1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজনীতিবিদ ও তাদের আত্মীয়দের দৌরাত্ম্য

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৮ মে ২০২২

ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের অনেককেই অবৈধ সুবিধা আদায় করতে দেখা যায়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জবাবদিহিতার অভাব এমন পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4AzhZ
Bangladesch Parlamentswahlen
ফাইল ছবিছবি: DW/M. Mamun

মন্ত্রীর আত্মীয় হলে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ যেমন করা যায়, তেমনি সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়া যায়৷ রোগী সেজে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশ ছাড়তে পারেন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামিও৷ গাড়ি চাপা দেয়া যায়, মাতাল হয়ে গুলি করে হত্যাও করা যায়৷ বাংলাদেশে একের পর এক এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷  

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি৷ যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা মনে করেন আইন-আদালত তাদের জন্য নয়৷ প্রশাসনও ওই ক্ষমতাবানদের সহযোগীতে পরিণত হয়৷ কারণ এর বিরোধিতা করেও তারা টিক থাকতে পারেন না৷

স্ত্রী ও পুত্রদের দাপট 

রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও তার স্ত্রী শাম্মি আক্তার মনি এখন আলোচনায়৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রীর নির্দেশে রেলের ট্রেন টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়৷যদিও সমালোচনার মুখে রোববার এই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ৷

জানা গেছে, বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের কারণে মন্ত্রীর স্ত্রীর তিন আত্মীয়কে চ্যালেঞ্জ করায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন টিটিই৷ টিটিইকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ঘটনায় মন্ত্রীর স্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার খবর জানা গেছে৷ অবশ্য প্রথমে এ বিষয়ে অস্বীকার করেছিলেন মন্ত্রী৷ ওই যাত্রীদের সাথে নিজের আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছিলেন৷

পরে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত জানান তিনি৷ এদিকে বৃহস্পতিবার পটুয়াখালির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনের ছেলে ও তার সঙ্গীরা পায়রা সেতুর টোল প্লাজার কর্মচারীদের মারধর করেন বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে৷

জানা গেছে, এমপি পুত্র তাজ তালুকদার তার স্ত্রী এবং সঙ্গীদের নিয়ে টোল ছাড়াই সেতু পার হতে চেয়েছিলেন৷ দায়িত্বরত কর্মচারীরা সেটা হতে দিতে না চাইলে তাদের মারধোর করা হয়৷ এরপর টোল না দিয়েই তারা চলে যান৷

‘রেলমন্ত্রী তো মন্ত্রী থাকার নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছেন’

তার আগে ঢাকার সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিমের দাপটের খবর এসেছিল গণমাধ্যমে৷ ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর করে কারাগারে গেলেও তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি৷ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে তখন তিনটি মামলা হলেও এরইমধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে৷

আর সম্প্রতি তার বাবা সংসদ সদস্য হাজি সেলিম ১০ বছরের চূড়ান্ত দণ্ড মাথায় নিয়ে আত্মসমর্পণের বিষয়ে আদালতের আদেশ থাকা সত্বেও বিনা বাধায় থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে আসেন৷ পুলিশ বা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কেউ তাকে আটকায়নি৷

আওয়ামী লীগের আরেক প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলামের বিরুদ্ধে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদ দখলের অভিযোগ৷ গত বছরসহ বেশ কয়েকবার ওইসব এলাকায় অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও তার স্থাপনা উচ্ছেদ করা যায়নি৷ তিনি বেঁচে থাকতে উচ্ছেদ অভিযানে থাকা ম্যাজিষ্ট্রেটকে হুমকি দিয়েও পার পেয়ে যান৷ বুড়িগঙ্গায় ও পুরান ঢাকায় ব্যাংকের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে৷

এদিকে দাপট দেখানোর এমন অভিযোগ বেশ কয়েকজন এমপি পুত্রের বিরুদ্ধেও৷ এরমধ্যে আছেন নোয়াখালী- ৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর পুত্র সাবাব চৌধুরী৷ তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৯ জুন ঢাকায় এক পথচারীকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগ আছে৷ তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হলো, তিনি ২০২০ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রামে পুলিশের একটি গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছেন৷

২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আহমেদ রনি ইস্কাটন এলাকায় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় এলো পাথাড়ি গুলি ছুড়ে দুই জনকে হত্যা করেন৷

একই বছর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের ছোড়া গুলিতে একটি শিশু গুরুতর আহত হয়৷ এমপি লিটন অবশ্য ২০১৮ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন৷

এদিকে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাইয়ের ছেলে আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে ত্বকি হত্যায়  সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে৷আর শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমান স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস করান৷ পরবর্তীতে চাকরিও হারান সেই শিক্ষক৷

কয়েক মাস আগে দাপট দেখাতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান৷ তবে এমপি হিসেবে এখনো বহাল আছেন৷ সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী৷ কিন্তু পুলিশ এই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানা গেছে৷

এদিকে অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে আলোচনায় এসেছিলেন সিকদার গ্রুপের দুই ভাই রন হক শিকদার ও দিপু হক শিকদার৷

হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হয়েও রোগী সেজে তারা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশের বাইরে যান ২০২০ সালের জুন মাসে৷

তাদের দেশের বাইরে যেতে সব ধরনের অনুমতিও দেয়া হয়৷ আবার রন হক শিকদার তার বাবার মৃত্যুতে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে এয়ারপোর্টে আটক হয়ে কারাগারে না গিয়ে সেদিনই জামিনে মুক্তি পান৷

যা বলছেন বিশ্লেষকরা

মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘‘নৈতিকতার ওপর যে রাজনীতি সেটা এখন আর নেই৷ এখন মাসল ম্যান, অর্থ বিত্তের মালিক যারা তারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ আর একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হতেন তাও এখন আর দরকার হয় না৷ ফলে আমরা শামীম ওসমানকে দেখি, হাজি সেলিমকে দেখি৷ সর্বশেষ রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর টেলিফোনে একজন টিটিইকে বরখাস্ত করার ঘটনা৷ তিনি রেলমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনকে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণে বাধা দেন৷ তাহলে আর থাকল কী! রেলমন্ত্রী এটাকে হালাল করার জন্য নানা অসত্য কথা বললেন৷ এমনকি তিনি ওই টিটিইর চরিত্র হননেরও চেষ্টা করলেন৷ তিনি তো মন্ত্রী থাকার নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছেন৷ তারপরও আছেন৷’’

তার কথা, ‘‘এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে বা ব্যবস্থা নিতে দেখলাম না৷ আমি মনে করি এই যে পরিস্থিতি তার দায় প্রধানমন্ত্রীও এড়াতে পারেন না৷’’

‘দায় প্রধানমন্ত্রীও এড়াতে পারেন না’

আর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, ‘‘এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ৷ সব সময়ই যারা যখন ক্ষমতায় থেকেছেন তারা দাপট দেখিয়েছেন৷ এর মাধ্যমে প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ ফলে যারা দাপট দেখান তাদের সুরক্ষাও দেয়া হয়েছে৷ এটা এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ কৌশল৷’’

রেলমন্ত্রীর ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এখানে তিন ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে৷ প্রথমত, মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে রেল ভ্রমণে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে, দ্বিতীয়ত সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করায় ওই কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত করে ক্ষমতার অপব্যবহার করা  হয়েছে, তৃতীয়ত তাকে কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে৷’’

তার কথা, ‘‘এই যে ক্ষমতার নানা দাপট এর মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা হচ্ছে৷ এখন রেলের ঘটনায় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে তো ক্ষমতার এই অপব্যবহার আরো বাড়বে৷ দায়িত্ব পালন করায় টিটিই'র তো পুরস্কৃত হওয়ার কথা ছিলো৷ হয়েছে উল্টোটা৷ এই সংস্কৃতি তো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বিষয়গুলো বিদায় করে দেবে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান