বলছি জার্মানির কথা৷ ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির এই দেশ দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর নিজেদের বেশ খানিকটা সামলে নিয়েছে৷ এখন আর যা-ই হোক সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে রাজি নয় জার্মানি৷ অবস্থা এমন যে দেশটির সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু দুর্বলতার কারণে শিরোনাম হয়েছে অনেকবার৷ বিমান বাহিনীর বিমান যখন-তখন অকেজো হয়ে যায়, সমরাস্ত্রগুলো সেকেলে, পরমাণু বোমা নেই - এমনকি প্রতিরক্ষাখাতে বাজেট বাড়াতেও বড় অনিহা ইউরোপের কেন্দ্রের দেশটির৷
জার্মানি বরং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজেদের পাশাপাশি জোটভুক্ত দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোর দিয়েছে৷ জোটের কোনো দেশ বিপদে পড়লে সেদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে৷ মানবতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির এই মানসিকতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি অনেকদিন ধরে৷ কয়েক মাস আগে ওলাফ শলৎস ক্ষমতা গ্রহণের আগের ষোল বছর দেশটির চ্যান্সেলর ছিলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ আমি দেখেছি কীভাবে তিনি একের পর এক ঝড় সামলে জার্মানিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন৷ দেশটির বিদেশ নীতি যেমন নিজের দেশের জনগণের স্বার্থ এবং বাণিজ্যবান্ধব, তেমনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইস্যুতেও সোচ্চার নিজের ভয়ঙ্কর অতীত ইতিহাসের দায় মেনে নিয়ে এগিয়ে চলা জার্মানি৷
জার্মানির এই এগিয়ে চলার মাঝে প্রতিরক্ষার বিষয়টি যে উপেক্ষিত হচ্ছে সেটা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ কখনো বুশ, কখনো ওবামা, কখনো ট্রাম্প, কখনো বাইডেন তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেলকে প্রতিরক্ষা খাত শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন, গ্যাস-তেলের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে বলেছেন৷ জার্মানি যে ন্যাটো জোটের প্রত্যাশামতো প্রতিরক্ষা খাতের বাজেট বাড়াচ্ছে না, সেটা নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে ম্যার্কেলের বিরোধ অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে এসেছিল৷ বিরক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি থেকে ন্যটো জোটের আওতায় থাকা কিছু মার্কিন সৈন্যও ফেরত নিয়েছে সেই সময়৷
কিন্তু ম্যার্কেল প্রতিরক্ষা খাতকে আলাদা করে গুরুত্ব দেননি৷ তিনি বরং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা কমাতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে ধারাবাহিকভাবে সরিয়ে নিয়েছেন তার দেশকে৷ জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি থেকেও ক্রমশ সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশের বেশি খরচেও রাজি হননি৷
ম্যার্কেলের জার্মানি বরং মার্কিন আপত্তি সত্ত্বেও রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে৷ গত পঞ্চাশ বছর ধরেই এই নির্ভরশালীতা ধরে রেখেছে জার্মানি৷ শুধু তাই নয়, নতুন এক পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া থেকে সরাসরি আরো গ্যাস আনার প্রক্রিয়াও প্রায় সম্পন্ন হয়েছে৷ এতে রাশিয়া যেমন লাভবান, জার্মানিও৷
ম্যার্কেলের এই নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন না আনার পক্ষেই ছিলেন গতবছর ক্ষমতায় আসা নতুন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস৷ কিন্তু বাধ সাধলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন৷ ইউক্রেন আক্রমণ করে তিনি মুহূর্তেই বার্লিনের টনক নড়িয়ে দিয়েছেন৷ বুশ, ওবামা, ট্রাম্প, বাইডেনরা জার্মানিকে যা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন, পুটিনে সেটা এক আক্রমণ থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন৷
জার্মানি এখন প্রতিরক্ষাখাত শক্তিশালী করতে ন্যাটোর প্রত্যাশামতো জিডিপির দুই শতাংশের বেশি ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ পাশাপাশি ২০২২ সালের বাজেটে একশ বিলিয়ন ইউরো আলাদাভাবে রাখা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের জন্য৷ শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশ্বের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার জন্য জার্মান সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে৷ আর রাশিয়ার তেল-গ্যাসের বিকল্প উৎসও খোঁজা হচ্ছে৷
শলৎস মনে করেন, জার্মানির স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র ধরে রাখতে প্রতিরক্ষা খাত শক্তিশালী করা দরকার৷ কথা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু না হলে বার্লিনের এই উপলব্ধি কি তৈরি হতো?