রেমালের আঘাত: বিদ্যুৎহীন লাখো মানুষ, প্লাবিত অনেক অঞ্চল
২৭ মে ২০২৪রেমালের আঘাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাতিয়া উপজেলায় প্রায় ৫২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হলো নিঝুম দ্বীপ। সেখানকার বেশির ভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানিতে পুরো নিঝুম দ্বীপ ৪-৫ ফুট পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়া ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুখচর, নলচিরা, চরকিং, তমরুদ্দি ও চর ঈশ্বর ইউনিয়নও। ইউএনও জানান, ঝড়ের পরবর্তী সময়ে ঝোড়ো হওয়া ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় কোনো এলাকা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
গভীর স্থল নিম্নচাপ
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রেমাল বর্তমানে যশোর ও এর আশে পাশের এলাকায় অবস্থান করছে। তবে এর বর্ধিতাংশ রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এরপর বিকেলে গভীর স্থল নিম্নচাপের কেন্দ্র ঢাকার ওপর আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সে সময় বৃষ্টিপাত ও দমকা হাওয়া বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গভীর স্থল নিম্নচাপটি বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে আগামীকালের মধ্যে আসামের দিকে চলে যাবে।
পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকেও তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীতেও সাবধানে চলাচল করতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে আর কোনো বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে না।
বৃষ্টিপাতের পরিমাণ
আবহাওয়াবিদদের মতে, সারাদিন আবহাওয়া পরিস্থিতি প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ২০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া কুতুবদিয়ায় ১২৫ মিলিমিটার, সাতক্ষীরায় ৯৩, পটুয়াখালী ৭২, মোংলায় ৬৭, খুলনায় ৬৫, খেপুপাড়ায় ৫৮, যশোরে ৫৩, বরিশালে ও ভোলায় ৪১, চুয়াডাঙ্গায় ১৮ এবং কুমারখালীতে ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে অধিদপ্তর। মধ্যরাত থেকে উপকূলীয় অধিকাংশ জেলায় বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। গত রাত দেড়টার দিকে খেপুপাড়ায় প্রতি ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার বেগে দমকা বাতাস রেকর্ড করা হয়েছে, রাত সাড়ে ১১টায় সেখানে বাতাসের গতি ছিল ৯১ কিলোমিটার।
বিদ্যুৎহীন লাখো মানুষ
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) রোববার তাদের গড় উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। পিডিবি জানিয়েছে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তারা উপকূলীয় এলাকায় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের সময় সারা দেশে অনেক বৈদ্যুতিক পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—মূলত খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর আবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হবে।' উৎপাদন কম হওয়ায় মধ্যরাত থেকে ঢাকার কিছু এলাকাসহ সারা দেশের অনেক উপজেলায় লোডশেডিং চলছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) সেবা দিতে পারছে না। এর প্রভাব পরেছে দক্ষিণের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে।
ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ
গতকাল রোববার রাত আটটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলাসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ১৬৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ এবং ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। খুলনার ৭০টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার দুর্গত এলাকায় এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের দক্ষিণের জেলাগুলোতে গতকাল রোববার থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে আজ সোমবার সকাল ১০টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঝরছিল। জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। ভারী বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। এ পর্যন্ত সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও ভোলায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
খুলনা: ভারী বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে খুলনা নগরের নিম্নাঞ্চল। নগরের বিভিন্ন এলাকায় গাছ উপড়ে পড়েছে। খুলনা শহর ও জেলার প্রায় পুরোটাই বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। গতকাল রোববার রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে নগরের মুজগুন্নী, লবণচরা, মোল্লাপাড়া, টুটপাড়া, মহিরবাড়ি খাল পাড়, শিপইয়ার্ড সড়ক, চানমারী বাজার, রূপসাসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে খুলনার দাকোপ উপজেলায় জোয়ারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। গতকাল রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপজেলার শিবসা ও ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে যায়। তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ক্ষীতীশ গোলদার জানিয়েছেন, এত উঁচু জোয়ার আগে তিনি দেখেননি।
বরগুনা: ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বরগুনার প্রধান তিন নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে জেলা শহরসহ সেখানকার উপকূলের অনেক গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলা এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পালের বালিয়াতলী ও বদরখালী ইউনিয়নের বাওয়ালকর এলাকায় বাঁধ ভেঙে ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
ভোলা: ভোলার বিভিন্ন এলাকায় গতকাল দিনের চেয়ে রাতে ঝড়বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বেশি হয়েছে। এখনো বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে। কলাতলী ইউনিয়নের পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, তাঁর ইউনিয়নের চারপাশে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে কোনো বাঁধ নেই। ফলে জোয়ারের পানি উঠে ফসল-মাছের ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা: দমকা বাতাসের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টির কারণে কিছু কাঁচা ঘর ভেঙে গেছে, উপড়ে পড়েছে গাছপালা। কিছু চিংড়িঘেরও ভেসে গেছে।
যশোর: গতকাল রাত ১০টার পর থেকে যশোর শহরে ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। রাত ১২টার দিকে বাতাসের গতিবেগ বাড়লে গোটা শহরের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পটুয়াখালী: গতকাল রাতে জেলায় জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের তীব্রতা শুরু হয়। প্রবল বেগে বাতাসের সঙ্গে প্রবল বর্ষণ এখনো আছে। কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের জালালপুর, খ্রিষ্টানপল্লি, পশ্চিম হাজিপুর, নবীপুর, ফতেহপুরসহ পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল রাত ১২টার সময় জোয়ারে জালালপুর গ্রামসংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর থেকে পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এ কারণে এখানকার পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়।
কুয়াকাটা সৈকত এলাকা এখনো ছয়-সাত ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। কুয়াকাটার নিকটবর্তী পশ্চিম খাজুরা এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির বাইরের অংশ এবং সাগর মোহনার মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর গ্রামসংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটিও জোয়ারের চাপে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাগেরহাট: গতকাল রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টি আর থেমে থেমে দমকা বাতাস এখনো অব্যাহত আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে ঝোড়ো বাতাস আগের কোনো ঘূর্ণিঝড় দেখেননি তারা। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিভিন্ন স্থানে গাছপালা পড়ে সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন রয়েছে পুরো বাগেরহাট। শহরাঞ্চলে আজকের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছে ওজোপাডিকো। তবে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ–সংযোগের আওতায় আনতে আরও সময় লাগতে পারে।
গতকাল রাত থেকে জেলার নদ-নদীগুলার পানি আরও বেড়েছে। জেলার অন্তত তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। বাঁধ উপচে পড়া জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ১০০ গ্রাম। তলিয়ে গেছে বসতঘর, রান্নাঘরসহ গৃহপালিত পশুপাখির থাকার জায়গাগুলো। জোয়ারের পানিতে জেলার কয়েক হাজার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত চার হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এপিবি/কেএম (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার বাংলা)