1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

মূল্যস্ফীতি থেকে মন্দা: বিশ্ব ও বাংলাদেশ

৭ অক্টোবর ২০২২

দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এ বছরের শুরু থেকেই একের পর এক সুদের হার বাড়িয়ে চলেছে৷ চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বিশ্বের বড় দেশগুলোতে নীতি সুদের হার দুই থেকে চারগুণ বাড়ানো হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4Hu1X
Bangladesch Chittagong Port
ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ মার্চ মাস থেকে দফায় দফায় সুদহার বাড়িয়েছে৷ ফলে এই হার শূন্য থেকে এখন ৩ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে৷ মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ যা ছিল ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসের পর সর্বোচ্চ৷ একইভাবে ব্যাংক অব কানাডা, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি), রিজার্ভ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিসুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছে৷ গড়পরতা হিসেবে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এদের প্রায় সবারই নীতি সুদহার ছিল শূন্য থেকে এক শতাংশের মধ্যে৷ সেপ্টেম্বরের শেষে এসে বেশিরভাগেরই সুদহার দুই শতাংশের ওপরে চলে গেছে৷ যুক্তরাষ্ট্র  ও কানাডায় তা তিন শতাংশ ছাড়িয়েছে৷

মুদ্রানীতির প্রধান হাতিয়ার হলো নীতি সুদের হার যা বাড়ানো হলে বাজারে মুদ্রার সরবারহ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে ধরে নেয়া হয়৷ আর এই মুদ্রার বা টাকার জোগান কমলে তা সামষ্টিক চাহিদা কিছুটা কমিয়ে দেয়৷ এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিও কমে আসে৷ এটাই হলো অর্থনীতির তত্ত্ব৷ সে কারণেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে সুদহার বাড়ানোর পথে হাঁটা একটি চর্চিত বিষয়৷ উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের মতো অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ বছর বিভিন্ন সময়ে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে৷

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে, প্রধানত খাদ্য ও জ্বালানির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির আগুন ছড়িয়ে  দিয়েছে ৷

২০২১ সালের শুরু থেকেই মূল্যবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে যা এরপর টানা ১৮ মাস ধরে অব্যাহত আছে৷ আর এই সময়কালে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যতোখানি বেড়েছে, তা এর আগের পাঁচ বছরেও বাড়েনি৷

এখন দেখা যাচ্ছে, ক্রমাগত সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি প্রশমণ করার লড়াইটা বিশ্বকে মন্দার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে৷ সহজভাবে বললে, সুদহার বাড়ার ফলে ঋণ ও অর্থায়নকে ব্যয়বহুল করেছে যা আবার উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে৷ এতে মোট উৎপাদন কমে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে৷

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) প্রকাশ করেছে বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২২৷ তাতে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলো যেভাবে তাদের মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি পরিচালনা করছে, তা বিশ্বকে একটি মন্দার দিকে ঠেলে দেয়ারও অর্থনৈতিক বদ্ধাবস্থা (স্ট্যাগফ্লেশন) দীর্ঘায়িত করার ঝুঁকি তৈরি করেছে৷

এর ফলে যে ক্ষতি হবে তার মাত্রা ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ জনিত আঘাতের চেয়ে বেশি হতে পারে৷ আঙ্কটাড মনে করে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর (চীন বাদে) ভবিষ্যত আয় ৩৬০ বিলিয়ন ডলার পরযন্ত কমে যেতে পারে৷

সাধারণত কোনো দেশে টানা ছয় মাস বা পর পর দুই প্রান্তিক মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) কমে গেল বা প্রবৃদ্ধির বদলে সংকোচন দেখা দিলে সেই দেশটি মন্দাক্রান্ত হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়৷

আঙ্কটাডের এই প্রতিবেদন প্রকাশের আরো প্রায় তিন সপ্তাহ আগে বিশ্বব্যাংক ‘ইজ গ্লোবাল রিসেশন এমিনেন্ট' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে ২০২৩ সালে পৃথিবী মন্দার মধ্যে পড়বে৷

পাশাপাশি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা দিতে পারে আর্থিক সংকট৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি এখন শ্লথ হয়ে এসেছে ৷ এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর মাধ্যমে সৃষ্ট যুদ্ধ ও এর জের ধরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যের ওপর৷ ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে গেছে৷ আবার বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাও বিঘ্নিত হয়েছে৷

খোদ বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন চিন্তিত হয়ে পড়েছে এজন্য যে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, বরং মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে৷ বুন্দেসব্যাংক বা জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০২৩ সালে জার্মানি শুধু উচ্চমূল্যস্ফীতিই মোকাবিলা করবে না, একই সাথে মন্দাক্রান্ত হবে৷

বাংলাদেশ পরিস্থিতি

এরকম একটা প্রতিকূল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে তা বলাই বাহুল্য৷ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের  প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে৷ মূল্যস্ফীতির হার এতোটাই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এখন পরযন্ত ( অক্টোবর ৫, ২০২২) আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির উপাত্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি৷ তবে পরিকল্পনা মন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে পরিসংখ্যান উল্লেখ না করে এটা স্বীকার করেছেন যে আগস্টের মূল্যস্ফীতির হার চড়া ছিল, যা সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমেছে৷

মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর হার (ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে হারে টাকা ঋণ নেয়) ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করেছে যা অক্টোবরের প্রথম দিন থেকে কারযকর হয়েছে৷ এর আগে এ বছর মে ও জুন মাসে দুই দফায় একই মাত্রায় রেপোর হার বাড়ানো হয়েছিল৷

তবে সামান্য মাত্রায় রেপোর হার বাড়ানো হলেও তা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়৷ আর এই নীতি সুদহার বাড়লেও বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহার  যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে৷ তার মানে হলো, মুদ্রাবাজারে এক ধরণের বিকৃতি আরোপ করা হয়েছে যা মুদ্রানীতির সুফল বয়ে আনা দুরূহ করে তুলেছে৷

এখন প্রশ্ন হলো, ক্রমাগত সুদহার বাড়ানোর ফলে উন্নত দেশগুলোতে যে মন্দার আভাস মিলছে, বাংলাদেশে একইরকম কিছু হতে পারে কিনা বিশেষত যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে সুদহার বাড়ানোর পথে হাঁটেনি৷ উত্তরটা খুঁজতে অর্থনীতির আরো কয়েকটি সূচকের দিকে তাকাতে হবে৷  

প্রথমত, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ডলার যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৪২৯ কোটি ডলার৷ আবার সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স)  কমেছে ১০ শতাংশ৷ মূলত জুলাই থেকেই এটি কমা শুরু হয়েছে৷ একইভাবে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ যদিও প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক আছে৷ 

আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিক
আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিকছবি: Privat

দ্বিতীয়ত,বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বড় ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে৷ টাকার বিপরীতে ডলারের দর হু হু করে বেড়ে গেছে গত কয়েক মাসে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত বিনিময় হার ডলার প্রতি ১০৫ টাকা হলেও বাস্তবে ব্যাংকে তা ১১০ টাকার ওপরে তিন মাস আগেও যা ১০০ টাকার নিচে ছিল৷ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে৷ জুন শেষে যেখানে এটি ছিল প্রায় চার হাজার ২০০ কোটি ডলার তা সেপ্টেম্বর শেষে নেমে এসেছে তিন হাজার ৬০০ কোটি ডলারে৷ মানে সাড়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ কমে হয়েছে পাঁচ মাসের ব্যয় মেটানোর মতো৷

দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে দুর্বলতা স্পষ্ট যা আগামী দিনগুলোয় আরো দুর্বল হওয়ার আশংকা আছে৷ আবার বিকল্প একাধিক সূচক থেকে এটা বোঝা যায় যে দেশের  ভেতর চাহিদা ও উৎপাদন পরিস্থিতি যথেষ্ট তেজী নয়৷ যেমন: বেসরকারি ঋণ প্রবাহের গতি শ্লথ, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী শিল্পপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার হার কমে গেছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে, নামিক মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হওয়ায় প্রকৃত মজুরি তথা শ্রমজীবীদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে৷

এসব কিছুর ভিত্তিতে অবশ্য এখনই এটা বলা যাচ্ছে না যে বাংলাদেশও আগামী বছর মন্দাক্রান্ত হতে পারে৷ তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ বাংলাদেশ যে সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এরকম আভাস রয়েছে৷ বিশ্ব পণ্য ও জ্বালানির বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে খাদ্যশস্য ও জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে৷ দাম বেড়েছে সারের৷ সার ও তেলের দাম বাড়ায় তা খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও আশংকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷

সর্বোপরি, উন্নত দেশগুলো মন্দাক্রান্ত হলে সেখানে সামষ্টিক চাহিদা কমবে যার প্রভাবে বাংলাদেশের রপ্তানিও কমবে, কমবে রেমিট্যাান্স৷ ফলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেকটাই ব্যাহত হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান