1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে ইউরোপ

১৯ জুলাই ২০১১

বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে এক আলাদা ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবস্থান করছেন রবীন্দ্রনাথ৷ সম্প্রতি ‘ভারতে সমাজ রূপায়নে সাহিত্যের শক্তি’ বিষয়ক আলোচনা সভায় সে কথাই বলছিলেন অন্যতম রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত৷

https://p.dw.com/p/11zB8
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তছবি: DW

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে ‘নোবেল পুরস্কার' লাভ করেন৷ আর সেই কাব্যগ্রন্থের সূত্রেই হয়তো বা যুক্তিবাদী ও বাস্তববাদী পশ্চিমা বিশ্ব কবির কবিতার মধ্যে এক অপার্থিব ভাবসম্পদের সন্ধান পেয়েছিল৷ রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যেই পেয়েছিল বস্তুবাদী জীবনের আড়ালে এক গভীর প্রশান্তি৷ ভুলে গেলে চলবে না, ইউরোপে তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে শুরু হয়েছে লোভ ও হিংসার দ্বন্দ্ব৷ সেই যুদ্ধমাতাল ইউরোপ রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছিল শান্তির দূত হিসেবে৷ অচিরেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনা ইউরোপের বহু মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছিল৷ তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল কবির মানবিক মূল্যবোধ, প্রেম ও কল্যাণ কামনা৷

কিন্তু আজ, এই সার্ধশতবর্ষে পৌঁছে পশ্চিমা বিশ্বের ক'জন মনে রেখেছে কবিগুরুকে৷ আজকের বিশ্বে, বিশেষ করে জার্মানিতে কতোটা প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ? জার্মানিতে দীর্ঘদিনের প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘প্রথম যখন উদ্দীপনার যুগটা শেষ হয়ে গেল, তখন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে আকর্ষণবোধ - সেটা ক্ষীয়মাণ হয়ে এলো৷ তার একটা কারণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের রচনা শুধু ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে অনুবাদ হচ্ছিল বলে, মূলের যে মাধুর্য-মায়া - সমস্তটাই অনুবাদে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল৷ তবে এখন যেটা হয়েছে, সেটার জন্য কিছুটা হলেও হাইডেলব্যার্গের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটকে দায়ী করতে হয়৷ তারা সরাসরি অনুবাদের ঘরানা চালু করেছে৷ তারাই নব্য ভারত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করে৷ সেখানে প্রথমেই কিন্তু আমরা রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকের কবিতা দিয়ে শুরু করি৷ তার নাম ‘স্প্যেটে ল্যিরিক'৷ অর্থাৎ, অন্ত-পর্যায়ের কবিতা৷''

হাইডেলব্যার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উদ্যমের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জার্মানিতে উৎসাহ বাড়ছে৷ এই পরিধির বাইরে শান্তিনিকেতনবাসী জার্মান লেখক ও অনুবাদক মার্টিন কেম্পশেনও মুল থেকে তাঁর অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে জার্মানিতে রবীন্দ্র পরিচিতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন৷ হাইডেলব্যার্গে একটি নতুন প্রকাশন সংস্থাও গড়ে উঠেছে, যাকে আজকে আর কেউ অগ্রাহ্য করতে পারছে না৷ এই প্রকাশনা সংস্থাটির নাম ‘দ্রৌপদী'৷ ক্রিস্টিয়ান ভাইস সংস্থাটির প্রধান৷ রবীন্দনাথ যেন আবারো ফিরতে শুরু করেছেন৷

রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, তিনি ছিলেন একাধারে সংগীতকার, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, সমাজ সংস্কারক, আরো কতো কী! তা পশ্চিমে রবীন্দ্রনাথের কোন পরিচয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জানান, ‘‘এখানে এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ একজন সংস্কারক, দার্শনিক এবং শিক্ষাগুরু হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ তার কারণ, এখানকার মানুষ কবি রবীন্দ্রনাথকে পায় নি তেমনভাবে৷ কবি রবীন্দ্রনাথকে পেতে হলে যে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পেতে হবে৷ আমি কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকিতে ডার্মস্টাট শহরে যাই৷ রবীন্দ্রনাথের দৌলতে এ শহরটি এক সময় ‘ধর্ম নগর' হিসেবে পরিচিত ছিল৷ সেখানকার ‘গটেসব্যার্গ'টা হয়েছিল ব্রহ্মব্যার্গ৷ যেখানে ‘কাইসারলিং'কে বলা হয়েছিল ক্ষত্রিয়৷ সেখানে গিয়ে আমি যখন স্থানীয়দের রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে শোনালাম, তারা বললো - ‘সেকি! উনি কবি ছিলেন? কাজেই, রবীন্দ্রনাথের কবি পরিচয়টা আমরা এখন প্রাণপণে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি৷''

কবি রবীন্দ্রনাথ না হলেও, সংগীতকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অবশ্য অনেক আগেই প্রত্যক্ষ করা গেছে পশ্চিমে৷ ব্রেষট'এর নাটকের সুরকার রবীন্দ্রনাথের গানের থেকে সুর নিয়েছেন, বলেন অলোকরঞ্জন৷ এমনকি, বিরহী প্রেমিক-অভিনেতা হান্স এফেনব্যার্গার অনুবাদ করেছিলেন ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী'৷ পরবর্তীতে এই গানটাই আলেকজান্ডার ফন সেমলিনস্কি পশ্চিমের স্বরলিপিতে ফেলে সুর দেন৷ সপ্তকের প্যাটার্নের বাইরে একেবারে অন্যরকম একটা সুর৷

তবে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবকেও একেবারে অস্বীকার করতে চাননা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত৷ তাঁর কথায়, ‘‘রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৬ সালে জার্মানিতে আসেন, তখন তিনি এখনে বসে নয়-দশটি গান লেখেন৷ তার মধ্যে কোনো কোনো গানে তিনি শুবার্টের সুর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ এছাড়া, কবিতার যে ‘ইমেজ' - সেই ইমেজগুলিতে তিনি একটি দৃপ্ত আধুনিকতা আনছিলেন এবং বার বার ভাবছিলেন সুরে কিভাবে একটা নতুনত্ব আনা যায়৷ যেমন ‘তুমি ঊষার সোনার বিন্দু, প্রাণের সিন্ধু তীরে...' - এই যে গানটা কোলোন শহরে লিখলেন, গানটায় সুর দিতে কিন্তু দম বেরিয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের৷ ঐ যে ‘তীরে...তুমি..' - এই টানটা শুবার্ট থেকে আসছে৷''

এভাবেই রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে পশ্চিমে৷ তিনি দিয়েছেন, নিয়েছেনও অনেক৷ আর তার ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের আজকের প্রসঙ্গিকতা, মনে করেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত৷

প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ

সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক