ভাসানচরে স্থানান্তর: কী বলছেন রোহিঙ্গারা
শুক্রবার রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচ ভাসানচরে পৌঁছেছে৷ তাদের অনেকে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা দেখে ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন৷ তবে জোর বা নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে৷
ভাসানচর প্রকল্প
প্রায় তিন হাজার একশ কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ভাসানচরে যাওয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার আলাদা ঘর পাচ্ছে, আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা৷ সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ৷
প্রথম ব্যাচ পৌঁছেছে
বাসে ও জাহাজে করে প্রথম ধাপে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা শুক্রবার ভাসানচরে পৌঁছেছেন৷ পরে তাদের অনেককে মোবাইল ফোনে কক্সবাজারে থাকা সঙ্গীদের ভাসানচরের খবর দিতে দেখা গেছে৷ কেউ কেউ ভিডিও কলও করেছেন৷
বাবা-মাকে আনতে চান হোসেন
কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্প থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসনচরে গেছেন মোহাম্মদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে অনেক ভালো লাগছে৷ আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাবো৷ ওখানে গিয়ে তাদের (বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার) নিয়ে আসবো৷ তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসবো৷’’
‘আল্লাহ মিলায়ে দিছে’
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে গেছেন মোহাম্মদ জোবায়ের৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না৷ জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি৷ আল্লাহ আমাদের মিলায়ে দিছে৷’’
নিরাপত্তাবোধ
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া আবদুর রহমান এখন নিজেকে কিছুটা নিরাপদ ভাবছেন৷ ‘‘ওখানে (বালুখালী ক্যাম্পে) ঘরের বেড়া কেটে চুরি করে নিয়ে যেতো৷ ঘুমিয়ে থাকলে ছুরিও মারতো৷ এখানে তা পারবে না৷ যে ঘরটা পেলাম, সেটা খুবই নিরাপদ৷ কেউ চাইলেই চুরি করতে বা ঘরে ঢুকতে পারবে না৷’’
‘লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে’
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ভাসানচরে যাওয়া আব্দুস সামাদ বলেন, ‘‘এখানে এসে খুব ভালো লাগছে৷ ঘরবাড়ি অনেক৷ অনেক বড় বড় রুম৷ এখানে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে৷ বড় খেলার মাঠ আছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে জায়গা কম৷ মানুষ অনেক৷ একজন বের হলে আরেকজন বের হওয়ার জায়গা থাকে না৷’’
পার্থক্য
ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য সম্পর্কে জমিনা আক্তার বলেন, ‘‘এখানে বেশি ভালো লাগছে৷ ভালো ঘর, থাকার জায়গা ভালো৷’’
নির্যাতনের অভিযোগ
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত ৬০ বছর বয়সি শরণার্থী সুফিয়া খাতুন এএফপিকে জানান, ‘‘আমার ছেলে যেন ঐ দ্বীপে যেতে রাজি হয় সেজন্য তারা আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে, তার দাঁত ভেঙে ফেলেছে৷ আমি এখানে তাকে ও তার পরিবারকে হয়ত শেষবারের মতো দেখতে এসেছি৷’’
‘নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না’
ট্রানজিট ক্যাম্পে উপস্থিত আরেক শরণার্থী হাফেজ আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘‘গত দুইদিন ধরে আমার ভাই নিখোঁজ ছিল৷ আমরা জানতে পেরেছি, সে এখানে আছে৷ এখান থেকে তাকে দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সে সেখানে নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না৷’’
জাতিসংঘের আশঙ্কা, অভিযোগ
জাতিসংঘের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ভাসানচরে পানি উঠে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠতে পারে৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তাদের৷ ভাসানচরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে রোহিঙ্গারা যেন ‘স্বাধীন ও তথ্যসমৃদ্ধ’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
‘ভুল ব্যাখ্যা’ না দেয়ার অনুরোধ
রোহিঙ্গারা ‘স্বেচ্ছায়’ ভাসানচরে গেছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ‘‘জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একমাত্র বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হওয়া উচিত প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সেটাই একমাত্র স্থায়ী সমাধান৷ একইসঙ্গে বাংলাদেশের আন্তরিক চেষ্টাকে খাটো করা ও ভুল ব্যাখ্যা না করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি৷’’
বিএনপির বক্তব্য
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ায় তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি৷ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘আত্মহনন’ বলেও আখ্যায়িত করেছে দলটি৷
জেডএইচ/এসিবি (বিডিনিউজ, এএফপি, এপি)