রামমন্দিরের প্রভাব কম, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জাতের অঙ্কে ভোট
২১ এপ্রিল ২০২৪নতুন পিচের রাস্তায় একের পর এক আঁখবোঝাই লরি যাচ্ছে। গন্তব্য খাটোলির চিনিকল। মাঠে এখনো কিছ জমিতে আঁখ রয়েছে কাটার অপেক্ষায়। তার সঙ্গে আছে গম। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের অত্যন্ত উর্বর জমিতে এই দুই ফসলই কৃষকের ঘরে অর্থ নিয়ে আসে। তাই ভোটের আগে রাজ্য সরকার আঁখের সংগ্রহমূল্য একধাক্কায় ৩০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও মানুষের মন পাওয়া যাচ্ছে কি?
উত্তরপ্রদেশের বা বলা ভালো পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামের একটা চরিত্র আছে। প্রায় সব বাড়ি পাকা। গ্রামগুলি জাত-প্রধান। অর্থাৎ কোনো গ্রাম জাঠবহুল, কোথাও অন্য অনগ্রসরদের সংখ্যাধিক্য, কোথাও দলিত বা কোনো গ্রামে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেভাবেই গ্রামের পরিচয় দেন তারা। আর উত্তরপ্রদেশের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ খেোলাখুলিভাবে জানান, তারা কাকে ভোট দিয়েছেন। কোনো লুকোছাপা করেন না। গতবার কাকে ভোট দিয়েছিলেন, সেটাও জানিয়ে দেন।
গ্রামের অন্দরে
দুপুরের রোদে পুড়ছে মুজফফরনগর। গরম হাওয়া বইছে। তার মধ্যে চলছে ভোটগ্রহণপর্ব। গ্রামের ভিতরে একটি স্কুলে ভোট। ভিতরে কয়েকজন পুলিশ বসে। গ্রামবাসীরা আসছেন-যাচ্ছেন। বিকেলের দিকে ভোটদাতার সংখ্যা বাড়লো।
ঠিক ওই ভোটকেন্দ্রের উল্টোদিকে রবিন্দরের বাড়ি। একটা দড়ির খাটিয়ায় বসে আছেন। মানুষজন ভোট দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে সেখানে আসছেন। অনেককে রবিন্দরই ডেকে আনছেন।
কাকে ভোট দিলেন? প্রশ্নটা করতেই সঙ্গে্ সঙ্গে জবাব এলো, ''হাতিতে।'' হাতি হলো বহুজন সমাজ পার্টি বা বসপা-র প্রতীক। অনগ্রসর রবিন্দর সেখানেই এবার ভোট দিয়েছেন। গতবার কাকে দিয়েছিলেন? জবাব এলো, ''বিজেপি-কে।''
তাহলে এবার দলবদল করলেন? এবারো জবাব আসতে দেরি হলো না। ''কী করব, সাংসদ হওয়ার পর সঞ্জীব বালিয়ান তো অনগ্রসরদের জন্য কিছু করেনি। তাই এবার ওকে ভোট দিইনি। বসপা প্রার্থী ভালো। তাই তাকেই ভোট দিয়েছি।''
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রামপাল। বললেন, ''দাঁড়ান, ভোটটা দিয়েই আসছি।'' কাকে ভোট দেবেন? এবারও জবাব এলো ''বিএসপি-কে।'' কারণ, প্রার্থী দারা সিং প্রজাপতি হলেন কুমোর। আর রামপালও কুমোর। তাই দারা সিং-কে বাদ দিয়ে আর কাউকে ভোট দেয়ার কথা ভাবতে পারছেন না। গতবার তিনিও বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন।
গ্রামপ্রধান হরদীপ অবশ্য জানালেন, তিনি তো বটেই, ওই গ্রামের প্রচুর মানুষ বিজেপি-কেই ভোট দিচ্ছে্ন। কারণ অন্য কিছু নয়, তারা মোদীকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান। সেজন্য বিজেপি-তে ভোট পড়ছে।
দলিতপ্রধান গ্রামে
এবার যাত্রা একটা দলিতপ্রধান গ্রামে। একইরকম নিস্তরঙ্গ একটা স্কুলে ভোট চলছে। কোথাও কোনো অশান্তি নেই। গোলমাল নেই। ছাপ্পা ভোট নেই। শান্তিতে ভোট পড়ছে। সেরকম লাইনও নেই।
সেখানেই দেখা রবিদাসের সঙ্গে। ভোট দিয়ে বেরিয়েছেন। বললেন, হাতিতে ভোট দিয়েছেন। এখানকার দলিত ভোট পড়ছে হাতিতে।
এবার উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে কম প্রচার করেছে বিএসপি। গত কয়েক বছরে মায়াবতীকে সেরকমভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। তিনি মাঝ্মধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন মাত্র। তারপরও বিএসপি-কে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মানুষ ব্রাত্য করেনি। দলিত ও কিছু অনগ্রসর হাতিতেই ভোট দিচ্ছেন।
রবিদাসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী জাঠ বললেন, তাদের ভোট বিজেপি-তেই পড়ছে। তবে ভোট বিশেষজ্ঞ কপিলের দাবি, ''গতবার সঞ্জীব বালিয়ান মুজফফরনগরে হারিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতা অজিত চৌধুরীকে। তাই জাঠদের একাংশের বক্তব্য, তাদের নেতা অজিত সিং-কে যিনি হারিয়েছিলেন, সেই সঞ্জীব বালিয়ানকে তারা ভোট দেবেন না।''
মুসলিম গ্রামের ছবি
গ্রামের ভিতরে মসজিদের নমাজ পড়া শেষ করে বেরোবার পর সাজিদ ও তার সঙ্গীরা জানালেন, তাদের ভোট সাইকেলে অর্থাৎ সমাজবাদী পার্টিতেই পড়েছে।
মুজফফরনগরে মুসলিম ভোটদাতার সংখ্যা পাঁচ লাখ। অনগ্রসর ভোটদাতা আছেন সাড়ে পাঁচ লাখ। ফলে সংখ্যার হিসাবে মুসলিমরা এখানে দ্বিতীয় স্থানে। জাঠ ঙোটদাতার সংখ্যা দেড় লাখ। আর বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টি দুই দলের প্রার্থীই জাঠ।
আবেগের বিষয় নেই
সারাদিন ধরে মুজফফরনগর ও তার আশপাশে ঘুরে একটা কথা স্পষ্ট, মানুষ কোনো আবেগের বিষয়কে সামনে রেখে ভোট দিচ্ছেন না। তারা ফিরে গেছেন তাদের জাতিগত পছন্দে। উত্তরপ্রদেশের পুরনো রাজনীতির অঙ্ক তাই আবার ফিরে এসেছে। কোন জাতের ভোট কার দিকে যাচ্ছে। তার উপরই নির্ভর করছে কে জিতবে।
কপিল বলছিলেন, ''এখানে রামমন্দিরের প্রভাব ভোটে পড়ছে না। সেটা পূর্ব উত্তর প্রদেশে পড়তে পারে্। কিন্তু পশ্চিমে এবার ভোট হচ্ছে পুরনো ধাঁচে। তাই লড়াইটাও জমজমাট হচ্ছে। বিজেপি হেসেখেলে জিতবে এমন নয়।''
কপিলের বক্তব্য, ''এবার বিজেপি-র চিরাচরিত সমর্থক রাজপুতরাও মুজফফরনগরে ক্ষুব্ধ। কারণ, রাজপুত নেতা সঙ্গীত সোম ও জেবারেল ভি কে সিং-কে প্রার্থী করা হয়নি। ফলে রাজপুতদের প্রতিনিধি নেই বলে অনেকে এবার সাইকেলে ভোট দিচ্ছেন।''
সেকারণেই গতবার বিজেপি-তে পড়া ভোট এবার চলে যাচ্ছে বিএসপি বা সমাজবাদী পার্টিতে।
ভোটের অনিশ্চয়তা
ভারতে ভোটের বিষয়টাই এরকম। সেখানে সবসময় একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। কোন বিষয় কাদের প্রভাবিত করবে, কখন করবে, তা বলা কঠিন। যেটা হয়েছে মুজফফরনগরে। একসময় ভয়ংকর দাঙ্গার পর এখানে ভোটের ছবিটা ছিল আলাদা। এবার মেরুকরণ না থাকায় লড়াইটা অন্য মাত্রা পেয়েছে।