যে দেশে ভালোবাসায় ঘাটতি নেই
১৯ ডিসেম্বর ২০১৭মার্টিনার সঙ্গে দেখা ঢাকা বিমানবন্দরে৷ কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক বিমান ছাড়বে একটু পর৷ হঠাৎ করে এক ভিআইপির সঙ্গে আরো তিন-চারজন প্রবেশ করলেন ওয়েটিং রুমে৷ নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের চেক করার সাহস অবধি পেলেন না৷ এমন অবস্থা দেখে খানিকটা বিরক্ত হন মার্টিনা৷
বিরক্ত আমিও হয়েছিলাম৷ ভিআইপি হলেই কি তাঁরা নিরাপত্তার তল্লাশির আওতামুক্ত নাকি? এই নিয়ে বিরক্তির সূত্র ধরেই আসলে মার্টিনার সঙ্গে আলাপ হয়৷ ইউরোপের এই বাসিন্দা ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন কক্সবাজারে, উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটানো৷ আমি তাঁর কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম৷ একজন ইউরোপীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যেতে পারে এমনটা আমার ভাবনাতেও ছিল না৷
মার্টিনার সঙ্গে পরবর্তীতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও দেখা হয়েছিল৷ সবসময় শিশুরা ঘিরে রাখতো তাঁকে৷ আর তাতে তাঁর চেহারায় ভেসে উঠতো এক প্রশান্তির ছাপ৷ তবে মার্টিনা একা নন৷ কক্সবাজারে তাঁর মতো আরো কয়েকজন বিদেশির সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁরা নিজেদের অবসর সময়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন রোহিঙ্গাদের সেবা করতে৷ একদল জাপানিকে দেখেছি প্রতিদিন ঠিক আটটার সময় নিজেদের উন্নয়ন সংস্থার ইউনিফর্ম পরে হোটেল লবিতে জড়ো হতে৷ সেখান থেকে দলবেঁধে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যেতেন তাঁরা৷ সারাদিন কাটিয়ে ফিরতো সন্ধ্যার দিকে৷ তাঁদের চোখে কখনো ক্লান্তি দেখেনি, বরং বিপদে পড়া মানুষদের জন্য কিছু একটা করতে পারার আনন্দ দেখেছি তাঁদের মধ্যে৷
আর শুধু বিদেশিদের কথা বলছি কেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া দেশি মানুষের সংখ্যাও কি কম নাকি! সেনাবাহিনীর ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে ট্রাকভর্তি খাবার, ঔষুধ আর পোশাক নিয়ে হাজির হতে দেখেছি অনেক সাধারণ মানুষকে৷ কেউ কেউ নিরবে এসে নগদ টাকা ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করেছেন৷ তাঁদের সেই টাকা বৈধ কিনা জানিনা, তবে খরচটা মহৎ উদ্দেশ্যেই করেছেন৷
গত কয়েক মাসে ছয়লাখের বেশি রোহিঙ্গা আসায় এমনকি ঢাকা শহরেও নাকি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে৷ সীমান্ত এলাকার মানুষদের তো এই নিয়ে ক্ষোভেরও শেষ নেই৷ তাসত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের প্রতি ভালোবাসায় তাঁদের কোনো কমতি নেই৷ বরং তাঁদের কষ্টের কথা বোঝেন স্থানীয় বাঙালিরা৷ অনেকে সীমান্তের এপাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারে রোহিঙ্গাগ্রামে আগুন জ্বলতে দেখেছেন, শুনেছেন মানুষের আর্তনাদ৷ তাই কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে স্থানীয় মানুষদের রোহিঙ্গাদের প্রতি ভালোবাসায় ঘাটতি দেখা যায় না৷
রোহিঙ্গাদের প্রতি দেশি-বিদেশি মানুষদের ভালোবাসা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, মাঝে কয়েকদিন শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখতে হয়েছিল৷ কেননা, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ত্রাণ পৌঁছে গিয়েছিল রোহিঙ্গাদের ঘরে৷ আর সেগুলো ব্যবহার না করে জমা করায় খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল৷ ফলে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখা হয় যাতে রোহিঙ্গারা ঘরে জমানো খাবার আগে শেষ করেন৷
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে হয়ত গণমাধ্যমের নজর রোহিঙ্গাদের উপর থেকে সরে যাবে৷ তখন তাঁদের দিকে যে ত্রাণের জোয়ার চলছে তাতে ভাটা পড়বে৷ চাপ বাড়বে বাংলাদেশ সরকারের উপর৷ আমার অবশ্য তা মনে হয় না৷ বরং রোহিঙ্গাদের আগামী কয়েকবছর চালিয়ে নেয়ার মতো রসদ দেশি-বিদেশি দাতারা নিশ্চিতভাবেই দেবে৷ অন্তত রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁদের টান দেখে তাই মনে হয়৷
ব্লগপোস্টটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷