1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মিশর জলবায়ু সম্মেলন কি আমাদের কথা শুনবে?

পাভেল পার্থ
১১ নভেম্বর ২০২২

পদ্মা-গঙ্গা নদীপ্রণালীর গুরুত্বপূর্ণ এক নদী খোলপেটুয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে সাতক্ষীরা ও খুলনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4JNI3
জলবায়ু সম্মেলনে এক বিক্ষোভকারী
মিশরে জলবায়ু সম্মেলনে এক বিক্ষোভকারীকে দেখা যাচ্ছেছবি: Mohamed Abd El Ghany/REUTERS

প্রায় ৫৬ কি.মি. দীর্ঘ এ নদীর পরিচিতি নম্বর-২৩ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড৷ খোলপেটুয়া, চুনা, মালঞ্চ, রায়মঙ্গল, বেতনা, যমুনা, মরিচাপ, চুনকুড়ির মতো ৯৮ টি নদীই মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলের জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণ করে৷ নদীর তিরে বাঁধ দিয়ে বসতি গড়ে মানুষ৷ প্রবল জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে ভঙ্গুর বাঁধ চুরমার হয়ে যায়৷ ডুবে ভেসে তলিয়ে যায় জীবন ও জনপদ৷ দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন বারবার নিজের জীবন দিয়ে জোয়ার ও ঘূর্ণি থেকে জনপদকে সুরক্ষা দেয়৷ কিন্তু উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আর জোয়ারের গণিত কোনো ধারাপাত মানছে না৷ বছর বছর বদলে যাচ্ছে জোয়ার-ভাটার ধরন৷ ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য, সংখ্যা ও স্থায়িত্বকাল বাড়ছে৷ একটা লম্বা সময় নিয়ে টানা বাতাস ও বৃষ্টি বইছে এখন ঘূর্ণিঝড়ের সময়৷ লবনপানি ক্রমশ এগিয়ে আসছে উপকূল থেকে দেশের মধ্যভাগে৷ তীব্র লবণাক্ততায় ধুঁকছে মাটি, মানুষ, মাছ কী মুরগির সংসার৷ অপরদিকে অনাবৃষ্টি আর তাপে পুড়ছে দেশের উত্তরাঞ্চল৷ তীব্রতাপদাহ আর পানিহীনতা বিষণ্ন করে তুলছে বরেন্দ্রভূমির জীবনযাত্রা৷ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হাওরভাটিতে বাড়ছে পাহাড়ি ঢল৷ জমিন বোঝাই পুষ্ট দানা নিয়ে ডুবছে ভাটির গ্রাম, বালির তলায় নিখোঁজ হচ্ছে বসত৷ ২০২২ সনের বন্যায় সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ আর সিলেটের ৬০ ভাগ তলিয়ে গিয়েছিল৷ জলবায়ুর উল্টাপাল্টা আচরণ আন্দাজ করতে পারছেন না গ্রামীণ নিম্নবর্গ৷ ৫০ বছর আগেও মেঘ, বাতাস, পতঙ্গ, প্রাণীর আচরণ ও নির্দেশনা থেকে বিপদ-আপদের একটা ধারণা পেত মানুষ৷ কিংবা খনার বচন বা মান্দি আগানমিয়াফা থেকে আবহাওয়ার একটা পুর্বাভাস পাঠ করা যেত৷ কিন্তু বছর বছর এই ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে৷ দেশের উপকূল ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা, উত্তরাঞ্চল খরা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল পাহাড়ি ঢল, মধ্যাঞ্চল বন্যা এবং পূর্বাঞ্চল পাহাড় ধসের এক নিদারুণ যন্ত্রণার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিদিন৷ কেবল গ্রামীণ উৎপাদন ও খাদ্যব্যবস্থা নয়; ভেঙে পড়ছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুমুখী সম্পর্ক৷ আবহাওয়ার উল্টাপাল্টা আচরণ কৃষিসহ প্রকৃতিনির্ভর প্রতিটি পেশায় দুঃসহ সংকট তৈরি করছে৷ মানুষ গ্রামে থাকতে পারছে না৷ জন্মমাটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে৷ ছোট-বড় শহরে প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল৷ পুরুষের গন্তব্য হচ্ছে ইটেরভাটা, রিকশা চালানো বা দিনমজুরিতে৷ নারীর গন্তব্য হচ্ছে গৃহকর্মী বা করেপারেট গার্মেন্টস কারখানায়৷ আর শিশুদের গন্তব্য হচ্ছে প্লাস্টিক, ব্যাটারি ভাঙ্গা, বর্জ্য কুড়ানো কিংবা রাসায়নিক কারখানার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে৷ বিস্ময়করভাবে জলবায়ু-উদ্বাস্তু এই মানুষদের কেউ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেনি৷ বছরে এদের খুব কম পরিবারেই খাবারের পাতে মাংস জোটে৷ এক বিঘত বিলাসিতা নাই জীবনে৷ গ্রীণ হাউস গ্যাস আর কার্বণ নির্গমণের জন্য এরা দায়ী না৷ কিন্তু এই নির্গমণই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াছে, জলবায়ুর আচরণ বিগড়ে দিচ্ছে৷ বাঁচার জন্য লড়ছে মানুষ, আবার নিরুদ্দেশও হচ্ছে বহুজন৷ ‘এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস ফোরাম’ এ প্রতিবেদনে জানাচ্ছে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ২০০০ মানুষ স্থানান্তর করে৷ গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৬) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে৷ জলবায়ু নিয়ে ধনী দেশ ও করপোরেট এজেন্সিগুলো আজ যে নির্দয় জুয়া খেলা মাতিয়ে রেখেছে তা বন্ধ হওয়া দরকার৷ একই পৃথিবীতে কেউ ঘন্টায় ঘন্টায় বার্গার গিলে কার্বণ নিঃসরণ বাড়াচ্ছে, আর এ কারণে লবনপানিতে তলিয়ে যাচ্ছে অন্য কারো সংসার৷ একই দুনিয়ায় বিক্রি হচ্ছে ‘অ্যাকোয়া ডি ক্রিস্টালো টিবেটোর’ মতো চল্লিশ লাখ টাকার পানির বোতল, আবার শহরের বস্তিতে এক কলস পানির জন্য লাইন দিতে হচ্ছে ৩৬৫ দিন৷ মানুষের দশাসই কার্বন দূষণে পৃথিবী আজ মুমূর্ষু৷ এখনো উত্তর-দক্ষিণ বিবাদ, কাঠামোগত বৈষম্য আর নিদারুণ দ্বন্দ্ব থামছে না৷ চিন, মার্কিন না রাশিয়া কী ভারত কে হবে অধিপতি এই দরবার প্রতি মুহূর্তে বিদীর্ণ করছে পৃথিবীর শরীর৷ রক্তাক্ত করছে ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক বিবর্তন৷ সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া বেঁচে থাকবার জন্য আর কোনো গ্রহ আছে কীনা এখনো আমাদের জানা নেই৷ আমাদের সকল ইতিহাস, নীতি, বিশ্বাস, উৎপাদন ও সংস্কৃতি এই একমাত্র ছোট্ট নীল গ্রহকে ঘিরেই৷ প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার স্বার্থেই, আমাদের প্রিয় এই গ্রহকে আগলে আমাদের দাঁড়ানো জরুরি৷ নিজের দায়দায়িত্ব প্রমাণ করে, সবার সাথে, একসাথে, জোরালো ভঙ্গিতে, দুর্নিবার৷ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটিমাত্র পৃথিবীকে বাঁচাতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় জলবায়ু সম্মেলন বা কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ)৷ জলবায়ু সম্মেলনের ২৭ তম আসরটি ৬-১৮ নভেম্বর ২০২২ চলছে মিশরের পর্যটননগরী শারম-আল-শাইখে৷ ইউএনএফসিসির ১৯৪টি সদস্যের ভেতর ১৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিলেও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও মেক্সিকোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এখনো চলতি সম্মেলনে অংশ নেননি৷ তাহলে কীভাবে পৃথিবী বাঁচানোর ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব? প্রভাবশালী ধনী রাষ্ট্র ও অধিক কার্র্বণ নির্গমণকারী দেশগুলোর সক্রিয়, ন্যায্য ও সংবেদনশীল অংশগ্রহণ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা কী সম্ভব? তবে এই গল্প এখানেই শেষ নয়৷ জলবায়ু বিপন্ন এক পৃথিবীর মুমূর্ষু দক্ষিণপ্রান্তে বাঁচার জন্য লড়ছে মানুষ৷ দুনিয়ার নানাপ্রান্তে জলবায়ু-ন্যায্যতার দাবিতে জোরালো হচ্ছে প্রতিবাদী মঞ্চ৷ ক্ষমতা কাঠামো, করপোরেট, বিশ্বনেতৃত্ব এবং নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে আজ পৃথিবীর আর্তনাদ ও আওয়াজ শুনতে হবে৷ দায়িত্বশীল হতে হবে৷ বাংলাদেশ আশা করে মিসর জলবায়ু সম্মেলন পৃথিবীব্যাপি ঘুমন্ত ও জেগে থাকা জলবায়ু-জিজ্ঞসাগুলোকে জানাবোঝার মতো মর্যাদার ক্ষেত্র উন্মুক্ত করবে৷ জলবায়ুর চলতি ২৭ তম আসর দুনিয়াকে বেঁচে থাকার এক নতুন বার্তা দিবে এই আওয়াজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জলবায়ু-দুর্গত বাংলাদেশের গ্রাম-শহরের নিম্নবর্গ৷ চলতি আলাপখানি দেশের নানা কৃষিপ্রতিবেশে জেগে থাকা এমন কিছু জলবায়ু-জিজ্ঞাসাকে মিসর জলবায়ু সম্মেলনের কাছে হাজির করছে৷

জলবায়ুর অর্থ: অগ্রাধিকার প্রকল্প তাহলে কোনগুলো?

জলবায়ু-স্থানান্তর: আর ‘গোলবেইদে’ হইতে চাই না

সাতক্ষীরা শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়নে খোলপেটুয়া নদীর ধারের এক কৃষিজীবী গ্রাম বড়কূপট৷ উপকূলের কারণে মানুষ মাছ-কাঁকড়াও ধরে, আবার কিছু মানুষ বন-বাদা থেকে মধু-গোলপাতাও সংগ্রহ করে৷ গ্রামের সায়রা বিবি ও মোহাব্বত গাজীর তিন ছেলে৷ ১৯৮৮ সনের জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় তাদের সব তলিয়ে যায়৷ গ্রামে তখন দু'ধরনের ঘর ছিল৷ কিছুটা স্বচ্ছলদের কাঠ ও গোলপাতার ঘর আর গরিবের ছিল মাটি-গরাণের ছিটে ও খড়ের ছাওয়া ঘর৷ এখনকার মতো ঝড়ের পূর্বাভাস জানানোর কোনো যুতসই ব্যবস্থা তখন ছিল না৷ গ্রামে দু'টি বাড়িতে রেডিও ছিল৷ ১০ নং বিপদসংকেত দেয়া হয়েছিল৷ একটানা ফিসফিস বৃষ্টি শুরু হয়৷ কেমির বাতি (কেরোসিন) নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে গ্রাম৷ রাতে আঘাত হানে জলোচ্ছ¡াস৷ ঘুমের মাঝেই কাঁথা-বালিশসহ তলিয়ে যায় বহু জীবন৷ যারা বেঁচেছিল তাদের একজন সায়রা ও মোহাব্বতের ছেলে আশরাফ আলী৷ ঝড়ের পর নোনা জলকাদা ঘেঁটে যা জুটেছিল তা পোটলায় বেঁধে বহু মানুষের সাথে গ্রাম ছাড়ের আশরাফ আলীর পরিবার৷ এভাবে একসাথে অনেক মানুষের কোথাও স্থানান্তরকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘গোলবেইদে’৷ মানে বেদে-মাংতাদের মতো ভ্রাম্যমাণ যাতায়াত৷ গ্রামহারা এই মানুষেরা শ্যামনগর থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত একসাথে আসেন৷ তারপর কে কোথায় হারিয়ে যান আর জানা হয়নি৷ কেউ যশোর, কেউ খুলনা, কেউ নাভারণ কেউ আবার আরো উত্তরে চলে যান৷ আশরাফ আলীদের আশ্রয় হয় সাতক্ষীরার আতির বাগান বস্তিতে৷ বাদাম বিক্রি করে এখন সংসার চলে আশরাফ আলীর পাঁচ সদস্যের পরিবারের৷ আতিরবাগান বস্তিতে পানির খুব কষ্ট, বর্ষাকালে আবার জলাবদ্ধ হয়ে থাকে৷ ১৯৯১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রায় একশটি দুর্যোগ সইতে হয়েছে বাংলাদেশকে৷ এখন ঘূর্ণিঝড়ে আশরাফ আলীদের বসতভিটা তলিয়ে যায় না, কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কয়েকটাদিন টানা বৃষ্টি-বাতাসের কারণে কাজ বন্ধ থাকে৷ প্রায় না খেয়েই থাকতে হয় তখন৷ সম্প্রতি ২০২২ সনের ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে দুই দিন কাজ বন্ধ ছিল তার৷ এছাড়া বাঁশ, দড়ি ও প্লাস্টিক কিনে ঘর মেরামতে বাড়তি দুই হাজার খরচ হয়৷ কেবল আশরাফ আলী নয়; উপকূল থেকে প্রতিদিন জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের ভিড় বাড়ছে নগরের বস্তিতে৷ জাতীয় বস্তি শুমারি (২০১৪) সূত্রমতে, দেশে প্রায় ১৩ হাজার ৯৩৫টি বস্তি আছে৷ সর্বশেষ জনশুমারিতে দেশে বস্তিতে থাকা মানুষের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ ৪৮৬ জন এবং ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন৷ এদের গরিষ্ঠভাগই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, তাপদাহ ও নদীভাঙ্গনের কারণে গ্রাম ছেড়ে বস্তিতে এসেছেন৷ টানা করোনা মহামারী আশরাফ আলীর জীবনকে আরো দুঃসহ করে তুলেছে, একইসাথে বাড়ছে জলবায়ু সংকটের নানা রূপ৷ আশরাফ আলী শুনেছেন তাদের ফেলে আসা অঞ্চলে এখন আরো কষ্ট আরো বেশি পানির অভাব৷ মাটি, পানি, বাতাসে ভাসে লবন৷ লবনপানির কারণে বাড়ছে অসুখ, এমনকি মেয়েদের জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনাও ঘটছে৷ ফেলে আসা বড়কূপট নাকি এখনকার দমবন্ধ বস্তি; আবার কোনো বড় দুর্যোগ এলে কোথায় যাবেন কীভাবে যাবেন কিছুই আন্দাজ করতে পারেন না এখন৷ কেবল জানালেন, ‘...আমরা আর আগের মতো গোলবেইদে হইতে চাই না, ও জীবন বড় কষ্টের, সবাই ঘা সইয্য করতে পারে না, সবাইরে হারাইতে লাগে৷' মিসর জলবায়ু সম্মেলন আশা করি আশরাফ আলীদের জলবায়ু-দুর্গতি আমলে নিবে৷ জলবায়ু স্থানান্তর এবং জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের জন্য সম্মানজনক সিদ্ধান্তে উপনীত হবে৷

জলবায়ুর অর্থ: উন্নত বিশ্ব অর্থ দিতে কি আদৌ আগ্রহী?

লস অ্যান্ড ড্যামেজ: হারোনো গানের খাতার কী হবে?

এদেশে বন্যার ইতিহাস সুপ্রাচীন৷ ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী ১৫শ খৃস্টাব্দে এক ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল দেশের বিরাট এলাকা ৷ পরবর্তীতে ১৭৮৭, ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫, ১৮৯২, ১৯৩১, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪ সনের বন্যার পাশাপাশি বছর বছর পাহাড়ি ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে৷ বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ জুড়ে হাওর জলাভূমি৷ কেবল ধান, মাছ, পাথর নয়; এই অঞ্চল দুনিয়াকে উপহার দিয়েছে রাধারমণ, শীতালং, হাসন, দূরবীন, শাহ আবদুল করিম, জালাল, উকিল মুন্সীর গান কিংবা মৈমনসিংহ গীতিকা৷ ২০২২ সনে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গিয়েছিল সুনামগঞ্জ ও সিলেট৷ পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল ভারতের চেরাপুঞ্জির উজানেই বাংলাদেশের হাওর৷ আবহাওয়া পরিসংখ্যান বলছে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একইসাথে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে ২০২২ সনের জুনে৷ একক সময়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানিই তৈরি করেছে আচমকা নিদারুণ এক বন্যা পরিস্থিতি৷ চেরাপুঞ্জি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের মাওসিনরামে ১৫ জুন ২০২২ তারিখে ৭১০.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, ১৯৬৬ সনের পর এটিই সর্বোচ্চ৷ বাংলাদেশের সিলেটে ১৭ জুন ২০২২ তারিখে ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, এর আগে ২০০০ সনের ১২ জুন ৩৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৯ সনের ১৯ জুন ৩৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়৷ ২০২২ সনের জুনে তিনদিনে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ২৪৫৮ মিলিমিটার, যা বাংলাদেশের বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি৷ চেরাপুঞ্জি থেকে বৃষ্টির পানি পাহাড়ি ঢল হয়ে কুশিয়ারা-সুরমা নদী দিয়ে হাওরাঞ্চল প্লাবিত করে মেঘনা দিয়ে সাগরে মিশে৷ ২০২২ সনের বন্যায় জানমালের ক্ষতি হয়, ফসল তলিয়ে যায়৷ সুরমা অববাহিকায় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের গয়াসপুরে বেলা রানী তালুকদারদের ঘর৷ হাওরের ধামাইল গানের সংগ্রাহক এই নারীর বেশিকিছু গানের খাতা প্রায় কয়েকশত গান নিয়ে বন্যায় তলিয়ে যায়৷ বহু গ্রামীণ শিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র ও গানের খাতা এভাবে বিনষ্ট হয়েছে৷ এমনকি সুনামগঞ্জ শহরে হাসনরাজা স্মৃতি জাদুঘরে রক্ষিত বহু নির্দশন বন্যায় নষ্ট হয়৷ বেলা রানী বন্যার পর তাঁর মেয়ের বাড়িতে চলে যান৷ এখন আর ধামাইল গানের প্রতি তেমন একটা টান নেই তার!  বিলাপ করে জানান, ‘...ইতা দিয়া আর কিতা অইবো, কত যত্ন কইর‌্যা তারারে রাখছিলাম, যইক্ষের ধন সব হারাইলাম গো, ইতা তো আর সোনা-রূপা না, একবার হারাইলে কিতা দিয়া পূর্ণ করবায়?' বৈশ্বিক জলবায়ু সংক্রান্ত দেনদরবারে ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতিকে (লস অ্যান্ড ড্যামেজ)' আমলে নিয়ে ক্ষতিপূরণে সুস্পষ্ট বৈশ্বিক তহবিল গঠনের দাবি ওঠেছে৷ অধিকাংশ সময় ক্ষয়ক্ষতি কেবলমাত্র বস্তুগত বিষয়াদিকে বিবেচনা করে, কিন্তু সমাজের জ্ঞানগত ও শিল্পগত বিষয়াদিকে নয়৷ মিসর জলবায়ু সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের আলাপ ওঠেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কেবল জমি, বসতি, কাঠামো, প্রাণসত্তা নয়; বিপন্ন হয় লোকায়ত জ্ঞান, কৃত্য, আখ্যান এবং বহু শিল্পসম্ভার৷ সমাজ বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখা এই অবস্তুগত বিষয়ের ক্ষয়ক্ষতিকে আমলে নিতে হবে এবং এর ক্ষতিপূরণ এবং সুরক্ষায় সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে হবে৷

জলবায়ুর অর্থ: কোন খাতে প্রয়োজন? কোন খাতে মিলছে?

অভিযোজন : অধিপতি চশমা খুলে দেখতে হবে

পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে পতঙ্গের ভূমিকা অনন্য৷ কেবল পরাগায়ণ নয়; মধু, রেশম, লাক্ষা সবকিছুই পতঙ্গের অবদান৷ যদিও তথাকথিত ‘সবুজ-বিপ্লবের' মাধ্যমে প্রবর্তিত রাসায়নিক কৃষি পতঙ্গবিরোধী৷ পোকা থেকে তৈরি লাক্ষা বস্তুটি কুটিরশিল্প থেকে ভারী শিল্পেও ব্যবহৃত হয়৷ বর্তমানে কেবল চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে কিছু পরিবার লাক্ষা চাষ করেন৷ নাচোলের কন্যানগরের মিরাজউদ্দীন একজন লাক্ষাচাষী৷ তাদের বাড়িতে এক প্রবীণ বরই গাছে লাক্ষা চাষ হয়৷ এই গাছে তার বাবা ও দাদা সবাই লাক্ষা করেছেন৷ লাক্ষা চাষের জন্য উপযোগী আবহাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ দিনে দিনে লাক্ষা উৎপাদন কমছে, পোকা মরে যাচ্ছে, লাক্ষার গুণগত মান কমছে৷ লাক্ষাচাষে কোনো রাসায়নিক, সিনথেটিক সার, বিষ, হাইব্রিড বীজ বা যন্ত্রচালিত সেচের দরকার হয় না৷ কিন্তু আশেপাশের জমিতে যখন বিষ প্রয়োগ করা হয় তাতেও বহু লাক্ষা মরে যায়৷ লাক্ষাপোকার বসতি ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন বড়ই গাছের তলে দাঁড়িয়ে জানালেন,...‘এখন গরম বেশি বাড়ছে, প্রচন্ড খরায় লাহা মরে যায়, বৈশাখ মাসে গুঁড়ি গুঁিড় কুয়াশা হলেও লাহা মরে, বৃষ্টি না হলে লাহা পোকা গাছে বসতে পারে না, চৈত্রমাসে দক্ষিণা বাতাস বাইরতেছে, দক্ষিণা বাতাসে তাপ থাকে, লাহা জ্বলে যায়, খরার কারণে লাহা দানা বাঁধে না, গুঁড়া গুড়া হয়ে পড়ে যায়, অনেক ক্ষতি হয়'৷ এমন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তিনি মাতৃগাছে লাক্ষা পোকার বীজ বিশেষভাবে সংরক্ষণ করছেন৷ বছরব্যাপি সুস্থ লাক্ষা পোকাকে জীবিত রাখার জন্য বেশকিছু কৌশল নিজেরাই চর্চা করছেন৷ দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশেষত কৃষিতে অভিযোজনকে খুব বেশি আলোচনায় রাখা হয়৷ অভিযোজন আলাপের অধিপতি চশমাটা খুলে ফেলতে হবে, সকল উৎপাদন ও চর্চাকে সমমর্যাদা দেয়া দরকার৷  প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক এবং পরিচিত কৃষিউৎপাদন বাদেও দুনিয়াময় ছড়িয়ে থাকা প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর উৎপাদন ও ক্ষুদ্র ব্যবস্থা গুলোও কীভাবে হুমকীর মুখে পড়ছে এবং তা সামাল দিতে কী ধরণের টিকে থাকার কৌশল চর্চিত হচ্ছে সেসব সমান গুরুত্ব দিয়ে জলবায়ু সম্মেলনের মূল আলোচনায় আনা জরুরি৷ বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি মূলত গড়ে ওঠেছে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র, দেশি জাতবৈচিত্র্য, লোকায়ত জ্ঞান আর প্রতিনিয়ত জলবায়ুপাঠের অভিজ্ঞতায়৷ বাংলাদেশের ভাসমান ধাপচাষ বা গাউতা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘প্রাকৃতিক কৃষি ঐতিহ্য'৷ জলবায়ু সহনশীল কৃষির বিকাশে দেশের কৃষিজীবনের লোকায়ত জ্ঞান চর্চা, আদি দেশি জাত এবং গ্রামীণ অভিযোজন কৌশলগুলোর সুরক্ষা, মর্যাদা ও স্বীকৃতি জরুরি৷ জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি গড়ে তুলেতে অর্থায়ন ও বহুমুখী নীতিকৌশল গ্রহণ করতে হবে যেখানে প্রান্তিক কৃষক ও খাদ্যউৎপাদনকারীর সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়৷

কার্বন নির্গমণ: প্রাণ ঝরে পড়ছে

রাজশাহীর তানোরের বাধাইড় ইউনিয়নে ঝিনাখোড় ও ঝিনারপাড়া নামে দুটি গ্রাম আছে৷ আদিবাসী মাহালী, সাঁওতালদের পাশাপাশি কিছু বাঙালিদের বসতও ছিল এখানে৷ লম্বা ঝিনুককে মাহালিরা বলে ঝিনাই৷ আগে এই উচ্চবরেন্দ্রর গ্রামে খাঁড়ি ও দীঘিসহ কিছু জলাধার ছিল৷ দিনে দিনে সব শুকিয়েছে৷ তীব্র তাপদাহ বাড়ছে৷ আশ্বিন মাসে তীব্র তাপের কারণে ধান গাছের শিষ মরে যায়৷ খরার কারণে অনেকের হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু মারা যায়৷ বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচে বেশি পানির কষ্ট এখানে৷ বহুদূর থেকে নারীদের কলস দিয়ে পানি বয়ে আনতে হয়৷ শরীর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়৷ পানি আনা নিয়ে নানা সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়৷ ঝিনারপাড়ার মাহালী প্রবীণ আগ্নেস হাঁসদা জানান,‘...এমন খোয়েবী তাপ আগি দেখিনি, এরকম খইরায় শরীল জ্বলে যায়, সাপখোপ মানুষ ধান কেউ বাঁচবে না৷' বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ক কর্তৃপক্ষ বহু গবেষণায় দেখিয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে৷ রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সনে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও ২০২২ সনের জুলাই মাসে এত কম বৃষ্টি হয়েছে যা রেকর্ড করা যায় নি৷ একইসাথে রাজশাহীতে প্রতিনিয়ত উচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে৷ এশিয় উন্নয় ব্যাংকের (এডিবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন দেখিয়েছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল খরাপ্রবণ এলাকা এবং ১৩টি জেলা খরাপ্রবণ৷ বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে কেবল মানুষের সমাজ নয়, বিপর্যস্ত আজ প্রাণ-প্রকৃতির সকল সদস্য৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছড়াগুলো আজ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে৷ বেঘোরে মরছে মাছ, কাঁকড়া, উভয়চর, সরীসৃপ, পতঙ্গ, পাখি, উদ্ভিদ এবং বহু বন্যপ্রাণ৷ গণমাধ্যমসূত্র জানায়, দেশে ৬৪টি বিলুপ্তপ্রায় মাছের ভেতর সরকারি নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে ৩১ প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এবং বাকী ৩৩টি বিলুপ্ত৷ আর এর কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে৷  মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এ বিষয়ে সংসদে জানান, ‘উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মাছের আবাসস্থল, বিচরণক্ষেত্র ও প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে৷' যদি আমরা পৃথিবীর সকল প্রাণপ্রজাতির সুরক্সা চাই তবে অবশ্যই প্যারিসচুক্তি অনুযায়ী আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে এবং বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণ হ্রাস করতেই হবে৷ প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার ‘জাতীয়ভাবে নিধার্রিত অবদান (এনডিসি)' সুনির্দিষ্ট করে দায়িত্বশীল হতে হবে৷ প্রকৃতির ওপর দখল, দূষণ কিংবা লুটতরাজ একমাত্র মানুষই করে৷ মানুষই মাটির তলার জল মেশিন দিয়ে টেনে তুলে মাটির বুক নিঃস্ব করে৷ চিনামাটির বাসনের জন্য পাহাড়ির পর পাহাড় কেটে নিশ্নিহ্ন করে৷ জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য পৃথিবীর কলিজা কী ফুসফুস ছিন্নভিন্ন করে৷ ভোগ আর বিলাসিতা শব্দগুলো কেবল মানুষের সমাজেই আছে৷ কিন্তু এভাবে নিশ্চয়ই বহুকাল চলতে পারে না৷ জীর্ণ নিঃস্ব এক গ্রহ আর কতোকাল এভাবে কেবল প্রজাতি হিসেবে মানুষের অনাচার সইবে? আশা করি মিসর জলবায়ু সম্মেলন কার্বন নির্গমণের বিষয়ে দায়িত্বশীল হবে এবং বোঝার চেষ্টা করবে কার্বণ নি:সরণ না থামালে পৃথিবীর বহু প্রাণ অকালেই ঝরে যাবে৷

পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষকছবি: Privat

হারানো ষড়ঋতু ফেরত চাই!

কি ধান, কি মাছ, কি ঋতু,  কি গাছ, কি মানুষ, কি ভাষা, কি উৎসব এমন বৈচিত্র্য বাংলাদেশের মতো দুনিয়ায় আর কোথায় আছে! কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রতিদিন ভেঙ্গে পড়ছে বর্ণময় ঋতুর ডানা৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দারুণ সময়ে জন্মেছিলেন, এই ভূগোলের ষড়ঋতুর বৈভব কিছুটা আন্দাজ করবার বিরল সুযোগ যার হয়েছিল৷ গ্রীষ্মে কবি ‘চাঁপাবনের কাঁপন’ দেখতে পান৷ বর্ষার গানে তমাল, বকুল, মালতী, কেতকী, কদম, শাল, অশ্বত্থ, কেয়া, পিয়াল, যূথী, আম, জাম, শিরীষ এই গাছগাছালির নাম মেলে৷ শরতের গানে শেফালি, কাশ, কেয়া, তাল, চাঁপা, পারুল নামগুলো দেখা যায়৷ হেমন্তের গানে বকুল, শ্বেকরবী, মল্লিকার কথা আছে৷ শীত ঋতুর গানে আছে আমলকি, শিউলি, ঝুমকোলতার নাম৷ প্রকৃতিপর্বের বসন্তের গানে আছে সর্বাধিক তরুপল্লবের নাম৷ কিন্তু আজ আমাদের চারধার থেকে এই দৃশ্যমানতা পাল্টে যাচ্ছে৷ আমরা স্থান, কাল, পাত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় হতে বাধ্য হচ্ছি৷ প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলনে আমাদের নানামুখী চাওয়াপাওয়া থাকে৷ আমরা আশা করি, সতর্ক হই, ফুঁসে ওঠি, আনন্দিত হই, হতাশ হই কিংবা বিষিয়ে ওঠি৷ হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি হিসেবে আমাদের সাধ্য ও যোগ্যতার বলয়েই আমরা পৃথিবীকে আগলে রাখার আওয়াজ তুলি৷ কিন্তু বছরবছর ধনী ও ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র ও করপোরেটরা জনগণের আওয়াজ আমলে নিচ্ছে না৷ কেবল সময়ক্ষেপণ করছে, অযথা অর্থ-শ্রম-সময় অপচয় হচ্ছে৷ আমরা জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবি তুলেছি৷ কার্বণ নি:সরণ হ্রাস, অভিযোজন, প্রশমন, ক্ষয়ক্ষতি, তহবিল, এবং স্থানান্তরের মতো সুস্পষ্ট, যৌক্তিক এবং ন্যায্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ তুলেছি৷ আমরা কিন্তু ষড়ঋতু ফেরত পাওয়ার মত দুর্লংঘ্য দাবি তুলিনি৷ এমনকি কেন এই জনসম্মেলন প্লাস্টিক দূষণকারী কোকাকোলা বা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিনাশকারী করপোরেটের অর্থায়ন গ্রহণ করে এমন প্রশ্নও তুলিনি৷ চলতি আলাপখানি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে শেষ করছে৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মশক্তি' প্রবন্ধে বলেছেন, ‘...আমরা লোভবশত প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার যেন না করি৷ উপকরণের বিরলতা, জীবনযাত্রার সরলতা আমাদের দেশের নিজস্ব-এখানেই আমাদের বল, আমাদের প্রাণ, আমাদের প্রতিজ্ঞা৷' বিশ্বনেতৃত্ব, ক্ষমতাকাঠামো ও নয়াউদারবাদী ব্যবস্থাকে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাষ্য পাঠ করবার আহবান জানাই৷ বাংলাদেশের জলবায়ু-দুর্গত মানুষ আশা করে, মিশর জলবায়ু সম্মেলন একটিমাত্র পৃথিবীর প্রাণসুরক্ষায় সকলের বলকে সম্মিলিত করবার প্রতিজ্ঞা করবে৷