1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আসক-এর চরম উদ্বেগ

৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, ২০২৪ সালে ‘মব জাস্টিস',অর্থাৎ গণপিটুনিতে মৃত্যু দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে৷

https://p.dw.com/p/4oiDz
প্রতীকী ছবি
২০২৪ সালে গণপিটুনিতে মৃত্যু দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে (প্রতীকী ছবি)ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan

এমন মৃত্যু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলেও আসক-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০২৪ সালের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশ করা প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থা আসক আরো জানায়, বিদায়ী বছরটিতে বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, সংখ্যালঘু নির্যাতন পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, মাজারে ও বাউলদের ওপর হামলাও বেড়েছে।

প্রতিবেদনে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ‘চরম উদ্বেগজনক' হিসেবে বর্ণনা করে আসক জানায়, ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে নিহত হয়েছেন ৫৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ জন, খুলনা বিভাগে ১৪ জন, বরিশাল বিভাগে ৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫ জন,  রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ৪ জন নিহত হয়েছেন। আসক আরো জানায়, ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন।

২০২৪ সালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশি হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, পুলিশের গুলিতে তিনজন, পুলিশি হেফাজতে একজন আত্মহত্যা করেছেন, র‌্যাবের হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে একজন, বিজিবির ক্রসফায়ারে একজন, যৌথ বাহিনীর হেফাজতে সাতজন, নৌবাহিনীর নির্যাতনে একজন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ২১ জনের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বর্তমান অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর।

আসক-এর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম (এমআইএস) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মোট ৮৫৮ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১১ হাজার ৫৫১ জন। আসক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন নারী এবং ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের শিশু-কিশোর রয়েছে ১২৯ জন।

২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর, মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ১৪৭টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪০৮টি বাড়ি-ঘরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে ৩৬টিতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে ১১৩টিতে, মন্দির ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩২টি, হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে ৯২টি প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে। এসব ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮২ জন।

যে তথ্য দিয়েছি তাতে তুলামূলক পরিস্থতি বোঝা যায়: আবু আহমেদ ফয়জুল কবির

৫ আগস্টের পর থেকে কমপক্ষে ১৮টি মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং এসব হামলায় অন্তত একজন জন নিহত হয়েছেন।

২০২৪ সালে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।

বিগত সরকারের পতনের পর তিন দিনে উত্তরাঞ্চলে আদিবাসীর ওপর হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। ৫ আগস্ট দুপুর থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের প্রায় ৭০টি পরিবারের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। বিশেষ করে দিনাজপুরের ছয়টি উপজেলায় আদিবাসীদের ওপর হামলা করা হয়। দেশের একমাত্র সিধু-কানুর ভাস্কর্যও তখন ভাংচুর করা হয়।

আসক বলছে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে ৬৫জন মারা গেছেন। ১১ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯ দিনে বগুড়া কারাগারে বন্দি থাকা চার আওয়ামী লীগ নেতা কথিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। 

৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তবে মানবাধিকার প্রতিবেদনে দুই সরকারের সময়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নেই৷

এ প্রসঙ্গে আসক-এর সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘‘আমরা সারা বছরের মানবাধিকার প্রতিবেদন দিই। ফলে ৫ আগস্টের আগে ও পরের মানবাধিকার পরিস্থিতির তুলনা আমাদের প্রতিবেদনে নাই। তবে আমরা যে তথ্য দিয়েছি তাতে তুলনামূলক পরিস্থতি বোঝা যায়।”

তার কথা, ‘‘এক বছরে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২১টি, তার মধ্যে ৫ আগস্টের পর ১২টি। মাজারে ও বাউল শিল্পিদের ওপর হামলা আগেও হয়েছে, কিন্তু ৫ আগস্টের পর যেভাবে হয়েছে, এত ব্যাপকভাবে আগে হয়নি। মব জাস্টিস বা গণপিটুনির কথা যদি বলেন, তাহলে এটা বিগত যে-কোনো সময়ের চেয়ে কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বেশি হয়েছে। আমরা আগেও দেখেছি, সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর হমলা হয়। এবারও সেটা হয়েছে। বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে।”

জোরপূর্বক গুমের শিকার মাইকেল চাকমা বিচার চান

‘‘আমরা এইসব কারণেই বলেছি, এবারের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম এবং উদ্বেগজনক,'' বলেন তিনি।

আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ১. বছরের শুরুতেই একটি বিতর্কিত নির্বাচন এবং ২. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের বিদায়।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পূর্ববর্তী কমপক্ষে ৭৭টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এছাড়া নির্বাচনের দিন থেকে ২০ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩৭টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে।নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৭ জন নিহত এবং কমপক্ষে এক হাজার ৮৫৯ জন আহত হয়।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ গণভবন দখল করে লুটপাট ও ভাঙচুর করে। এছাড়াও আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাংচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এছাড়া কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হামলার ঘটনাও ঘটে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ভাষ্যমতে, পুলিশ, বিভিন্ন থানা, কারাগার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ছয় লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গুলি লুট হয়। ৪৫০টির বেশি থানা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫৮টি থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘‘এই সময়ে আমরা বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধাটা আমরা দেখছি না। ১৫ আগস্ট (ধানমন্ডি) ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি যারা শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন, তাদের মারধর করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় একজন নিহতও হয়েছেন। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছে, ভাংচুর করা হয়েছে। প্রথম আলো,  ডেইলি স্টারের সামনে মব তৈরি করা, সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা,হত্যা মামলা- এভাবে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর চাপ তৈরি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এগুলোও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।”

গুম কমিশনের সদস্য এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘৫ আগস্টের পর দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, সেকথা বলা কঠিন। কারাগারে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনিতে মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। তারপরে কোনো কোনো মহলের আস্ফালন এত বেশি যে, সেটা মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করছে।”

তার কথা, ‘‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক তৈরি করা  হচ্ছে সেটি মানুষকে আশঙ্কিত করছে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেভাবে টানা-হ্যাঁচড়া করা হচ্ছে, এটি সমর্থন করার কোনো উপায় নেই।একাত্তরকে বাদ দিয়ে কোনো ইতিহাস রচনার সুযোগ নেই। কেউ যদি এটাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে থাকে এটা তাদের অপরাধ।”

৫ আগস্টের পর মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সে কথা বলা কঠিন: নূর খান

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেমন ধারণ করতে হবে। তেমনি ২৪-এর চেতনাকেও ধারণ করতে হবে। এখন যে পরিস্থিতি চলছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

এর আগে মানবাধিকার রক্ষায় ১৬ দফা সুপারিশ করেছিল আসক৷১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে মানবাধিকার রক্ষায় ১৫ দফা দাবিও রাখা হয়েছিল। সুপারিশ ও দাবিগুলো একই রকম। তার মধ্যে আছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, যেমন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখতিয়ারবহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে।দেশের যে-কোনো নাগরিককে আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। মব জাস্টিসের মতো ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ধর্মীয় ও জাতীগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে দাবি ও সুপারিশে। বলা হয়েছে, ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে কোনো সহিংসতার ঘটনা যেন না ঘটে, তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।