৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন সেখানে জমে যায় লাশের পর লাশ। সেগুলোকে একত্রে রাখা হয় একটি ভ্যানে। সেই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সেখানে নিহতদের একজনের পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যায়। সেই ব্যাক্তিকে নিজের স্বামী দাবি করে গত অক্টোবরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা দায়ের করেন কুলসুম বেগম (২১) নামের এক গৃহবধূ। মামলায় আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০জনকে।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একের পর এক খবর আসতে থাকে এই ঘটনাকে ঘিরে। কুলসুম বেগমের স্বামীর নাম আল আমিন। আল আমিন জানান, তার বাড়ি সিলেটের সুরমায়। তিনি তার পরিবার নিয়ে থাকেন মৌলভীবাজারের জুড়িতে। ঘটনার দিনও স্ত্রীসহ তিনি জুড়িতেই ছিলেন। কয়েকদিন পর তাদের মধ্যে ঝগড়া হলে স্ত্রী মানিকগঞ্জ চলে যান।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, মামলায় আল আমিনের স্ত্রী নিজের বর্তমান ঠিকানা হিসেবে আশুলিয়া এবং স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে মানিকগঞ্জকে উল্লেখ করেছেন। নিজের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বক্তব্য দেখে আল আমিন বিস্মিত হয়েছেন- তিনি তো মারা যাননি, তাহলে তাকে মৃত দাবি করলো কে, তাকে মৃত ‘বানিয়ে' হত্যা-মামলাটিই বা কীভাবে হলো!
আল আমিন ও তার পরিবারের দাবি, এই মামলা দায়েরের সময়ে তারা এ বিষয়ে কোনো কিছু জানতেন না। তার স্ত্রী কেন মামলাটি দায়ের করেছেন, তা তারা বুঝতে পারছেন না। মামলার আসামির তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে স্ত্রী চাঁদাবাজি করছেন বলেও অভিযোগ আল আমিনের। আল আমিন পুলিশের কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে কথা বলেছেন।
আল আমিনের জীবিত থাকার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর কুলসুমের কোনো বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে আমার চোখে পড়েনি। এর মধ্যে একটি সংবাদে বলা হয়, শেষ খবর পর্যন্ত তিনি নিরাপদ হেফাজতে ছিলেন। পুরো বিষয়টি এখন দেখছে আশুলিয়া থানা পুলিশ।
নিরাপদ হেফাজত দিয়ে যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজত বোঝানো হয়, তাহলে কুলসুমের বক্তব্য না পাওয়ার কারণ এটাও হতে পারে। তবে কুলসুমের আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের বক্তব্য পেলেও বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হতো।
কুলসুম মামলাটি করেছেন, সেটি সত্য। স্বামীর পরিবারের দাবি অনুসারে তিনি হয়ত সত্যি সত্যিই আসামিদের কাছ থেকে চাঁদাবাজিও করেছেন। এসব কাজ কি তিনি একার বুদ্ধিতে করেছেন? এখানে কী কী সম্ভাবনা রয়েছে? হয়ত তার স্বামীও এখানে জড়িত, মাঝখানে ঝামেলা হওয়ায় এখন অস্বীকার করছেন। হয়ত স্বামীর দাবিই সঠিক৷ ঝগড়ার পর স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করার পর তিনি হয়ত আশুলিয়াতে এসেছিলেন। সেখানে কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি মামলাটি করতে পারেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ মামলার পূর্বে বা পরে এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে থাকতে পারে।
তবে এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট। মামলাটি দায়ের হওয়ার সময় কুলসুম তার স্বামীর জীবিত থাকার বিষয়টি জানতেন। এখানে আমি ধরে নিচ্ছি, কুলসুম আদালতে নিজে হাজির হয়ে মামলাটি করেছেন। তার হয়ে অন্য কেউ মামলাটি দায়ের করে দেয়নি। তবে এই দুটোর যেটাই ঘটুক না কেন, মামলা নিয়ে তৃতীয় উদ্দেশ্যের বিষয়টি এখন স্পষ্ট। তৃতীয় উদ্দেশ্যটি কি চাঁদাবাজি? সে যা-ই হোক, আপাতত এই মামলার মূল বিষয় হচ্ছে, জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে মামলা। কুলসুম নিজে করুক আর তাকে দিয়ে কেউ মামলা করাক- তারা হত্যা মামলার ভিক্টিম জীবিত কি-না, সেটাকে থোড়াই কেয়ার করলো। কল্পিত মামলা করাটা কতটা সহজ হয়ে গেছে, তাই না?
কথিত আসামিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে কুলসুমের স্বামীর অভিযোগ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে না পারলেও অন্য অনেক ঘটনায় কিন্তু এটা স্পষ্টভাবেই জানা যাচ্ছে।
মামলা বাণিজ্যের এমন একটি অভিযোগ দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে একটি ভিডিও থাকার কল্যাণে। ভিডিওটিকে সূত্র ধরে প্রতিবেদন করছে শীর্ষস্থানীয় অনেক সংবাদমাধ্যম।
রংপুরে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের একটি মামলায় ‘ইচ্ছেমতো' আসামি করার অভিযোগ উঠেছে রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে। গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মামলার বাদীর একটি ভিডিও বক্তব্য ভাইরাল হলে বিষয়টি সামনে আসে। অবশ্য ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে ‘অভিযোগ মিথ্যা' বলে দাবি করেছেন বিএনপির ওই নেতা।
ঘটনা হচ্ছে, ১৩ নভেম্বর রংপুরের একটি থানায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সংঘর্ষ নিয়ে একটি মামলা করেন মাহীগঞ্জ ২৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ। ভাইরাল ভিডিওতে বাদীকে বলতে শোনা যায়, তিনি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ২৫ জন চিহ্নিত সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহানগর বিএনপির সভাপতি সামসুজ্জামান ১৮১ জনের নাম দেন। যা-ই হোক, সামসুজ্জামান মামলায় নাম বাড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও এই মামলায় যে নির্দোষ ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে, এটা বাদী এবং সামসুজ্জামান দুজনই এখন স্বীকার করেন।
মামলা নিয়ে চাঁদা দাবি করায় বিএনপি দলীয়ভাবে তাদের নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে। মামলা নিয়ে চাঁদাবাজি হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারাও। মিথ্যা মামলা হওয়ার কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও।
তাহলে কেন থামছে না মামলা-বাণিজ্য? জবাব আছে মামলার অর্থনীতিতে। লক্ষ্মীপুর জেলায় একটি মামলা থেকে একজন ব্যক্তির নাম কাটাতে কৃষক দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা দাবি করেছিলেন দুই লাখ টাকা। চাঁদার জগতে এটা ছোট অঙ্ক। এমনিতে চাঁদাবাজির নানা অভিযোগ কোটির অঙ্কে পৌঁছে যায়। কোটি টাকা চাঁদা দাবির একটি মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির এক সাবেক নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। ইউনিয়নে যেটা লাখ টাকা, মহানগর পর্যায়ে এলে দাবির অংক কোটি টাকা হয়ে যায়।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশের এক খবরে পুলিশ সদর দপ্তরকে উদ্বৃত করে বলা হয়, ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, নেতা-কর্মী এবং পুলিশের নামে চার শতাধিক মামলা হয়েছে আদালত ও দেশের বিভিন্ন থানায়। এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে। অজ্ঞাত পরিচয় আসামি দুই লাখের মতো।
৪০০ মামলায় ২৩০,০০০ (দুই লাখ ত্রিশ হাজার) আসামি। এর মধ্যে ২০০, ০০০ (দুই লাখ) অজ্ঞাত। চাইলে যে কাউকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে চালিয়ে দেয়া যে যায়, সেটা তো আমরা বহু দেখেছি। হাজার লোকের কাছেও যদি চাঁদাবাজি করা হয়ে থাকে, রেটটা যদি ইউনিয়ন বিএনপির বহিষ্কৃত সেই নেতার মতোও হয়, তাহলে ১০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর রেটটা যদি মহানগর বিএনপির সাবেক সেই নেতার রেটে হয়, ৫ হাজার লোকের কাছ থেকেই তাহলে ৫ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়ে থাকতে পারে। আমরা চাঁদাবাজির শিকার মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ধরে হিসেবটি করেছি। বাস্তবে ২ লাখ অজ্ঞাত আসামির সুযোগে চাঁদাবাজির শিকার ১০ লাখ হতে পারে- আরো বেশিও হতে পারে।
মামলার আসামিদের কাছ থেকে তো এভাবে চাঁদাবাজি চলে। আসামি করার হুমকি দিয়ে কি চলে না চাঁদাবাজি? পত্রিকায় খবর কিন্তু ভুরিভুরি। কুষ্টিয়ায় তো ড্রাফট এজাহারের কপি পাঠিয়ে চাঁদাবাজি করার খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে।
১৪ সেপ্টেম্বরের পরের মামলাগুলোর হিসেব তো এখানে নেই। খুঁজলে হয়ত সেটা পাওয়া যাবে। তবে আসামি করার হুমকি দিয়ে চাঁদা কতজনের কাছে দাবি করা হয়েছে, সেটা কোনোদিনই জানা সম্ভব নয়।
বিএনপি কিন্তু অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশ নানা রকমের চাঁদবাজির কিছু ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়েছে। তারপরও থামেনি এই মামলা-বাণিজ্য। বহিষ্কারের পরও চলছে চাঁদাবাজি। এর কারণ লুকিয়ে আছে মামলার রাজনৈতিক অর্থনীতিতে। মিথ্যা মামলার অর্থনীতি, চাঁদাবাজির অর্থনীতির যে আকার, সেটার কারণেই এটা থামছে না। এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অনেকে হয়ত মনে করছেন, দল থেকে বহিষ্কার হলে পরে আবার পদ পাওয়া যাবে। জেলে গেলে জামিনও মিলবে। কিন্তু টাকা তো থেকে যাবে। তাই কামিয়ে নিচ্ছেন দুই হাতে।
মিথ্যা মামলা আর মামলা নিয়ে বাণিজ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেও আঙুল উঠেছে। এরপরও ভরসা তাদের উপরেই করতে হয়। ন্যায় বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাদের সাঁড়াশি ভূমিকা কি অন্তত একবার আশা করা যায় না? মিথ্যা মামলা- অযথা হয়রানি বন্ধে তারা কি কার্যকর ভূমিকা রেখে বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে না? মিথ্যা মামলায় জেল-জরিমানার বিধান আমাদের অনেক আইনেই আছে। কিন্তু আদালতের দীর্ঘসূত্রিতায় সেখানে দ্রুত ন্যায়বিচার আশা কঠিন হলেও নিরাশ হতে চাই না।
তবে সবচেয়ে বেশি যেটি চাই, ন্যায় বিচারের স্বার্থে মিথ্যা মামলার অর্থনীতিতে চরম আঘাত। যেসব অপরাধ টাকা নিয়ে আসে, সেখানে কেবল জেল যথেষ্ট নয়। বরং, এমন অঙ্কের জরিমানা যেন হয়, যাতে সেটা সেই অপরাধে উপার্জিত টাকাকে নিঃশেষ করে অপরাধী ব্যক্তির অন্য সম্পদেও আঁচ লাগে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের কাজ হচ্ছে, প্রতিটি ঘটনায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। প্রতিটি ঘটনা না হোক, আপাতত দ্রুত এমন একটি দৃষ্টান্ত তৈরির আশা করলে কি অনেক বেশি চাওয়া হয়ে যাবে? সেটা করে দেখানো আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের জন্য কি অসম্ভব?