1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বৈশ্বিক দক্ষিণের শঙ্কর কূটনীতি ও গোলকধাঁধায় বিশ্বরাজনীতি

২১ জুন ২০২৪

বিশ্বরাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ত পরিবর্তনশীল৷ এ যেন ‘সম্মুখে রয়েছে পড়ি যুগ-যুগান্তর; অসীম নীলিমে লুটে ধরণি ধাইবে ছুটে; প্রতিদিন আসিবে, যাইবে রবিকর‘ (ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)৷

https://p.dw.com/p/4hLw2
শি জিন পিং ও মোহাম্মদ বিন সালমান
চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিমাদের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের পাশাপাশি বৈশ্বিক দক্ষিণ বলয়ের উপস্থিতি বিশ্বরাজনীতিকে বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে৷ এই মেরুকরণ বিশ্বরাজনীতিতে সনাতনী জোট গঠনের ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছেছবি: Royal Court of Saudi Arabia/AA/picture alliance

বিশ্ব রাজনীতির একেকটি ধারণা নতুন আরেকটি ধারণার আবির্ভাবে রূপান্তরিত হয়েছে৷ পুরাতন রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলীন হয়ে বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছে৷ যেমন নগররাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছিল সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায়৷ সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিবর্তনে ইউরোপে জন্ম নিয়েছিল জাতিরাষ্ট্র৷ জাতিরাষ্ট্রের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা৷ এই দুইয়ের আবর্তে বিশ্বব্যাপী দেখে ফেলেছে বেশ কিছু যুদ্ধ৷ সম্মুখযুদ্ধের সংখ্যা হ্রাস পেলে স্নায়ুযুদ্ধ ও দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অধীনে চলেছে গোটা বিশ্ব৷ তিন দশক ধরে চলা এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার আবারও রূপান্তর ঘটে চলতি শতাব্দীতে৷ চীন ও রাশিয়ার উত্থান, তাদের মিত্রতা এবং দেশ দুটির প্রভাব বলয়ের সীমানা বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয় ত্রিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কপালে চিন্তারেখা বাড়ায়৷ সবশেষ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশসমূহের হাইব্রিড বা শঙ্কর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের হিড়িক সনাতনী জোটবদ্ধ ও পরাশক্তির প্রতি আনুগত্যের রাজনীতির ভিতকে অনেকখানি নাড়িয়ে দিয়েছে৷ বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণ বলয়ের সৃষ্টির কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এখন বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি বহুকেন্দ্রিক মেরুকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন৷

বিশ্বরাজনীতির স্বরূপের এত পরিবর্তন বা রূপান্তর প্রক্রিয়ায় তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়৷ প্রথমটি হলো বিশ্বরাজনীতিতে স্বার্থ ও আধিপত্যের সংঘাত কখনই থামেনি৷ শক্তি প্রদর্শন, পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা সবসময় কোনো না কোনো রূপে বিদ্যমান ছিল৷ নতুন শক্তির উত্থানে পুরাতন শক্তির অবস্থান নড়বড়ে হতে দেখা গেলেও আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা সর্বদা বিদ্যমান৷ ফলে বিশ্বব্যাপী একক কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা কখনই প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বৈরিতার পরিবর্তনশীলতা বিশ্বরাজনীতির নতুন গতিপথ তৈরি করে৷ যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌভিয়েত ইউনিয়ন একসঙ্গে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল সেই মৈত্রী শক্তিগুলো পরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিল, যা থেকে জন্ম নেয় স্নায়ুযুদ্ধ৷ আমেরিকা ও ইরানের সুসম্পর্ক ১৯৭০ দশকের শেষে ক্রমশ খারাপ হতে হতে তা সাপে-নেউলে হয়ে পড়ে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীন-আমেরিকা এক হয়ে লড়লেও বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোরিয়া যুদ্ধের জের ধরে তাদের সম্পর্ক বিপরীত রূপ ধারণ করে৷ তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো গত দেড় দশকে বিশ্বরাজনীতির গতিপথ ও প্রকৃতি যত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এতটা দ্রুত আর কখনই হয়নি৷ এ সময়ে আঞ্চলিক জোট ও বিরোধী জোট গঠনের প্রবণতা যেমন বাড়ছে তেমনি হাইব্রিড কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রবণতাও বেড়েছে৷ চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিমাদের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের পাশাপাশি বৈশ্বিক দক্ষিণ বলয়ের উপস্থিতি বিশ্বরাজনীতিকে বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে৷ এই মেরুকরণ বিশ্বরাজনীতিতে সনাতনী জোট গঠনের ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারবাদী তত্ত্বের আলোকে জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়েছিল৷ ২৫ বছরের মধ্যে সংঘটিত আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ এই জাতিপুঞ্জের পতন ঘটায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় আদর্শিক দ্বন্দ্ব৷ তখন স্নায়ুযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই৷ যার অবসান ঘটে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে৷ এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি পরিচালিত হয়৷ ফ্রান্সিস ফুকায়ামা যেটিকে ইতিহাসের সমাপ্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন৷ তাঁর মতে, সমাজতন্ত্র পতনের মাধ্যমে সকল মতাদর্শের উপর পশ্চিমা লিবারেলিজম বা উদারনীতি বিজয় লাভ করেছিল এবং আমেরিকা এই লিবারেল ডেমোক্রেসিকে হাতিয়ার বানিয়ে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার অব্যাহত রেখেছিল৷ কিন্তু গত দেড় দশকের মধ্যে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ‘চেকবুক ডিপ্লোমেসি‘র প্রসার, কয়েকটি নতুন অর্থনৈতিক শক্তির আর্বিভাব, কোভিড-১৯ অতিমারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে চীন-রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের বিস্তারে হাইব্রিড কূটনীতির প্রসার বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণকে উল্লেখযোগ্যভাবে পাল্টে দিয়েছে৷ সমকালীন ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিশ্ব ব্যবস্থার প্রকৃতি ও গতিপথ নিয়ে তাই বিতর্ক অনেক তীব্র হচ্ছে৷ অনেকে বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ১৯১৪ সালের মতই অনিশ্চিত বলে মন্তব্য করেছেন৷ অনেকে আবার চীন-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনী সঙ্কেত বলে ভাবছেন৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরাইল-হামাস সামরিক সংঘাত বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়৷ বরং এগুলো একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ও অন্যদিকে ড্রাগনবিয়ার মোডাস ভিভেন্ডির অধীন চীন এবং রাশিয়ার মধ্যকার শুরু হওয়া স্নায়ুযুদ্ধের বহিঃপ্রকাশ৷ বিশ্লেষকদের ধারণা, সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির সংকট ও গতিপ্রকৃতিগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বিশ্বরাজনীতি একক বা দ্বিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় আর পরিচালিত হচ্ছে না৷ বরং এটি এখন বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় অবস্থান করছে, যেখানে পরাশক্তির একচ্ছত্র আধিপত্যের ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ৷   

মার্কিন যৌথবাহিনির সাবেক প্রধান জেনারেল ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকাকে বলেছিলেন, বিশ্ব তিন বলয়ে বিভক্ত৷ এই তিন বলয় হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া৷ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক দক্ষতার জন্য সমসাময়িক বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অন্যতম বড় মাথাব্যথা হলো চীন৷ সে চিন্তাকে কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে আরেক পরাশক্তি রাশিয়ার সাথে দেশটির মিত্রতা৷ চীন যেভাবে বৈশ্বিক দক্ষিণ ও আফ্রিকার দেশসমূহের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজের প্রভাব বলয় বাড়াচ্ছে তা পশ্চিমাদের চিন্তার বলিরেখার ভাঁজ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ বেল্ট অ্যাান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীনের অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে৷ চেকবুক ডিপ্লোমেসির অধীনে সড়ক ও নৌপথে চীনের সাথে যুক্ত হবে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং এক-তৃতীয়াংশ অর্থনীতি৷ এ অঞ্চলজুড়ে চীনের রাজনৈতিক প্রভাবও বাড়ছে৷ অপরদিকে ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা দেশটির জন্য শাপেবর হয়েছে৷ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয়ান মিত্ররা৷ এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে উঠেছে চীন৷ গত বছর দেশ দুটির মধ্যে ২৪ কোটি ডলার বাণিজ্য হয়৷ রাশিয়া সৌদি আরবকে হটিয়ে চীনের বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে৷

বিশ্বরাজনীতিতে জোট গঠনের ধারণা নতুন কিছু নয়৷ পরাশক্তিগুলো নিজেদের শক্তি বাড়ানো এবং দুর্বল দেশগুলো নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে কৌশলগত অবস্থান থেকে পারস্পরিক সহযোগিতার আশায় জোট গঠন করে৷ এই জোট শুধু এক বা একাধিক দেশকে সুরক্ষা দিতে গঠিত হয় না, পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের প্রভাব বিস্তারের বলয়কে রোধ করে৷ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট এবং বলয়কে ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে থাকে৷ এজন্য বিশ্বরাজনীতিতে মেরুকরণ বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত একটি শব্দ৷ জোট ও পাল্টা জোট গঠনের প্রবণতা এবং জোটগুলোর গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও মেরুকরণ নির্ধারণ করে থাকেন৷

গত বছর কাছাকাছি সময়ের মধ্যে তিনটি বড় জোটের (জি-৭, জি-২০ ও ব্রিকস) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ পরপর তিনটি বড় সম্মেলনের ঘোষণা ও ফলাফল বিশ্বব্যাপী চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে বড় আকারে সামনে নিয়ে আসে৷ জি-৭ সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান দেখতে পাওয়া গিয়েছিল৷ জি-২০ সম্মেলনে চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ও পশ্চিমাদের অবস্থান ছিল৷ কিন্তু ব্রিকসের সম্মেলনের ভূমিকা ছিল পশ্চিমা বিরোধী৷ ব্রিকস এবং জি-২০ সম্মেলনের ঘোষণা ও ফলাফল বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বিশ্ব রাজনীতি এখন আর আমেরিকা ও পশ্চিমা বনাম চীন-রাশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ এখানে মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক দক্ষিণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে৷ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর হাইব্রিড কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ আগ্রহ কিংবা পরাশক্তি কেন্দ্রিক মেরুকরণ থেকে সরে এসে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নীতি বিশ্বরাজনীতির গতিপথে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মূলত কোনো এক পরাশক্তির পক্ষে যোগ দিতো৷ কিন্তু গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে কোনো একক পরাশক্তির সাথে জোট গঠন না করে কার্যসিদ্ধিমূলক জোট গঠন করছে এ অঞ্চলের দেশগুলো৷ তুরস্ক, ইসরাইল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত ও ইরান বন্ধু থেকে শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর সাথে হাইব্রিড সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছে৷ যেমন, তুরস্ক একদিকে ন্যাটোর সদস্য দেশ, অন্যদিকে ব্রিকসে যোগ দিতে চায়৷ আবার রাশিয়া থেকে তারা সমরাস্ত্র আমদানি করছে৷

এই হাইব্রিড কূটনীতিকে আরো প্রসারিত করেছে বিশ্বরাজনীতিতে বৈশ্বিক দক্ষিণের উত্থান৷ বৈশ্বিক দক্ষিণের সদস্য ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুর্কি বিশ্বরাজনীতিতে সুইং স্টেটস বলে খ্যাত৷ বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক দেশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী৷ সুইং স্টেটগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা পরিকল্পনাকে সহায়তাদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে৷ গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই দেশগুলো৷ অনেক বিশ্লেষক বৈশ্বিক দক্ষিণের সাথে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মিল খোঁজার চেষ্টা করলেও এটি কোনো কৌশলগত রাজনৈতিক এবং সামরিক জোট নয়৷ ভৌগোলিক অঞ্চল না হলেও বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলোর সব কটি উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত দেশ যারা ঔপনিবেশিকতা, শোষণ ও উন্নয়নের একটি সাধারণ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে একীভূত৷ বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর বেশিরভাগই হাইব্রিড কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে কখনও পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছে আবার কখনও পশ্চিমা বলয় থেকে দূরে থাকছে৷ যেমন চীনকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গঠিত কোয়াডের সদস্য ভারত৷ অন্যদিকে চীনের সাথে ব্রাজিল আর রাশিয়ার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকা মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে৷ অর্থাৎ বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর কাছে পরাশক্তির আনুগত্যের চেয়ে জাতীয় স্বার্থে হাইব্রিড কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে৷ বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো এখন তিন পরাশক্তির কাছে সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে৷ ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক ও উপেক্ষিত বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেদের উপস্থিতি নতুন করে জানান দেয়ায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চতুর্থ বলয়ের জন্ম দিয়েছে৷ যে কারণে তাত্ত্বিকরা বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন৷

বিশ্বরাজনীতিতে চতুর্থ বলয়ের এই উত্থান যদি বেগবান হয় তাহলে হার্ভার্ডের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসনের ‘থুসিডাইডস ট্র্যাপ' তত্ত্ব কার্যকর হতে পারে৷ থুসিডাইডিস ফাঁদের মূল কথা হলো, উদীয়মান কোনো শক্তি প্রতিষ্ঠিত কোনো শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে সংঘাত বা যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়৷ যেমনটা এথেন্সের উত্থানে প্রতিষ্ঠিত শক্তি স্পার্টার মধ্যে দেখা দেয়া আতঙ্ক যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল৷ চীনের উত্থান ও রাশিয়ার পুনরুত্থান বিশ্বরাজনীতিতে ত্রিমাত্রিক বলয়ের জন্মই ‍শুধু দেয়নি, স্নায়ুযুদ্ধ ২.০'কে ঘনীভূত করেছে৷ তার সাথে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর হাইব্রিড কূটনীতি কৌশল আঞ্চলিক উত্তেজনা ও বৈশ্বিক অস্থিরতাকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করবে৷ বৈশ্বিক দক্ষিণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চতুর্থ বলয়ের উত্থান ও প্রসার বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার বিস্তার কিংবা সমাধান নিঃসন্দেহে একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক রূপরেখা নতুন করে নির্মাণ করবে৷ কারণ পরিবর্তিত বাস্তবতায় হাইব্রিড কূটনীতি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণকে জটিল করে তুলছে৷ এর মাধ্যমে হয়তো পুরাতন শক্তিবলয় ভেঙ্গে পড়ে নতুন শক্তিবলয় গড়ে উঠবে৷ এই সমীকরণ নতুন নতুন হুমকি তৈরি করতে পারে৷ কারণ পরাশক্তির একচ্ছত্র আধিপত্যের ধারণা যখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তখনই পৃথিবীতে সংঘাত বেঁধেছে৷