1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যে জীবন ‘কামলার’ ঈদের সাথে তার হয় নাকো দেখা

২৩ জুন ২০২৩

ঈদ মানে আনন্দ। আজ ঈদ, মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ- আমরা যারা ‘শিক্ষিত' জনগণ তারা এই শিক্ষা নিয়েই বড় হয়েছি। ধনী-গরিব নির্বিশেষে এটাই জানি।

https://p.dw.com/p/4SzsV
Bangladesch Dhaka - Frauen nutzen Bus
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman

তুমুল আনন্দ করতে হবে। চাকুরিজীবীরা বোনাস পাবেন, ব্যবসায়ীরা বেতন দেবেন লাভের টাকা ঘরে তুলবেন। ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়ি ফিরবে নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে।– এই তো অল্প কথায় ঈদের গল্প।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হওয়াতে ঈদের সালাম, ঈদের নামাজের জামাত, কোরবানি ডান- সব কিছুই জেনে যাওয়া যায়। তবে আদৌ কি জানি এই ঘরের প্রতিটি মানুষের জন্য ঈদ এসেছে? অদ্ভূত প্রশ্ন না? ঈদের আনন্দের মধ্যে এ কোন পানি-ঢালা প্রচেষ্টা। আচ্ছা, আপনার বাড়ির প্রধান নারী সদস্যের ঈদ মানে কতটা আনন্দ কখনো ভেবে দেখেছেন? বাড়ি ফেরা আপনাদের জন্য শত পদ রান্না করতে তিনি কখনো ক্লান্ত হন না? ঘর গোছানো, ঈদের আয়োজন আপ্যায়ন করতে করতে ক্লান্তিতে কখন রান্নাঘরেই বসে ঘুমিয়ে গেছেন দেখেছেন কি?

আমার নানীকে দেখেছি, মাকে দেখেছি এরপর এখন নিজেকে দেখি। বাড়িতে সবার একত্র হওয়ার অসাধারণ আনন্দ রয়েছে, কিন্তু প্রায় মাঝরাত অবধি ভাত বেড়ে দেওয়া, পরের দিন সকালের খাবারের যোগাড় করে রাখার ক্লান্তি তার থেকেও শতগুণ বেশি। তার ওপর আছে ঈদ উপলক্ষে তৈরি করা শতপদ। হ্যাঁ বাড়ির সকলেই সাহায্য করেন। মেয়েরা সারাক্ষণ কাজে সহায়তা করেন মা কিংবা শ্বাশুড়িকে। কিন্তু সেই গল্পটা ঘুরে-ফিরে একই হয়। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এই মানুষগুলোর ঈদ দেখা হয় না।

রোজার ঈদে তো রান্না ও আপ্যায়নে কাজ শেষ হলেও ঈদ-উল-আজহায় কাজের সীমা-পরিসীমা থাকে না। পশু কাটাকাটিতে ব্যস্ত পুরুষ দলকে খাবার দাও, তাদের ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা দাও। কোরবানির গোশত চুলায় দাও। এরপর সবাইকে খাইয়ে ভাগ করতে বসো। যদি বাড়ির ছেলেরা ভাগের কাজটা করে দেন, তবে পড়ে থাকে নিজেদের ভাগের গোশত সংরক্ষণের কাজটা। আজকাল বাড়িতে বাড়িতে ফ্রিজ হয়ে এই কাজ অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু স্মৃতি প্রতারণা না করলে যতটা মনে পড়ে আমার নানী জ্বাল দিয়ে রাখতেন মাংস। সকালে দেখতাম, জ্বাল দেওয়া মাংসের ওপর থেকে চর্বি কাটা হচ্ছে। শুধু কী মাংস, মাথার মাংস, পায়া, কলিজা, গুর্দা, ভূড়ি সব আলাদা আলাদা করে সংরক্ষণের কাজ চলতো। বাড়ির পুরুষেরা খাবেন বলে কথা। মেয়েরা খেতেন না- বিষয়টা এমন না। তবে এইসব সংরক্ষণের বিষয়টা পুরোটাই কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ঈদ করতে আসা ছেলে-মেয়ে নাতি, নাতনীদের জন্য ছিলো। আমার নানী সংরক্ষণ সহজ করতে শুঁটকি করে ফেলতেন। তবে যেসব এলাকায় শুঁটকির প্রচলন নেই, তাদের জন্য সংরক্ষণে মনোযোগ দিতে গিয়ে নিজের বিশ্রাম তো ব্যাহত হতোই সঙ্গে সংসারের অন্য কাজেও বেশ প্রভাব পড়তো।

এখন ফ্রিজে ঢুকিয়ে দায় সারলেও পরিবারের সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী নানা পদ করতে গিয়ে কম বেশি সবাই হিমশিম খান।

জাহানারা ইমামের ‘অন্য জীবন' বইটি থেকে জেনেছিলাম, তাদের ছেলেবেলায় ঈদের আগের রাত থেকে মা-চাচী, নানী-দাদীরা রুটি বানাতে বসতেন। রসুনের খোসার মতো পাতলা গোল রুটি নাকি বানাতেন তারা। সেই রুটি বানানোর আগে গভীর রাতে গোসল করে আসতে হতো বাড়ির পুকুর থেকে। একেক বাড়িতে তিন থেকে ৪০০ রুটি বানানো হতো। সেই রুটি দিয়েই ঈদের দিনের আপ্যায়ন চলতো।

অর্থাৎ ঈদের দিনে মেয়েদের কাজের অভাব কোনোকালেই ছিল না। চালের আটার রুটির ঐতিহ্য অনেক গ্রামে কম থাকলেও চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে মহা উৎসাহের সঙ্গে ধরে রাখা হয়েছে। একেকটি বাড়িতে রুটি বানানো বা হালে অর্ডার দেওয়ার ধুম পড়ে যায়। অর্ডার শব্দটি শুনে বেশ একগাল হেসে নিয়ে ভাববেন না যে- বাড়িতে তো বানাতে হচ্ছে না। হোম কুকদের অনলাইন অর্ডারের কথা বলছিলাম আর কী। এর পেছনেও নারীরাই শ্রম দিয়ে যাচ্ছে।

 এরপর আছে কোয়াবের মাংস। বিশেষ পদ্ধতিতে মাংসের চর্বিতে মাংস সংরক্ষণ করে তৈরি হয় কোয়াবের মাংস। এই কাজটি বাড়ির গুরুত্বপুর্ণ নারী সদস্যকেই করতে হয়। আপনি একজন চট্টগ্রামের বাসিন্দাকে ‘ঈদ কেমন কেটেছে' প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর করতে পারেন- এখনো কোয়াবের মাংস খাইনি, ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে না। এটা ঈদের ৫-৭ দিন পরে প্রসেস হয় খাওয়ার জন্য। এই পাঁচ সাত দিন সযতনে ঈদের তাবত আপ্যায়নের সঙ্গে এই রান্নাতেও সমান মনোযোগ দিতে হয় একজন গৃহিনীকে। হোক তিনি চাকুরিজীবী নতুবা শুধুই গৃহিনী।

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন নাজলা৷ছবি: privat

পুরান ঢাকাতেও এই পদ্ধতিতেই মাংস সংরক্ষণ করা হতো। আর পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে কোফতা না হলে নাকি ঈদই হতো না। হেকিম হাবিবুর রহমান তার রচিত ‘ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে' বইটিতে লিখেছেন- প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে কোফতা তৈরি হতো। মটরদানা সাইজের কোফতা থেকে দুই সেরি কোফতা। আর এই আয়োজনটুকু নিঃসন্দেহে বাড়ির নারীরাই করে আসছেন। হালে বারবিকউয়ের স্টিক হাতে ছেলেরা বসলেও এরসঙ্গে খাওয়ার ১০৯টা পদ একজন মা, বোন কিংবা স্ত্রীর জন্যই বরাদ্দ।

আমি ব্যক্তি জীবনে ১০টির বেশি ঈদ সৌদি আরবে কাটিয়েছি। সেখানে ঈদ মানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। সামর্থ অনুযায়ী চকোলেট, বাদাম, মিষ্টি বিতরণ করা। আমাদের দেশে যেমন সালামি দেওয়া হয় সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সবার হাতে চকোলেট, মিষ্টি, বাদাম গুজে দেওয়া হয়।

নামাজ শেষে সবাই বাড়ি ফিরে যায়। আপ্যায়নেও শুকনা খাবার দেওয়া হয়। সব বাড়িতেই রান্নার বিশেষ আয়োজন দেখেছি। তবে বড় আয়োজনগুলোতে পুরুষ সদস্যদের অগ্রণি ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। ঈদের রাত গুলোতে খোলা ময়দানে, সাগর পাড়ে অনেক মানুষ সমবেত হন, নারীদের আড্ডায় বসিয়ে পুরুষরা বার্বিকিউ করেন। বাচ্চাদেরও সামলাতে দেখেছি আধুনিক সৌদি পুরুষদের। আমার বেদুঈন দেখার সুযোগ হয়নি। তারা কীভাবে ঈদ পালন করে সেই অংশটা একেবারেই অজানা।

আর কোরবানি ঈদে আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য স্লটার হাউজকেই বেছে নিয়েছে। সেখানেই কোরবানি হয়, ভাগের মাংস প্যাক হয়ে বাড়ি চলে আসে। এখন বাংলাদেশে যেটা সল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। তবে বাঙালি পুরুষরা সব সময় দুই কাঠি ওপরে। ঈদের দিন বাড়ির গ্যারেজে কোরবানি দিয়ে মাংস কেটে রক্ত পানি ছড়িয়ে অনেককে গ্রেফতার হতে দেখেছি। পরে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাড়িতে কোরবানি দেওয়ার অনুমতি একদমই নেই। তবু বাংলাদেশি পুরুষের মন বলে কথা, মাংস নিজের হাতে না কাটলে ঈদ ঈদ লাগে না।  

এই যে আপনাদের শত আবদারের কারণে বাড়ির একজন সদস্যের কোনোদিন ঈদ আসলো না এটা কখনো ভেবেছেন? অনেকে বাপের বাড়ি যেতে চায়, ভাই-বোনদের সঙ্গে ঈদ করতে সেই সুযোগ হয় না। গৃহিনী হলে তো কোনো ছুটিই নেই। আর কর্মজীবী হলে কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি পাবেন কিন্তু গৃহ থেকে ছুটি মিলবে না।

গত কয়েকদিনে ভারতীয় বাঙালি অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জির একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তার বক্তব্যে তিনি বলেন ‘‘নারী স্বাধীনতা আমরা একটা ব্র্যাকেটে ফেলে দিয়েছি। আমাদের অনেকের ধারণা বাড়িতে থাকলে তুমি অকর্মের ঢেঁকি, বাইরে বের হয়ে কিছু করলে তুমি স্মার্ট, এডুকেটেড। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আর সেমিনার ডিবেট হয়, কই কোথাও তো গৃহবঁধুদের ডাকা হয় না।'' তার বক্তব্যে তিনি নারী স্বাধীনতার ঘর-বাহিরের দ্বন্দ্ব নিয়ে বলেছেন- কিন্তু এইসব সব নারীদেরই ঈদে-পূজায় বা যেকোনো উৎসবে গৃহবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিতে হয়। বাঙালি পুরুষের রসনা তৃপ্তের মহান দায়িত্ব কী করে এড়াবেন তারা। নইলে যে বাড়ির সেরা মা, স্ত্রী বা বোনের চরিত্রের পুরস্কারটা মিস করবেন তারা।

ঈদ মানে তো আনন্দ, একবার ভাগ করে নিলে বোধহয় খারাপ লাগবে না। দেখবেন নাকি প্রিয় পুরুষেরা। কাজটা ভাগ করে নিয়ে। একেবারে নাকাল না করে ফেলি। রসুনের খোসার মতো পাতলা সুগোল রুটি নাইবা খেলাম এক ঈদে। কিন্তু আমার মা পাত পেড়ে আমাদের সঙ্গে খাচ্ছেন, আপনারা হাতে হাতে কাজ গুছিয়ে দিচ্ছেন- দৃশ্যটা মন্দ হবে না কিন্তু। তাদের জীবনটা ‘কামলা' শব্দটার মধ্যে আটকে না থাকুক। ঈদের সঙ্গে দেখা হোক আমাদের সবার।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য