সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। কলকাতার কাছেই নরেন্দ্রপুরে পুলিশের উপর হামলা হয়। একজন সাব ইন্সপেক্টর (এসআই)-কে কোপানো হয়। পুলিশ কোপানোর মতো ঘটনার পর তিনজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, ২০২২ সালে একটি শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির বাড়িতে অভিযান চালাতে গিয়েছিলেন এসআই-সহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ওই অভিযুক্তরা নির্দেশ সত্ত্বেও আদালতে হাজিরা দিচ্ছিল না। তাই তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। অভিযুক্তদের ধরতেই পুলিশ সেখানে গিয়েছিল। তখন এসআইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারা হয়। কনস্টেবলরা গিয়ে তাকে বাঁচায়। এরপর তিন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযুক্তদের পরিবারের অভিযোগ, মধ্যরাতে মত্ত অবস্থায় পুলিশ হামলা চালায়। তারা দরজা ভাঙে। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙে। সিসিটিভির তার কেটে দেয়।
একই দিনে উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখরে এবং মুর্শিদাবাদের ডোমকলে পুলিশ আক্রান্ত হয়। গোয়ালপোখরে তো একজন অভিযুক্তকে ইসলামপুর আদালতে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ। সেসময় অভিযুক্ত গুলি চালায়। দুইজন পুলিশ কর্মী গুরুতর আহত হয়। অভিযুক্ত পালায়। সে পিস্তল পেলো কোথা থেকে? ইসলামপুরের পুলিশ সুপার জবি থমাস জানিয়েছেন, এটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এখানেই সর্ষের মধ্যে ভূতের বিষয়টি ওঠে। পুলিশের অগোচরে একজন বন্দির হাতে কী করে পিস্তল চলে আসে, এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। মুর্শিদাবাদের ডোমকলে চুরির অভিযোগে রানা শেখকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে চুরির জিনিস উদ্ধার করতে যায় পুলিশ। তখন বাড়ির লোকজন পুলিশের উপর চড়াও হয়। রানা শেখ পালায়। তারপর গোটা গ্রামে তল্লাশি চালাবার সময় পরিত্যক্ত একটি শৌচাগার থেকে রানা শেখকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর দিন কয়েক পরে ভাঙড়ে পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। জুয়ার ঠেক ভাঙতে গিয়েছিল পুলিশ। সেখানে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পরই পুলিশকে মারধর করা হয়। একজনের ভালোমতো আঘাত লেগেছে। তিনজন সামান্য আহত হন। মিডিয়ার রিপোর্ট বলছে, স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার উপস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটেছে।
পরপর এতগুলি ঘটনার উল্লেখ করতে হলো এটা দেখাতেই যে, পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের উপর আক্রমণের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তবে এমন নয় যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনা ঘটছে। দিল্লিতে কিছুদিন আগে একটি বুলেট মোটরসাইকেলকে থামায় পুলিশ। বাইকে এমনভাবে সাইলেন্সার লাগানো ছিল, যাতে প্রচুর শব্দ হয়। পুলিশ যখন চালান কাটছে, তখন বাবাকে ডেকে পাঠায় বাইক-আরোহী ছেলে। তারপর বাবা-ছেলে মিলে পুলিশকে পেটায়। দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেরালার কোঝিকোড়ে চারজন গাড়িতে বসে মদ খাচ্ছিল। পুলিশ তাদের ধরার পরেই তারা মারধর শুরু করে। পুনায় গতবছর পুলিশ একটা ঝগড়া থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়।
কেন আক্রান্ত হয় পুলিশ?
উপরের ঘটনাগুলো একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিচ্ছে, বিভিন্ন কারণে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। কখনো আসামির হাতে, কখনো অভিযুক্তের পরিবারের হাতে, কখনো জুয়ার ঠেক ভাঙতে গিয়ে, কখনো পথের নিয়মভঙ্গকারীদের হাতে।
যে কোনো সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আইনের রক্ষকদের বিষয়ে খুব একটা সদর্থক কথা শুনতে পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ তা হলো, তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথায় কাজ করে। তাছাড়া ভারতে দুর্নীতির সঙ্গে পুলিশের যোগের অভিযোগ তো প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। কলকাতায় ‘আজকাল’ কাগজের জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত সাংবাদিক লেখক গৌরকিশোর ঘোষের হাত ধরে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে সেসময় ওই কাগজে নিয়মিত ছবি প্রকাশিত হতো, ট্রাফিক পুলিশ কীভাবে ট্রাক, গাড়ির চালকদের কাছ থেকে পয়সা নিচ্ছে।
ভারতে আরেকটি প্রবাদও চালু আছে, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। আমাদের দেশের সংবিধান বলছে, কেউই আইনের উপরে নয়। অথচ, সাধারণ মানুষের হামেশাই অভিযোগ করেন, কোনো পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগই করা যায় না। করলে নাজেহাল হতে হয়। পুলিশের হাতে এত ক্ষমতা আছে যে তারা মামলা দিয়ে দিতে পারে। তারপর আিন-আদালতের চক্রে ঘুরতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের একটি ওয়ান লাইনার প্রায় প্রবাদের চেহারা পেয়েছে, সেটা হলো, ল উইল টেক ইটস ওন কোর্স, অর্থাৎ আইন তার নিজস্ব পথে চলবে। কিন্তু আম ভারতীয়র অভিজ্ঞতা কি তাই? এমন নয় যে সাধারণ মানুষের কোনো দোষ নেই। তারা পুলিশকে কিছু টাকা দিয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে চান। ফলে একতরফা পুলিশকে দোষ দেয়া যায় না। যে কোনো ফুটপাথে, রাস্তায়, দোকান সাজিয়ে বসে পড়া, বাড়িতে বেআইনি নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা কারণে-অকারণে সাধারণ মানুষই পুলিশকে ‘নজরানা' দেয়। ফলে অভিযোগের আঙুলটা দুই তরফের দিকেই ওঠে।
কিন্তু অন্য গুরুতর অভিযোগ হলো, পুলিশ ‘দলদাস’ হয়ে গেছে। তারা ক্ষমতাসীন দলের কথায় কাজ করে, সক্রিয় হয় বা নিস্ক্রিয় থাকে। সেখানে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দলের কর্মী সকলের দিকেই অভিযোগের আঙুল ওঠে। এর ফলে কী হয়েছে? একসময় কলকাতা পুলিশকে দক্ষতার নিরিখে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হতো। এখন তাদের সেই দক্ষতা তাদের আছে কি? রাজনৈতিক প্রভুদের কথায় ওঠাবসা করতে গেলে সেটা কি সম্ভব? এটা একটা অদ্ভূত চক্র। সেই চক্র চলতে থাকে, চলতেই থাকে।
পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কার
ভারতে পুলিশ ব্যবস্থার মূল কাঠামো তৈরি হয়েছিল ১৮৬১ সালে। তারপর সেই কাঠামোর উপর কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু মূল রূপটি একই আছে। দেশের স্বাধীনতার পর পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে অনেকগুলি কমিটি বা কমিশন হয়েছে। সাম্প্রতিক কমিশনের মধ্যে রয়েছে মালিমথ কমিশন, রিবেইরোর নেতৃত্বাধীন কমিশন, পুলিশ ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য পদ্মনাভাইয়া কমিশন, ন্যাশনাল পুলিশ কমিশন। নানা কমিশন, কমিটি হয়েছে, তারা সুপারিশ করেছে, তার কিছু গৃহীত হয়েছে, কিছু হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, যে সব কমিশন, কমিটির নাম করা হয়েছে, তা সবই কেন্দ্রীয় স্তরে হয়েছে। কিন্তু ভারতে পুলিশ হলো রাজ্য সরকারের অধীনে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আধা সামরিক বাহিনী আছে, কিন্তু আদালতের নির্দেশ বা রাজ্য সরকারের অনুরোধ ছাড়া তা মোতায়েন করা যায় না। কেন্দ্র চাইলে রাজ্যে গিয়ে তারা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী, কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতে পারে। কিন্তু পুরো পুলিশি ব্যবস্থা রয়েছে রাজ্য সরকারের হাতে।
সেই কথা মাথায় রেখে একবার দেখে নেয়া যাক পুলিশ বাহিনীর সামনে কী সমস্যা রয়েছে এবং তা নিয়ে কমিশন, কমিটি বা সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছে। প্রথমেই আসা যাক, পুলিশের সংখ্যা নিয়ে। জাতিসংঘের মতে, এক লাখ মানুষ পিছু ২২২ জন পুলিশ থাকা উচিত। ভারতে রয়েছে ১৫২ দশমিক ৮০ শতাংশ। নারী পুলিশের সংখ্যা ১১ দশমিক সাত শতাংশ। নীতি আয়োগ বলেছে, পুলিশ বাহিনীতে ৩৩ শতাংশ মেয়েদের নিয়োগ দেয়া উচিত। তাদেরকে পাসপোর্টের ঠিকানার ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে নানান নন-কোর কাজে লাগানো উচিত। পদ্মনাভ কমিশন বলেছে, পুলিশে নিয়োগের বিষয়ে একটা মাপকাঠি তৈরি করা উচিত।
পুলিশের দায়বদ্ধতা ও জনগণের আস্থা না থাকা, নিয়োগের রাজনীতিকরণ, সিবিআই নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের মতো বিষয়ে প্রকাশ সিং মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট বোর্ডের হাতে বদলি, পোস্টিং, প্রমোশনের বিষয়টি থাকা উচিত। ডিএসপি, এসপি, এসএইচও(ওসি)-কে অন্তত দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিতে হবে।
পুলিশ ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক খারাপ হওয়া, দুর্নীতি, খারাপ ব্যবহার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায় হলো, পুলিশ কমপ্লেইনটস অথরিটি পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগের বিচার করুক। অপরাধের চরিত্র বদল, মামলার শাস্তি কম হওয়া, তদন্ত ঠিকভাবে না হওয়া, বন্দিমৃত্যু নিয়ে মালিমথ কমিশনের রায় হলো, অপুরাধী ধরার পুরো পদ্ধতি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি ঢেলা সাজানো দরকার। দ্বিতীয় পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল, অপরাধের তদন্ত ও আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কাজ আলাদা করা উচিত।
পরিকাঠামো না থাকা, অস্ত্রশস্ত্র, নজরদারি সংক্রান্ত পরিকাঠামো না থাকা নিয়ে সোলি সোরাবজি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন বাতিল করে নতুন মডেল পুলিশ আইন চালু করা উচিত। নীতি আয়োগের মতে, পুলিশের আধুনিকীকরণ নিয়ে তহবিল আলাদা করতে হবে। মডেল পুলিশ আইন তৈরি করে সেটা অনুসরণ করতে হবে।
এসব সুপারিশ আছে, প্রচুর চিন্তা-ভাবনা হয়, আলোচনা হয়, তারপর পরিস্থিতি যে তিমিরে থাকার, সেই তিমিরেই থাকে।
মিন্ট-এ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে সেন্টার ফর স্টাডি ইন ডেভলাপিং সোসাইটি(সিএসডিএস)-এর সমীক্ষা বলছে, পুলিশের প্রতি আস্থা আছে, এমন ভারতীয়র সংখ্যা ২৫ শতাংশের কম। ২০১৬ সালের শেষে দেখা যাচ্ছে, ৩০ শতাংশ মামলার তদন্তের কাজ বাকি। সেই সময়ের হিসাবে ভারতে পুলিশের অনুমোদিত পদ হলো ২৮ লাখ। আছে ১৯ লাখ। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় সবচেয়ে কম। প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় সেখানে একশ জন পুলিশও নেই।
এই ঘাটতি পূরণের জন্য পশ্চিমবঙ্গে কী করা হলো? সিভিক ভল্যান্টিয়ার নিয়োগ করা হলো। ২০১১ সালে বলা হয়েছিল, সিভিক ভল্যান্টিয়ার হতে গেলে মাধ্যমিক পাস হতে হবে। পরে বলা হয়েছে, ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়লেই হবে। বয়স হতে হবে ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাদের বেতন হবে মাত্র ১০ হাজার টাকা। এই সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন তাদের সংখ্যা হলো এক লাখ ২৩ হাজার ৬৯৬ জন। একজন কনস্টেবলের বেতন মাসে ৩২ হাজার টাকার মতো। তার তিনভাগের একভাগ টাকা দিয়ে ভল্যান্টিয়ার নিয়োগ করা হচ্ছে। তারা সব কাজই করছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এই ভল্যান্টিয়াররা সকলেই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য-সমর্থক। আরজি কর-কাণ্ডে এখনো পর্যন্ত একমাত্র শাস্তিপ্রাপ্ত সঞ্জয় রায় সিভিক ভল্যান্টিয়ার ছিল। সে বাইকে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে ঘুরত।
পুলিশ সংস্কারের যদি এই হাল হয়, তাহলে মানুষের প্রত্যাশা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।