৷ কিন্তু  এখন একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ ফলে ভালো ভালো অধ্যাপকরা উপাচার্য হতে পারেননি৷

বর্তমান সরকার নন-পলিটিক্যাল৷ তবে এখন পর্যন্ত যে কয়জনকে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা কি নন-পলিটিক্যাল?

দেখুন মানুষ তো রাজনৈতিক জীব৷ প্রত্যেকটা মানুষের একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে৷ তবে দলের হয়ে সে যদি পলিটিক্যাল এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করে, তাহলে আমি কোনো সমস্যা দেখি না৷ 

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে গলদ তৈরি হলো, সেটা কি কাটবে? কাটবে কীভাবে?

প্রথম কথা হলো, যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না৷ এগুলো বন্ধ করে খালি জায়গায় যোগ্য লোককে বসাতে হবে৷ ওই যোগ্য লোকগুলোই চেষ্টা করলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে ঘাটতি হয়েছে, তা মেরামত করতে পারবেন৷ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে৷ ন্যাশনাল ফেলো ফিলিং হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরে৷ এই যেমন, ছাত্ররা প্রাথমিকভাবে ত্রাণ দিচ্ছেন৷ উদ্যোগটা ভালো৷ প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এটা করতে পারে৷ কিন্তু ত্রাণ দেয়া তো তাদের কাজ না৷ আমাদের একটা ত্রাণ মন্ত্রণালয় আছে৷ নানা বাহিনী আছে৷ ঠিক আছে, ওরা প্রাথমিকভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করেছে৷ এখন সরকারের লোকজন তাদের কাছ থেকে নিয়ে বিতরণ করবে৷ এখন দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া, তাদের ক্লাসে ফেরা দরকার৷ লেখাপড়া শুরু করা দরকার৷ শিক্ষার্থীদের দিয়ে এসব করানো দরকার নেই৷ এই যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এগুলো তো তাদের কাজ না৷

একটি জেনারেশনের মধ্যে কি ক্লাস বা শ্রেণি বিমুখতা তৈরি হচ্ছে বা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে?

তারা যদি দীর্ঘদিন শিখণ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে , অলরেডি কিন্তু তারা তিন মাসের মতো বিচ্ছিন্ন৷ একটা লার্নিং গ্যাপ কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে৷ আমি মনে করি, খুব দ্রæত এটার দিকে নজর দেয়া দরকার৷ খুব দ্রুত তাদের ক্লাসে ফেরত নেয়া দরকার৷

শিক্ষকদের যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাতে তারা কি সার্ভিস বেনিফিট থেকে বঞ্চিত হবেন? চাকরি চ্যুত করলে তো বেনিফিটসহ করা হয়৷

এটা আসলে নির্ভর করে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তার চাকরির বয়স কত, তার ওপর৷ কিন্তু এভাবে গায়ে হাত দিয়ে, টেনেহিঁচড়ে পদত্যাগ করানো এটা তো বৈধ না৷ এটা তো রীতিমতো অসভ্যতা৷ এটা সরকারকে দেখতে হবে ৷ তদন্ত করতে হবে৷ আমরা আহাজারি শুনেছি মেধাবীরা  শিক্ষকতায় আসছেনা, এখন তো আরো আসবেনা৷ কারণ অপমান অপদস্থ করে শিক্ষকদের বের করে দেয়া হয়৷ আশঙ্কা তো থেকেই যায়৷

যারা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছেন, টেনে নামিয়েছেন- তাদের বিরুদ্ধে কি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়?

আমি মনে করি, অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ গায়ে হাত দেয়া, অপদস্থ করা এগুলো ফৌজদারী অপরাধ৷

ব্যবস্থা নিলে কী হবে?

আমি আগেই বলেছি সরকারের অ্যাপ্রোচটা গুরুত্বপূর্ণ৷ কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে জাতীয় পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে, এই ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে৷ তবে ছাত্রদের ওপেন রেখে এই ব্যবস্থা নিলে তার আবার রিঅ্যাকশন হতে পারে৷ আগে ছাত্রদের শ্রেণি কক্ষে ফেরত নিতে হবে৷ তারপরে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবতে হবে৷