‘মানুষকে ভয় দেখানো আর ভয়ে রাখার আইন’
২৬ জুন ২০২০যে কোন দেশেই আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে৷ সুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায়, তখন আবার আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়৷ কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় এর উল্টা প্রবণতা৷ দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মুর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে৷ গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতংকে থাকতে হয়, এই বুঝি তার উপর এই আইনের খড়গ নেমে এলো৷ অথচ, এই আইনটি প্রণয়নের আগে অনেক আলোচনা হয়েছিল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নানা ধরনের মতামত দিয়েছিল৷ মর্মান্তিক হলো, আইন প্রণয়নের সময় সেসব মতামতের সিংহভাগকেই উপেক্ষা করা হয়েছে৷
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন৷ এর আগে তথ্য প্রযুক্তি আইন নামে প্রায় একই রকম আরও একটা আইন ছিল৷ সেটির কয়েকটি ধারা নিয়ে খুব সমালোচনা হয়৷ সরকারের একাধিক মন্ত্রীও স্বীকার করেন, কিছু সমস্যা আসলেই রয়ে গেছে৷ সেই সমস্যা দূর করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে নতুন এই আইন৷ কিন্তু দেখা গেল, আগের আইনে যে ৫৭ ধারা নিয়ে এত আপত্তি, এত সমালোচনা, সেটিই কয়েকটি ধারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে নতুন আইনেও৷ এ নিয়েও আপত্তি ওঠলো৷ বলা হলো- ৫৭ ধারা তো গেল না, বরং আরও ডিটেইলে জায়গা করে নিল৷ আগের সেই মন্ত্রীরা এবার আর কিছু বললেন না৷ পাস হয়ে গেল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন৷ পাস হওয়ার সময় জাতীয় সংসদে সেই সময়কার টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছিলেন, তিনি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছেন৷ তিনি এমনও আশা করলেন, এটি এমনই ভালো একটি আইন যে, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর বহু দেশ এটা অনুসরণ করবে৷ এরকম আইন তারাও প্রণয়ন করবে৷
মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সেই আশাবাদের পর এর মধ্যে প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে৷ যতদূর জানি- এখনো কোন দেশ আমাদেরকে অনুসরণ করেনি৷ বরং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমরা এই আইনের কারণে সমালোচিত হয়েছি, রেটিংয়ে পিছিয়ে পড়েছি৷ রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার এর মুক্তসাংবাদিকতার তালিকায় আমাদের অবস্থান এই নতুন আইনের পর চার ধাপ পিছিয়েছে৷ ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৪৬তম অবস্থানে, আইন প্রণয়নের পর ২০১৯ সালে অবস্থান হয়েছে ১৫০তম৷ অর্জনের মধ্যে এতটুকুই৷
এই যে অবনমন, সরকার অবশ্য এটা মোটেই স্বীকার করে না৷ প্রায় ৩২ বছর ধরে আমি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত৷ আমার মত আরও অনেক সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা যা-ই হোক না কেন, সরকার কিন্তু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করে থাকে যে, দেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবত কালের মধ্যে বর্তমান সরকারের সময়ে মিডিয়া সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে! আসলে সমস্যাটা হয়েছে কি, পৃথিবীজুড়ে এমন একটা সময় এসেছে যে, এখন আর কাউকে কষ্ট করে কিছু প্রমাণ করতে হয় না৷ কেবল মুখ ফুটে দাবি করলেই হয়৷ কি বলা হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কে বললো- সেটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ এই যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিদিন আবোল তাবোল বলছেন, সেখানকার মিডিয়াগুলো তা ধরিয়ে দিচ্ছে, এ বিতর্কে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকছে কোনটা? হাসাহাসি হয়তো হচ্ছে, কিন্তু তারপরও শেষ অব্দি ট্রাম্পের কথাই কিন্তু মানতে হচ্ছে৷ আমাদের এখানেও হয়েছে সেরকম৷ উনি যা বলছেন, ওনারা যা বলছেন- সেটাই সত্য বলে মানতে হচ্ছে৷ বছর খানেক আগে আমাদের তথ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে৷ সেখানে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ দায়িত্ব নিয়ে বললেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম খোদ ব্রিটেনের গণমাধ্যমের চেয়েও বেশি স্বাধীন!
এমন নয় যে বিবিসি আমাদের দেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না৷ আমাদের স্বাধীনতার আগে থেকেই তারা বাংলাদেশে কাজ করছে৷ এখানে তাদের অফিস রয়েছে, সেখানে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকও বাংলাদেশী৷ তারা সেখানে কাজ করতে যেয়ে, এই দেশে বাস করতে যেয়ে নিশ্চয়ই জানেন কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে আমাদের গণমাধ্যম৷ তারপরও তথ্যমন্ত্রী বেশ হাসিমুখেই এমন দাবি করে থাকেন৷ উনি নিজেও জানেন, কতটুকু সত্য তিনি বলেছেন৷ আবার এটাও জানেন, এই যে দাবিটা তিনি করছেন- সেটা কতটুকু বিশ্বাস করছে বিবিসি বা বিবিসির দর্শক শ্রোতারা৷ সবই জানেন, তবুও বলেন৷ এই বলাটাই আসলে তার কাজ, এটাই তার চাকরি৷ এই বলার কাজটা তিনি কতটা আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তার সঙ্গে করতে পারছেন, তার উপর নির্ভর করে তার চাকরির মেয়াদ৷
আসলে এরকমই একটা ধারা চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনে৷ আর চলছে বলেই মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, একদা মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও, অধিকাংশ মিডিয়াকর্মীর প্রতিবাদের মুখেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করাতে পারাকে নিজের সৌভাগ্য হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন৷ প্রতিবাদ যা এসেছে তার বেশিরভাগই এসেছে সাংবাদিকদের কাছ থেকে৷ কিন্তু এর কুফল কিন্তু ভোগ করছে সকল মানুষই৷ এমনকি ভালুকার অজপাড়াগাঁ, হবিরবাড়ি এলাকার স্কুল ছাত্র কিশোর ইমন, সেও টের পেয়ে গেছে এই আইনেরতাপ৷ কিশোর সংশোধনাগারে বসে নবম শ্রেণির এই ছাত্রটি হয়তো এখন ভাবছে- কই, এরকম একটা আইন যে আছে সে কথা তার শিক্ষকরা কখনো তো তাকে জানায়নি৷ তাদের পাঠ্য বইয়েও কিছু বলা নেই এ সম্পর্কে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে সে ফেসবুকে কিছু মন্তব্য করেছে, পরে আবার বুঝতেও পেরেছে- এসব লেখা ঠিক হয়নি, তখন দুঃখ প্রকাশ করেছে, তারপরও তাকে গ্রেপ্তার করা হলো! আচ্ছা, যে কথাগুলো ইমন লিখেছে, সেগুলো সে পেল কোথায়? তার মাথায় কথাগুলো কে ঢুকালো? কথাগুলো সে হয়তো কোথাও শুনেছে, হয়তো বাড়ির পাশে চায়ের দোকানের আড্ডায় শুনেছে, হয়তো দৌড়ের উপর থাকা কোন বিরোধী দলীয় কর্মীর কণ্ঠে শুনেছে, কিংবা এমনকি অর্থনৈতিক টানাপড়েনে নাজেহাল তার পরিবারের কর্তাব্যক্তির ক্ষুব্ধ উচ্চারণে শুনেছে৷ শোনা সেই কথা সে কেবল তার ফেসবুকে রিপিট করেছে৷ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৪ বছর ইমন এখন শিশুই একজন৷ সেই শিশুকে গভীর রাতে যেয়ে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে আনতে হলো! কত পাওয়ারফুল এই আইন!
শিশুর কথা থাক, এবার বরং দুই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের কথা বলি৷ এই দুই শিক্ষকের একজন আবার আওয়ামী লীগ করেন৷ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মারা যাওয়ার পর এরাও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন৷ সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা, প্রথমে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা, পরে অ্যাকশনে গেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷ আর মামলা যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, মহাউৎসাহে পুলিশ যেয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে৷ এ ধরনের মামলা আর গ্রেপ্তার প্রতিনিয়তই হচ্ছে৷ কোনটা কারণে হচ্ছে, কোনটা বা অকারণেই হচ্ছে৷ নানা ছুতা নাতায় হচ্ছে৷ তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, বেশির ভাগ মামলার বাদীই হচ্ছে সরকার পক্ষীয় লোকজন৷ সরকারী দলের নেতা, কর্মী, এমপি, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার, এমনকি সরকারী কর্মকর্তাও বাদী হয়েছেন অনেক মামলার৷
আসলে আইনটাই এমন যে, এর মধ্যে যে কাউকে যে কোন সময় ফেলে দেওয়া যায়৷ আইনের অনেক ধারা মধ্যে থেকে দুটি মাত্র ধারা, ২৫ এবং ৩১, বরং এখানে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়৷ এই দুটি ধারা কথা বললাম এ কারণে যে, এরই মধ্যে গত জানুয়ারিতে এই দুটি ধারার বিষয়ে হাইকোর্টে আপত্তি উঠেছে৷ এই ধারাগুলো কেন আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়- সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে উচ্চ আদালত সরকারকে শোকজ করেছে৷ পাঁচমাস হয়ে গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে কোন উত্তর যায়নি৷ সরকার কি উচ্চ আদালতকে পাত্তা দেয়নি, নাকি বলার মত কোন যুক্তি তার নেই- তা অবশ্য জানা যায়নি৷ কিন্তু কি আছে ওই ধারা দুটিতে? ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে-‘আপনার লেখায় যদি কোন ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় করার অভিপ্রায় প্রকাশ পায়, তাহলে আপনি অপরাধী৷' এখন আপনার যে কোন লেখায় আমি অপমানিত বোধ করতে পারি, বিরক্ত হতে পারি৷ অর্থাৎ বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়- বিষয়গুলো কিন্তু লেখার উপর নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে যিনি লেখাটা পড়ছেন তার মানসিক অবস্থার ওপর৷ এই মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে লেখা ফেসুবকের স্ট্যাটাস, সেটা কাকে বিরক্ত করেছে? মোহাম্মদ নাসিম তো মারা গেছে, তার পরিবারের কোন সদস্যও মামলা করেনি, করেছে ছাত্রলীগের নেতারা৷ এমনকি মোহাম্মদ নাসিমের এক পুত্রবধু অনুরোধ করেছেন, মামলা যেন প্রত্যাহার করা হয়৷ কিন্তু তাতে কাজ হয়নি, ছাত্রলীগের নেতাদের বিরক্তি না কমলে তারা মামলা প্রত্যাহার কিভাবে করবেন?
এবার ৩১ নম্বর ধারার বিষয়টি বলি৷ এতে বলা হয়েছে, ‘কারো লেখায় যদি বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহলে সে অপরাধী হবে৷' এখন আমার লেখায় এরকম কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা, বা ঘটার উপক্রম হয়েছে কিনা- সেটা প্রাথমিকভাবে কে বিচার করবেন? সহজ উত্তর হচ্ছে- পুলিশ বিচার করবেন৷ এখন ধরা যাক, আসলেই একজনের লেখার কারণে কোন একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হলো, আপনি গেলেন তার বিরুদ্ধে মামলা করতে, পুলিশ যদি মনে করে অভিযোগ সত্য নয়, তাহলে সে মামলাই নেবে না৷ আসলে মূল বিষয়টা হচ্ছে- মামলা করছে কে? সরকারি দল তো বটেই, ছাত্রলীগ যুবলীগের কোন নেতা মামলা করলে পুলিশ তৎপর হবে৷ বিবাদী সে নারী হোক বা শিশু হোক, সময়টা যদি মধ্যরাতও হয়, ছুটে যেয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসবে৷
আচ্ছা, এই যে গ্রেপ্তার, তা সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হোক বা শিশু ইমনই হোক, এর পর থেকে এরা সবাই কি বর্তমান সরকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কিংবা ক্ষমতাসীন দল- আওয়ামী লীগের প্রবল ভক্ত হয়ে যাবে? কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর পর ইমন যখন সংশোধনী কেন্দ্র থেকে বের হবে, আমার তো মনে হয় না তার পক্ষে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা খুব সহজ হবে৷ এতদিন যে স্কুলে সে পড়ত, সেখানে সহপাঠীদের সঙ্গে আগের মত হেসে খেলে জবন যাপন কি আর সম্ভব হবে? পারবে কি সে আগের মত মন নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে? অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক? জেলখানা থেকে ক্লাসরুমের দূরত্ব কি তাদের কাছে অনেকটাই বেশি মনে হবে না?
অথচ কি ছিল তাদের অভিযোগ? এবারের এই করোনার সময় আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজেহাল অবস্থার বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই নগ্ন হয়ে গেছে৷ দুর্নীতি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত প্রকাশ্য ভিডিও কনফারেন্সে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে৷ কোন একটি খাতের এমন সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা তো আর হঠাৎ করে একদিনেই হয় না৷ এসব একটা ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ৷ যে কোন সেক্টরে অব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুললে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পূর্ববর্তী সরকারের উপর দায় চাপাতে দেখা যায়৷ সেভাবে কেউ যদি পূর্ববর্তী স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সমালোচনা করেই থাকেন, সেটাকে কি এভাবে গ্রেপ্তারযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করাটা খুবই জরুরি? এটা ঠিক আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অন্যরকম৷ কেউ অসুস্থ হলে, মারা গেলে আমরা তার সমালোচনা সাধারণত করি না৷ কিন্তু সেই ঐতিহ্যকে কেউ যদি না মানেন, আমরা তার নিন্দা করতে পারি, কিন্তু ঘাড় ধরে কি আর সংস্কৃতি-ঐতিহ্য শেখানো যায়৷
কেবল নেতাদের সমালোচনার কারণেই নয়, বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের জন্যও ইদানিং অনেকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে৷ করোনার এই সময়ে নানা ধরনের উল্টাপাল্টা খবর দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ ফেসবুক প্রায়ই পাওয়া যায় নানা পরামর্শ৷ রসুন, কালোজিরা, আদা, মধু- এসব খেলে নাকি করোনা ধরবে না৷ এরকম নানা উপদেশ প্রায়ই দেখা যায়৷ কোন একটা হয়তো পেলাম, কিছু পরেই আবার অন্য একজন জানালো ওই উপদেশের কোনটারই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই৷ এরকম তো আকসারই হচ্ছে৷ আগেও কি হতো না? ছোটবেলায় মা-বাবা পরম বিশ্বাসেই তো গায়ে নানা তাবিজ মাদুলি লাগিয়ে দিতে৷ এখনো অনেককে দেখি হাতে নানা রকম পাথরের আংটি পরেন৷ এসবের কি খুব কিছু বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? এখন তাদের বিরুদ্ধে যেয়ে কি মামলা করতে হবে? এরকম পাথরের উপকারিতা নিয়ে নানা রকম প্রতারণামূলক বাহারী বিজ্ঞাপনও দেখি বিভিন্ন মিডিয়াতে৷ সেগুলো নিয়ে তো কখনো কোন মামলা হয় না৷ অথচ করোনা নিয়ে ‘আপত্তিকর' মন্তব্যের কারণে করা মামলায় জেলে যেতে হয় লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক কলেজ শিক্ষককে৷ ওই ভদ্রলোক লিখেছিলেন, করোনার সময়ে কোলাকুলি বা মুসাফা করলে কোন ক্ষতি হবে না৷ তার দাবি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়৷ বিষয়টি তাকে বললেই হয়তো উনি ওটা প্রত্যাহার করে নিতেন৷ কিন্তু তাই বলে একজন কলেজ শিক্ষককে নিয়ে হাজতে ঢুকাতে হবে? তাহলে আইনের প্রয়োগটা আসলে নির্ভর করছে কিসের উপর- ঘটনার গভীরতার উপর নাকি বাদীর রাজনৈতিক বা সামাজিক দাপটের ওপর?
লেখাটি শেষ করার আগে সাম্প্রতিক একটা প্রসঙ্গে কিছু বলি৷ গেল সপ্তাহে ভারতের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বিষয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷ বাংলাদেশ প্রতিনিধির ক্রেডিট লাইনে প্রকাশিত সে প্রতিবেদনে খুবই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ‘খয়রাতি' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে- চীন নাকি খয়রাতি অর্থ দিয়ে বাংলাদেশকে তাদের কাছে টানতে চাইছে৷ এ নিয়ে বাংলাদেশে সকল মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠে (অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি)৷ বাংলাদেশে আনন্দবাজারের দুই জন প্রতিনিধি রয়েছেন৷ তারা আর্তনাদের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন যে, এই প্রতিবেদন তারা লিখেননি৷ এ সবই আমরা দেখেছি৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো- এটা কি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে পড়ে না? আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রাকাশিত লেখাটির কারণে আমরা কি অপমান, অপদস্ত কিংবা নিদেনপক্ষে বিরক্ত হইনি? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, আনন্দবাজার তো অন্য দেশের পত্রিকা, তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে মামলা হবে? কিন্তু তাদের প্রতিনিধি এদেশে রয়েছে৷ এদেরকে আসামী করে মামলা কেন হবে না? আনন্দবাজার পত্রিকা অবশ্য দুদিন পর একটা ভ্রম সংশোধন বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে৷ কিন্তু তারা সেখানে তারা একবারও বলেনি যে, লেখাটা তাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধির নয়৷ তাহলে? আর তাছাড়া, ভ্রম সংশোধনী দিলেই যদি দায়মুক্তি ঘটতো, তাহলে সেরকম ভুল স্বীকার তো নামে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরাও করেছিলেন, ভালুকার ওই শিশু ইমনও করেছিল৷ তারা যদি মাফ না পান, এরা কেন পাবেন? তাহলে এই আইন কি সবার জন্য নয়? নাকি এটা কোন আইনই নয়, কেবল ভয় দেখানোর অস্ত্র একটা? ওইসব গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সকলকে এই বার্তাটা দেওয়া- আমি যা পছন্দ করি না এমন কিছু বলো না, লিখো না৷ আমি মন খারাপ হলে- তুমি সাংবাদিক হও, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হও, এমনকি যদি অবোধ শিশুও হও, তোমার নিস্তার নাই৷