মমতার জন্য বিমান ভাড়া করছে রাজ্য সরকার
৩১ আগস্ট ২০২১এই বিমানটি ফ্রান্সের জেসল্ট কোম্পানির। দুইটি ইঞ্জিন আছে বিমানে। আনন্দবাজার জানাচ্ছে, দুই তিন দিনের মধ্যে বিমানটি রাজ্যে এসে যাবে। দিল্লির একটি সংস্থার কাছ থেকে তিন বছরের চুক্তিতে বিমানটি ভাড়া নেয়া হবে। মাসে ৪৫ ঘণ্টার উড়ানের ভাড়া সংস্থাকে দিতে হবে। সেই ভাড়ার পরিমাণ হবে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার মতো। তার বেশি বিমানটি উড়লে ঘণ্টায় পাঁচ লাখ টাকা করে দিতে হবে। তাছাড়া দুই জন পাইলট, একজন বিমানসেবক ও একজন ইঞ্জিনিয়ার থাকবেন। তাদের খরচ অবশ্য সংস্থা বহন করবে।
ফলে অন্য খরচ বাদ দিলেও শুধু ভাড়া বাবদ দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা অন্তত দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। আনন্দবাজারের রিপোর্ট বলছে, আসন্ন উত্তরবঙ্গ সফরে মমতা এই বিমান ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া তিনি এখন বিভিন্ন রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাই তাকে অন্য রাজ্যে ও দিল্লিতে যেতে হতে পারে। অনেক রাজ্যের সঙ্গে কলকাতার বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। মুখ্যমন্ত্রী তখন এই বিমান ব্যবহার করতে পারেন।
তাহলে কি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিমানটি কেনা হলো?
মমতার ভাবমূর্তি এবং বিমান
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনো কালীঘাটে টালির চালের ছোট বাড়িতে থাকেন। তিনি হাওয়াই চটি ও সাধারণ শাড়ি পরেন। তিনি অতীতে বহুবার বলেছেন, সংসদ ও মন্ত্রী থাকার সময় এবং পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি কখনো বিমানের বিলাসবহুল ক্লাসে যান না। সাধারণত এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান চড়েন এবং সাধারণ যাত্রীর মতোই চড়েন। শশী থারুররা যাকে ক্যাটল ক্লাস বলেন, মমতা তাতেই চড়েন। এভাবে তিনি সরকারের বহু কোটি টাকা বাঁচিয়েছেন বলে মমতা অতীতে অনেকবার জানিয়েছেন।
এহেন মুখ্যমন্ত্রী কেন তার ও অন্য ভিআইপিদের জন্য এত টাকা দিয়ে একটা বিমান ভাড়া করলেন? গত বিধানসভা নির্বাচনে তার প্রচারের ট্যাগ লাইন ছিল, বাংলা তার নিজের মেয়েকে চায়। তার সঙ্গে এই বিমান ভাড়া করে রাজ্যে ও রাজ্যের বাইরে যাওয়া কি খাপ খায়? প্রবীণ সাংবাদিক মিলন দত্ত চাঁচাছোলা ভাষায় প্রশ্ন করেছেন, রাজনীতিককে বাইরে থেকে দেখে কি কিছু বোঝা যায়? তার জবাব, যায় না। ডিডাব্লিউকে মিলন বলেছেন, ''শরদ পাওয়ারকে দেখে, লালু প্রসাদকে দেখে কি কেউ বুঝতে পারবেন, তাদের কাছে কত টাকা আছে? আসলে রাজনীতিকদের পোশাক দেখে কিছু বোঝা যায় না।''
মিলনের মতে, ''পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির জায়গা থেকে যদি বিষয়টাকে দেখি, তা হলে এটাকে চরম বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এটার কোনো মানে হয় না। রাজ্য কী করে ও কেন এই অর্থ খরচ করবে? যে রাজ্যে টাটারা চলে যাওয়ার পর বিশেষ কোনো শিল্পও আসেনি, সেখানে কেন বিমানের পিছনে এই টাকা খরচ করা হবে?''
বিধান রায়ের কাহিনি
আরেক প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বিধান চন্দ্র রায়ের একটি কহিনি। গত শতকের পাঁচের দশকের কাহিনি। ক্রুশ্চেভ ও বুলগানিন ভারতে এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের কাজ দেখে তাকে একটি বিমান দিতে চাইলেন। বিধান রায় ক্রুশ্চেভকে বলেছিলেন, তার বিমান চাই না। মেডিক্যাল কলেজের জন্য কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি চাই। সেগুলি পেলে তিনি খুশি হবেন। তারা সেটাই দিয়েছিলেন।
সময়ের চাহিদা?
তবে সময় বদলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বদলেছে। প্রশাসনের কাজের ধরণের পরিবর্তন হয়েছে। লেখক ও সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী তাই এর মধ্যে কোনো অন্যায় দেখছেন না। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''নানা সময়ে, নানা জায়গায় জরুরি প্রয়োজনে যেতে হতে পারে। সবসময় সাধারণ বিমান পাওয়া যাবে এমন কোনো কথা নেই। তর প্রয়োজন থাকতে পারে, তাই এই প্লেন ভাড়া নেয়ায় আমার কোনো আপত্তি নেই। সময় তো বদলায়। তাই একসময় যা বিলাসিতা মনে হতো, এখন তা প্রয়োজন মনে হতেই পরে।''
বিমানের দরকার আছে?
মিলনের মতে, ''এই বিশেষ বিমানের কোনো দরকার নেই। রাজ্যে মানুষকে ভিক্ষা দেয়াটা সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি ভেবেছে। এই যে লক্ষ্মীর ভণ্ডার প্রকল্প, মেয়েদের ৫০০ টাকা করে সরকার দেবে, তার জন্য কী লাইন পড়ছে।'' মিলন বলেছেন, ''আমদের রাজ্যটা খুবই ছোট। সেখানে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এক রাতে পোঁছানো যায়। দরকার পড়লে গাদা গাদা হেলিকপ্টার ভাড়া পাওয়া যায়। সেখানে এরকম একটা বিমান পোষার দরকার কি?''
কাদের বিমান আছে?
মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহারের জন্য গুজরাট সরকার ১৯১ কোটি টাকা দিয়ে বিমান কিনেছে। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র সরকারের নিজস্ব বিমান আছে। তাতে মুখ্যমন্ত্রী চড়েন। দেশের প্রমুখ শিল্পপতিদের বিমান আছে। বেশ কয়েকজন শিল্পপতি-রাজনীতিকের নিজের বিমান আছে। বলিউড তারকারাও অনেকে বিমান ভাড়া করেন বা কেনেন।
অরুণাভ ঘোষের অভিযোগ
কংগ্রেস নেতা এবং হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ কলকাতা টকঝালমিস্টিকে কিছুদিন আগে এক সক্ষাৎকারে বলেছেন, ''রাজ্যে চুরির রাস্তা খুলেছে। ধরে নিলাম পুরোটাই মিথ্যা, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার ভায়রা ওই এলাকায় ৩৬-৩৭টি বাড়ি করেছে। অনেকের উন্নয়ন হয়েছে। নেতাদের হয়েছে।''
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের অভিযোগ বিরোধীরা করলেও তার কোনো প্রমাণ সামনে নেই।
বিমান-বিতর্ক
স্বাভাবিকভাবে বিমান কেনবার সিদ্ধান্ত নমিয়ে বিতর্ক হবে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকবে। এতদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুখ্যমন্ত্রী ও ভিআইপিদের জন্য বিমান কেনার কথা ভাবেনি। একবার জ্যোতি বসুর সল্টলেকের বাসভবনের কাছে একটি হেলিপ্যাড করার কথা ভাবা হয়েছিল। জ্যোতি বসু হেলিকপ্টারে যেতে হলে যাতে বাড়ির কাছ থেকেই উঠতে পারেন তার জন্য। সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিতর্কের জেরে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।